কতকাল একজন স্রষ্টার কাজ বেঁচে থাকে? একশত বা দুশত বছর কিংবা সেই ভাষা যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন হয়তোবা অথবা একটা অখন্ড সূর্যের পাশের সব আলো ম্লান হয়ে যায় তখন শুধু অখন্ড সূর্যই থাকবে আর সব মিটি মিটি তারার মত জ্বলবে। রবী ঠাকুরের অমর সৃষ্টি সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় আমাদের মনে করিয়ে দেয় কবিগুরুই শ্রেষ্ঠ। বিশেষ করে সংগীতের ক্ষেত্রে যে অবদান তার সাথে আর সবই যেনো ম্লান। তবু সৃষ্টির কিছু বেদনা থাকে। কবির আনচান কবির ভেতরকার বেদনা সুখ আনন্দ সবটুকুই যখন অনবদ্য ভাষায় বের হয়ে আসে তখন পাঠক ও কবির সাথে আকুল হন। এবং গায়ক গায়িকা শিল্পী সবার বেদনা আনন্দ অনুভব সার্বজনীনতা প্রকাশ পায়। তখন কবির বেদনা আর কবির শুধু নয় পাঠক শ্রোতা শিল্পী সবার সংশ্লিষ্টতা পাঠককে আকুল করে তুলে ।
কবিতা শব্দের খেলা, ইমাজিনেশন এর চুড়ান্ত এবং পরতে-পরতে লুকিয়ে থাকে না বলা কথা, আবার কোনো সময়ে সব কথা বলা হয়ে যায় - সম্ভবত রবীন্দ্র যুগের কবিতায় সে প্রভাব ছিল । কবি নিজেই যখন বলেছেন, সহজ কথা যায় না বলা সহজে-সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে -সে কবি আবার নিজেই বক্তা হয়ে সব বলে দেন সব কথা। কোনো কোনো কবিতায় আবার আড়াল রেখেছেন-
“মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে –
আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে-
কাজের দিনে নানান কাজে থাকি নানান লোকের মাঝে –
পরান আমার ভেসে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে”
আজকের কবি এত সহজে সব কথা বলে দেন না। আড়াল রাখেন। এখন অনেকে বলছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হিসেবে সফল নন। যতটা তাঁর গানে। কিন্তু আজকের যুগেও কবির প্রায় সব লেখাই পাঠককে মুগ্ধ করে।পাঠক মগ্ন একাকীত্বে উপলদ্ধি করেন কবির অনন্য সৃষ্টির সাথে নিজেকে লীন করার -
“যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া, যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা”।
এক মিহি অন্ধকারে যখন বিহঙ্গের প্রতি আকুতি, এবং এই আকুলতা যখন এ পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্য এক অজানা শুণ্যের দিকে তখনো মানবের আকাংখা সেই চরাচরের কাছে পৌছানো। সমগ্র চরাচর অন্ধকারে ঢেকে আসলেও এই উড়ে যাওয়ার যে অমিয় বাসনা সে যেন এখুনি বন্ধ না হয়। এক ধরনের হাহাকার কবিতার পরতে পরতে। তার সাথে লীন হয়ে যায় পাঠক এবং কবি। আবার যখন বলেন,
“তোমারেই করিয়াছি জীবনেরো ধ্রুবতারা
এ সমুদ্রে আরো কভূ হবো নাকো পথহারা
যেথা আমি যাই নাকো
তুমি প্রকাশিত থাকো
আকুল নয়নজলে
ঢালো গো কিরণোধারা”
