“আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়”
এভাবে যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন তখন এক আশ্চর্য বোধ এসে জমা হয়। যেভাবে জীবনানন্দ বলেছিলেন-
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ -
মরিবার হলো তার সাধ –
অথচ জীবনে সব ছিলো – যে জীবনে  হতাশা থাকার কথাই নয় তবু হতাশা, ক্লান্তি জীবন সম্পর্কে অনীহা এসে জমা হলে কবিগুরুর ক্যামেলিয়া  কবিতায় এক হতাশা বোধ থেকে অতিক্রান্ত হবার সকল পথ  রুদ্ধ হয়েও যেনো  নতুন এক উন্মুক্ত পথের অভিযাত্রী -
ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা,
      বড়ো রকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে,
             নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে–
দিন যখন নিরীহ কাটতে থাকে তাতে যা চাই তা পাচ্ছিনা অথচ চাই বড় রকমের একটা কিছু হোক– কিন্তু কমলার পথ চেনা সেই লাজুক প্রেমিক কিন্তু বার বার তার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চেয়েছে – অথচ সে  এমন যে কিছুতেই  প্রেমিকের চোখের ভাষা পড়তে পারেনি ।

কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ।
ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,
         ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে
      কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশ্‌পিশ্‌ করে।
এমন সময়ে সে এক মোটা চুরোট ধরিয়ে
                     টানতে করলে শুরু।
         কাছে এসে বললুম, "ফেলো চুরোট।’
সবাই বাহবা দিলো কিন্তু ক্যামেলিয়া সেই ট্রামে ওঠা বন্ধ করলো ।
“পরদিন তাকে দেখলুম না,
                 তার পরদিনও না,
             তৃতীয় দিনে দেখি
         একটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে।
বুঝলুম, ভুল করেছি গোঁয়ারের মতো।
         ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে –
যে সমাজে তখনো নারী ঘরের ভেতর বন্দী এবং এক পা দুপা করে এগিয়ে এসেছে আধুনিক জীবনে -  আলোর জগতে -  রবীন্দ্রনাথের লেখায় সেই নারীমুক্তির বাণী যেন অলক্ষ্যেই সূচীত হয়েছে ।
তবু ক্যামেলিয়া কবিতায় একই সাথে কবি প্রেমিক এবং নিরন্তর দুঃখবাদী ।

বিচ্ছেদের ভেতরে সান্ত্বনা খুজেছেন – যে প্রেম লৌকিক নয় সে প্রেম অলৌকিকই থেকেছে । জ্বলেছেন এবং তাকে ফিরে পেয়েছেন অন্য আশ্রয়ে । প্রেম তো সমর্পনই । যেখানে বার বার হতাশার বিচ্ছেদের ভেতর তাকে অংগার হতে হয় সেখানে দীর্ঘশ্বাস বৈ আর কিছু থাকে না । তবু জীবন থেমে থাকে না --
বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, "বাবু, ডেকেছিস কেনে।’
      বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া
         সাঁওতাল মেয়ের কানে,
             কালো গালের উপর আলো করেছে ।
সে আবার জিগেস করলে, "ডেকেছিস কেনে ।’
         আমি বললেম, "এইজন্যেই।’
             তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।
    
বাঁশি কবিতায় বাঙ্গালী নারীর সেই অনির্বচনীয়  শ্বাসত মুখ  এবং  রূপ কি ভীষন মিষ্টিরূপে ধরা দেয় –
ঘরেতে এলো না সে তো মনে তার নিত্য আসা যাওয়া-
পড়নে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর –
যে নারীকে ভালোবাসা হলো সে নারী তার ঘরে আনা হয়নি তার দারিদ্রের কারণে –
আহা দারিদ্র –
বেতন পঁচিশ টাকা,
    সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
        খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
               ছেলেকে পড়িয়ে।
        শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
সন্ধ্যেটা  কাটিয়ে আসি,
        আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
যে নিজের ঘরের ভেতর আলো জ্বালাতে পারে না  সে কি করে অন্যের জীবনে আলো জ্বালাবে?
তাকে সেই ভালোবাসাকেও ভুলে থাকতে হয় ।
বর্ষা ঘন ঘোর।
    ট্রামের খরচা বাড়ে,
মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
           গলিটার কোণে কোণে
        জমে ওঠে পচে ওঠে
               আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
                          মাছের কান্‌কা,
জীবন এমন অসহনীয় -গলিটার কোনে যেমন জমে ওঠে ময়লার স্তুপ সে জীবন ও এমনি – কোনো আলো নেই- দারিদ্রের কারণে না পাবার বেদনাটুকুন আছে আর আছে  শুধুই টিকে থাকার কথা –
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঁশী কবিতায় জীবনের যে চিত্র এঁকেছেন সে উনিশ শতকের শুরুর -  ইংরেজ উপনিবেশ কাল । অস্তিত্বকে কোনো রকমে  টিকিয়ে রাখার প্রানান্তকর চেষ্টার   কথা যেমন আছে তেমনি আছে ঘ্যান ঘ্যানে সেই সমাজের এমন হতাশাবাদী তারুণ্যের কথা যারা এই সময়কেই মেনে নিয়েছে । প্রতিবাদী হয়ে শক্ত হয়ে সাহসী কোনো পদক্ষেপ নেয় নি ।
তবু প্রেমের ক্ষেত্রে উঁচু নীচু কোনো ভেদ নেই । সেখানে আকবর বাদশাহর সাথে হরিপদ কেরাণীর কোনো পার্থক্য নেই । এবং  বেদনাতো চিরকালীন -

