প্রাচীর দুয়ারে শুনি কলরোল সহসা তিমির-রাতে,
মিসরের শের, শির শমশের-সব গেল এক সাথে!
সিন্ধুর গলা জড়ায়ে কাঁদিতে দু'তীরে ললাট হানি'
ছুটিয়া চ'লেছে মরু-বকৌলি 'নীল' দরিয়ার পানি!
আঁচলের তার ঝিনুক মানিক কাদায় ছিটায়ে পড়ে,
সোঁতের শ্যাওলা আলো কুন্তল লুটাইছে বালুচরে......
মরু-'সাইমুম'-তাঞ্জামে চড়ি' কোন পরীবানু আসে?
'লু'-হাওয়া ধরেছে ধ'রেছে বালুর পর্দা সম্ভ্রমে দুই পাশে!
সূর্য নিজেরে লুকায় টানিয়া বালুর আস্তরণ,
ব্যজনী দুলায় ছিন্ন পাইন-শাখায় প্রভঞ্জন।
ঘূর্ণি-বাঁদীরা নীল দরিয়ায় আ৬চল ভিজায়ে আনি'
ছিটাইছে বারি, মেঘ হ'তে মাগি' আনিছে বরফ-পানি।
ও বুঝি মিসর- বিজয়লক্ষো মূরছিতা তাঞ্চামে,
ওঠে হাহাকার ভগ্ন মিনার আঁধার দীওয়ান-ই-আমে!
কৃষানের গরু মাঠে মাঠে ফেরে, ধরেনি ক' আজ হাল,
গম-ক্ষেত ভেঙ্গে পানি ব'য়ে যায় তবু নাহি বাঁধে আ'ল,
মনের বাঁধেরে ভেঙ্গেছে যাহার চোখের সাঁতার পানি
মাঠের পানি ও আ'লেরে কেমনে বা৬ধিবে সে, নাহি জানি।
হৃদয়ে যখন ঘনায় শাঙন, চোখে নামে বরষাত,
তখন সহসা হয় গো মাথায় এমনি বজ্রপাত!
মাটিরে উজায়ে উপুড় হইয়া কাঁদিছে শ্রমিক কুলি,
বলে-"মা গো তোর উদিরে মাটির মানুষই হ'য়েছে ধূলি,
রতন মানিক হয় না তো মাটি, হীরা সে হীরাই থাকে,
মোদের মাথায় কোহিনূর মণি- কি করিব বল তাকে?
দুর্দিনে মা গো যদি ও-মাটির দুয়ার খুলিয়া খুঁজি,
চুরি করিবি না তুই এ মানিক? ফিরে পাব হারা পুঁজি?
লৌ পরশি' করিনু শপথ, ফিরে নাহি পাই যদি
নতুন করিয়া তর বুকে মোরা বহাব রক্ত-নদী!"
আভীর-বালারা দুধাল গাধীরে দোহায় না, কাঁদে শুয়ে,
দুম্বা শিশুরা দূরে চেয়ে আছে দুধ ঘাস নাহি ছুঁইয়ে।
মিষ্টি ধারাল মিছরির ছুরি মিসরী মেয়ের হাসি,
হাঁসা পাথরের কুঁচি-সম দাঁত,- সব যেন আজ বাসি!
আঙুর লতার অলকগুচ্ছ- ডাঁশা আঙুরের থোপা,
যেন তরুণীর আঙুলের ডগা- হুরী বালিকার খোঁপা,
ঝুরে ঝুরে পড়ে হতাদরে আজ অশ্রুর বুঁদ-সম!
কাঁদিতেছে পরী, চারিদিকে অরি, কোথায় অরিন্দম!
মরু- নটী তার সোনার ঘুঙুর ছুঁড়িয়া ফেলেছে কাঁদি'
হলিদ খেঁজুর-কাঁধিতে বুঝি বা রয়েছে তাহারা বা৬ধি'
নতুন করিয়া মরিল গো বুঝি আজি মিসরের মমি,
শ্রদ্ধায় আজি পিরামিড যায় মাটির কবরে নমি'!
মিসরে খেদিব ছিল বা ছিল না, ভুলেছিল সব লোক,
জগলুলে পেয়ে ভুলেছিল ওরা সুদান-হারার শোক।
জানি না কখন ঘনাবে ধরার ললাটে মহাপ্রলয়,
মিসরের তরে 'রোজ-কিয়ামৎ'ইহার অধিক নয়!