অবশ্যই সে মহাশক্তিকে আমরা প্রায়শই চিনতে ভুল করি। তবু সৃষ্টিকর্তা ছেড়ে যান না। অনুতপ্ত মানব মন ফিরে আসে। এই পৃথিবীতে যাপনের দিনগুলোতে আমরা যখন অবিচ্ছিন্নভাবে বিচ্যুত পথে নিজেদের মগন করি পুনরায় ফিরে আসার আকুতিও থাকে। কবির এই যে অনুভব সে শুধুমাত্র আপন অনুভব নয়। এ যেন বিশ্বজনীন। আবার কবি যখন বলেন-
“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না
কেন মেঘ আসে হৃদয়াকাশে
মোহমেঘে অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না”
আসলেই তো মানুষ মোহান্ধ হলেই সে চিনতে ভুল করে। তাই তো হীরা ফেলে ভুল করে কাঁচ তুলে নেয়। দ্বিধায় বিভ্রান্তিতে জড়ানো মানুষ আসল যিনি আছেন তাকে চেনে না। এই ভ্রান্তি মানুষের চিরকালীন।
ভালোবাসার মানুষকে সকল সময়ে হারানোর আশংকা মানব মনের। অস্থিরতা মানব মনের, সেই চিরচেনা অথচ অচেনা দিকটির উন্মেষ করেছেন। যাকে পাওয়া গেলো তাকেই আবার হারানোর ভাবনায় মন সদাই শংকিত। আবার তাকে পেয়ে হারানোর বেদনাও ভোলা যায় না। একই সাথে আকুতি এই যে মাঝে মাঝেই বা কেন হবে, সকল সময়েই পেতে চায় প্রেমিক মন তাকে।
“ক্ষণিকও আলোকে আঁখিরও পলকে,
তোমারে যবে পাই দেখিতে
হারাই হারাই সদা ভয় হয়,
হারাইয়া ফেলি চকিতে”
আবার কবি যখন বলেন-
“কি করিলে বলো পাইবো তোমারে, রাখিবো আঁখিতে আঁখিতে
ওহে এতো প্রেম আমি কোথা পাব নাথ তোমারে হৃদয়ে রাখিতে–
এবং প্রেম তো সেই সুগভীর হৃদয়ে প্রোথিত। অজানা মন যখন জানেনা কি করলে এই তাকে পাওয়া যাবে, সে দিকটি যদি উন্মোচিত হয় সেও বড়ই আশির্বাদ। এর জন্য চাই হৃদয়ে আরো গভীর প্রেম। প্রেমিক/প্রেমিকা যে উজার করা ভালোবাসা চায় সেই ভালোবাসা হয়তো তার নেই।
এ কারণেই হয়তো তাকে হারাবার আশংকা থেকেই যায়। যতই ভালোবাসা হোক তবু মনে হয় অপূর্ণ সেই ভালোবাসা। অপূর্ন সেই প্রেম। আবার সেই প্রেমের জন্য নিজেকে বিসর্জন দিতেও দ্বিধান্বিত হয় না মন।
“ওহে আর কারো পানে চাহিবো না আর,
করিব হে আমি প্রাণোমন
ওহে তুমি যদি বলো এখুনি করিব
বিষয়ও বাসনা বিসর্জন
দিব শ্রীচরণে–
কিন্তু নিজের কোনো বিচ্যুতির কারণেও যদি তাকে হারাতে হয় তখন প্রেমিক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় আর কারো পানে সে চাইবে না, এই মন কাউকে দেবে না এবং এমনি সে মাজনুন যে সে নিজের বিষয় বাসনা জীবন সবই উৎসর্গ করবে তার ভালোবাসার মানুষের শ্রীচরণে।
সুখ পাখি কি ? কে চেনে তাকে ? কেউ কি দেখেছে? অথচ সেই সুখের জন্য ছুটোছুটি করছে মানব মানবী । কখনো এর কাছে কখনো বা তার কাছে, কিন্তু সুখ পাখি অধরা কাউকে ধরা দেয় না । এই অতৃপ্তির কারণে এই ছুটে ছুটে চলা
“এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মিলে না
এরা ভুলে যায় কারে ফেলে কারে চায়”