                  হঠাৎ খবর পাই মনে
           আকবর বাদশার সঙ্গে
               হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।
সে বেদনায় হরিপদ কেরাণী এবং রাজা বাদশাহ সমান ভাবেই দাহ অনুভব করে এবং
“এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধূলিলগ্নে
        সেইখানে
           বহি চলে ধলেশ্বরী;
        তীরে তমালের ঘন ছায়া;
               আঙিনাতে
        যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার
           পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।

তবু আশাবাদী মন এক অপেক্ষাকাতর নারীর জন্য আকুল থাকে – সে অপেক্ষা করে থাকে অনন্তকাল এবং ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুরের চিরকালীন ভালোবাসার নারীর জন্যে - এই অপেক্ষা কখনোই ফুরোবার নয় ।
“ বাঁশী” এবং “ক্যামেলিয়া” কবিতা দুটো পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া । পুনশ্চর কবিতাগুলোতে গল্পের ছোঁয়া আছে । কবি নিজেই বলেন    -
অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব -
পদ্য হল সমুদ্র,
           সাহিত্যের আদিযুগের সৃষ্টি।
                তার বৈচিত্র্য ছন্দতরঙ্গে,
                     কলকল্লোলে!
গদ্য এল অনেক পরে।
     বাঁধা ছন্দের বাইরে জমালো আসর।
          সুশ্রী-কুশ্রী ভালো-মন্দ তার আঙিনায় এল
                         ঠেলাঠেলি করে।
গদ্য ছন্দে লেখা কবিতাগুলোতে  এক একটি গল্প এক একটি গান –
চেনা জানা জগত সে জগতের ভেতরে বাইরে যে সুর নীরবে  বহমান – নদীর মতন তির তির করে সে এঁকে বেঁকে যায় দু’পাড় ভিজিয়ে দেয় পাঠক হৃদয়কে সিক্ত করে –
কালকে অতিক্রম করে যে ভাব , ভাষা , বোধ আঙ্গিকের বৈচিত্র্য  সে কবির ভাষায় যথারীতি এক পরাক্রম শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেও কবি কিছুটা সন্দিহান –
তাই, প্রথম ঘণ্টা বাজল যেই
               বেরিয়েছিলেম হিসেব চুকিয়ে দিয়ে।
         দরজার কাছ পর্যন্ত এসে যখন ফিরে তাকাই
               তখন দেখি, তুমি যে আছ
                  এ কালের আঙিনায় দাঁড়িয়ে।
আমার বাণীকে দিলেম সাজ পরিয়ে
                   তোমাদের বাণীর অলংকারে;
        তাকে রেখে দিয়ে গেলেম পথের ধারে পান্থশালায়”
আবার কবি যুক্ত করেছেন নিজেকে সকল কালের সাথে -
চিরকালীন এক সবুজ কবি যখন বলেন
             “যেন গর্ব করে বলতে পার
                   আমি তোমাদেরও বটে,
             এই বেদনা মনে নিয়ে নেমেছি এই কালে” —
কবির বেদনা চিরকালীন । সে বেদনা থেকে এবং  অতৃপ্তি থেকে কবির যাত্রা সীমা ছাড়িয়ে অসীমে , কাল ছাড়িয়ে মহাকালে – তাই কবিকে একটা সময়ে আটকে রাখা যায় না এবং কবির এই যাত্রা অসীমের পথে –