রহিল মিস, 'চ'লে গেল তার দুর্মদ যৌবন,
রুস্তম গেল, নিষ্প্রভ কায়খসরু-সিংহাসন।
কি শাপে মিসর লভিল অকালে জরা যযাতির প্রায়,
জানি না তাহার কোন সুত দেবে যৌবন ফিরে তায়;
মিসরের চোখে বহিল নতুন সুয়েজ খালের বান,
সুদান গিয়াছে- গেল আজ তার বিধাতার মহাদান!
'ফেরাউন' ডুবে না মরিতে হায় বিদায় লইল মুসা,
প্রাচী'র রাত্রি কাটিবে না কি গো, উদিবে না রাঙা ঊষা?
***********************
শুনিয়াছি, ছিল মমির মিসরে সম্রাট ফেরাউন,
জননীর কোলে সদ্য প্রসূত বাচ্চার নিত খুন!
শুনেছিল বাণী, তাহারী রাজ্যে তাহার রাজপথ দিয়া
অনাগত শিশু আসিছে তাহার মৃত্যু-বারতা নিয়া।
জীবন ভরিয়া করিল যে শিশু-জীবনের অপমান,
পরের মৃত্যু-আড়ালে দাঁড়ায়েসে-ই ভাবে, পেল প্রাণ!
জনমিল মুসা, রাজভয়ে মাতা শিশুরে ভাসায় জলে,
ভাসিয়া ভাসিয়া সোনার শিশু গো রাজারই ঘাটেতে চলে।
ভেসে এল শিশু রানীরই কোলে গ, বাড়ে শিশু দিনে দিনে
শত্রু তাহারি বুকে চ'ড়ে নাচে, ফেরাউন নাহি চিনে।
এল অনাগত তারি প্রাসাদের সদর দরজা দিয়া,
এখনো প্রহরী জাগে বিনিদ্র দশ দিক আগুলিয়া!
-রসিক খোদার খেলা,
তারি বেদনায় প্রকাশে রুদ্র যারে করে অবহেলা!
মুসারে আমরা দেখিনি, তোমায় দেখেছি মিসর-মুনি,
ফেরাউন মোরা দেখিনি, দেখেছি নিপীড়ন ফেরাউনী।
ছোটে অনন্ত সেনা-সামন্ত অনাগত কার ভয়ে,
দিকে দিকে খাড়া কারা-শৃঙ্খল, জল্লাদ ফাঁসি ল'য়ে।
আইন-খাতার পাতায় পাতায় মৃত্যুদন্ড লেখা,
নিজের মৃত্যু এড়াতে কেবলি নিজেরে করিছে একা!
সদ্যপ্রসুত প্রতি শিশুটিরে পিয়ায় অহর্নিশ
শিক্ষা দিক্ষা সভ্যতা ব'লি তিলে তিলে-মারা বিষ।
ইহারা কলির নব ফেরাঊন ভেল্কি খেলায় হাড়ে,
মানুষে ইহারা না মেরে প্রথমে মনুষ্যত্ব মারে!
মনুষ্যত্বহীন এই সব মানুষেরই মাঝে কবে
হে অতি-মানুষ, তুমি এসেছিলে জীবনের উৎসবে।
চারিদিকে জাগে মৃত্যুদন্ড রাহকারা প্রতিহারী,
এরই মাঝে এলে দিলেন আলোক নির্ভীক পথচারী।
রাজার প্রাচীর ছিল দাঁড়াইয়া তোমারে আড়াল করি'
আপনি আসিয়া দাঁড়াইলে তার সকল শূন্যে ভরি'!
পয়গম্বর মুসার তবু তো ছিল 'আষা' অদ্ভুত,
খোদ সে খোদার প্রেরিত- ডাকিলে আসিত স্বররগ-দূত!
প্যগম্বর ছিলে না ক'তুমি- পাওনি ঐশী বাণী,
স্বর্গের দূত ছিল না দসর, ছিলে না শস্ত্র-পাণি
আদেশে তোমার নীল দরিয়ার বক্ষে জাগেনি পথ,
তোমারে দেখিয়া করেনি সালাম কোনো গিরিপর্বত!
তবুও এশিয়া আফ্রিকা গাহে তোমার মহিমা গান,
মনুষত্ব্য থাকিলে মানুষ সর্বশক্তিমান!
দেখাইলে তুমি, পরাধীন জাতি হয় যদি ভয়হারা,
হোক নিরস্ত্র, অস্ত্রের রণে বিজয়ী হইবে তারা।
অসি দিয়া নয়, নির্ভীক করে মন দিয়া রণ জয়,
অস্ত্রে যুদ্ধে জয় করা সাজে- দেশ জয় নাহি হয়।
ভয়ের সাগর পাড়ি দিল যেই শির করিল না নীচু,
পশুর নখর দন্ত দেখিয়া হটিল না কভু পিছু,
মিথ্যাচারীর ভ্রুকুটি-শাসন নিষেধ রক্ত-আঁখি
না মানি- জাতির দক্ষিণ করে বা৬ধিল অভয় রাখী,
বন্ধন যারে বলিন্দ হ'য়ে নন্দন-ফুলহার,
না-ই হ'ল সে গো পয়গম্বর নবী দেব অবতার,
সর্বকালের সবদেশের সকল নর ও নারী
করে প্রতীক্ষা, গাহে বন্দনা, মাগিছে আশিস তারি!
*************************
'এই ভারতের মহামানবের সাগর-তীরে' হে ঋষি,
তেত্রিশ কোটি বলির ছাগল চরিতেছে দিবানিশি!
গোষ্ঠে গোষ্ঠে আত্নকলহ অজাযুদ্ধের মেলা,
এদের রুধিরে নিত্য রাঙিছে ভারত-সাগর-বেলা।
পশুরাজ যবে ঘাড় ভেঙে খায় একটারে ধরে আসি'
আরটা তখনো দিব্যি মোটায়ে হ'তেছে খোদার কাসি!
শুনে হাসি পায় ইহাদেরও নাকি আছে গো ধর্ম জাতি,
রাম-ছাগল আর ব্রহ্ম-ছাগল আরেক ছাগল পাতি!
মৃত্যু যখন ঘনায় এদের কশা'য়ের কল্যাণে,
তখনো ইহারা লাঙল উঁচায়ে এ উহারে গালি হানে।
ইহাদের শিশু শৃগালে মারিলে এরা সভা ক'রে কাঁদে,
অমৃতের বাণি শুনাতে এদের লজ্জায় নাহি বাধে!
নিজেদের নাই মনুষত্ব্য, জানি না কেমনে তারা
নারীদের কাছে চাহে সতীত্ব, হায় রে শরম-হারা!
কবে আমাদের কোন সে পুরুষে ঘৃত খেয়েছিল কেহ
আমাদের হাতে তারি বাস পাই, আজো করি অবলেহ!
আশা ছিল, তবু তোমাদেরি মত অতি-মানুষেরে দেখি',
আমরা ভুলিব মোদের এ গ্লানি খাঁটি হবে যত মেকী!
তাই মিসরের নহে এ শোক এই দুর্দিন আজি,
এশিয়া আফ্রিকা দুই মহাভূমে বেদনা উঠেছে বাজি'!
অধীন ভারত তোমারে স্মরণ করিয়াছে শতবার,
তব হাতে ছিল জলদস্যুর ভারত-প্রবেশ-দ্বার।
হে 'বনি ইসরাইলের' দেশের অগ্রনায়ক বীর,
অঞ্জলি দিনু 'নীলের' সলিলে অশ্রু ভাগিরথীর!
সালাম করারও স্বাধীনতা নাই সোজা দুই হাত তুলি'
তব 'ফাতেহা'ইয় কি দিবে এ জাতি বিনা দু'টো বা৬ধা বুলি!
মলয়-শীতলা সুজলা এ দেশে-আশিস করিও খালি-
উড়ে আসে যেন তোমার দেশের মরুর দু'মুঠো বালি।
তোমার বিদায়ে দূর অতীতের কথা সেই মনে পড়ে,
মিসর হইতে বিদায় লইল মুসা যবে চিরতরে,
সম্ব্রমে স'রে পথ ক'রে দিল নীল দরিয়ার বারি,
পিছু পিছু চলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া মিসরের নর-নারী।
সৈন্য-সম ছোটে ফেরাউন-সেনা ঝাঁপ দিয়া পড়ে স্রোতে,
মুসা হ'ল পার, ফেরাউন ফিরিল না নীল নদী হ'তে!
তোমার বিদায়ে করিব না শোক, হয়ত দেখিব কাল
তোমার পিছনে মরিছে ডুবিয়া ফেরাউন দজ্জাল!