খুব সত্যি। যে সুখের জন্য প্রেম চায় সে প্রেম তো লৌকিক নয়। তাই তারাই ভুলে যায় কারে ফেলে কারে চায়। এই চিনতে না পারার অবিমৃশ্যকারিতায় মানব মন ছুটোছুটি করে।
“তাই কেঁদে কাটে নিশি
তাই দহে প্রাণ
তাই মান অভিমান”
এই যে এতো প্রেম এতো সুখ এতো অসুখ তার জন্য তো দহন আছে। সে থাকবেই। কারণ প্রকৃত ভালোবাসার স্বরূপ না জানলে সে ছুটোছুটি করেই। এরপর যা তার প্রাপ্য সেটা পায় না এবং আজন্ম হা-হুতাশ।
এত সমৃদ্ধ কথা ও বাণী কবি গুরু লিখতেই পারেন। আবার সেই যে সৃষ্টিকর্তা তার নিকট আমাদের চাওয়া - আরাধনা ততক্ষন পর্যন্ত যখন পর্যন্ত আমাদের ভালো থাকাগুলো বিনষ্ট না হয়, যখন আর কোনো পথ খোলা নেই। কিন্তু কবিগুরুর সেই চিরাচরিতকে ছেড়ে নতুন পথ ধরে হাঁটা– এই বিপদের দিনেও যদি আমার বিপদ থেকে উত্তরণ না হয় তবে সেই সংকটের কালেও হে মহানের প্রতি যেন আমাদের এটুকু বিচ্যুতিও না আসে, অবিশ্বাস না আসে-
“নম্রশিরে সুখের দিনে তোমারি মুখ লইব চিনে,
দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়”
যেদিন আমার দুখের দিন সে দিনেও যদি কষ্ট পাই, দুখের ভার লাঘব না হয় তবু সৃষ্টিকর্তার প্রতি সংশয়ের অবকাশ যেন আমাদের না হয়। কেননা দুখের দিন উত্তীর্ণ হবেই। তবু দুখের দিনে সেই দুখের তোড়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি সংশয় না রেখে বিশ্বাস রাখাই প্রকৃত মানবের কর্ম এবং সমস্ত আরাধনা তখনই সফল। সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য আর নিজেকে সমর্পণ কবির মতো করে কে কবে দেখিয়েছেন।
“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে”।
এই অহংকার এই গৌরব সে তো দুদিনের। অথচ আমরা তুচ্ছ এই পার্থিব চাওয়া পাওয়ার ভেতরে ডুবে থাকি। কবির প্রার্থনা সে স্রষ্টার কাছে যিনি চাইলেই সব পারেন। তিনি পারেন ভেতরের আমিত্ববোধ কেও নির্বাণ করতে।
অচেনাকে চেনা অজানাকে জানা মানবমনের কৌতূহল চিরদিনের। তবু কিছু চেনা দৃশ্য থাকে । যেমন গান গেয়ে নৌকায় করে যে আসে তাকে চিরকালের চেনা মনে হলেও সেও তো অচেনা কেউ। অথচ এক ভোর সকালে যে মাঝিকে আসতে দেখা গিয়েছে কবির মনে হয়েছে সেও বুঝি খুব চেনা।
“গ্রামখানি মেঘে ঢাকা প্রভাতবেলা-
এ পাড়েতে ছোটো খেত
আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে”।
সে অচেনা মাঝি যখন কোনো দিকে না চেয়ে গন্তব্য পানেই তার যাত্রা তখন তাকে কে বাঁধে! এই বিশ্বসংসারে আমরা সব অচেনা মাঝি। জীবন চলার পথে ঢেউ আসে এবং সেই ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যাওয়া। কোথাও তাকানোর তো অবকাশ নেই।
“ভরা-পালে চলে যায়, কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায় ভাঙে দু-ধারে”—
কবির এই যে সীমার মাঝে অসীমের অনুসন্ধান সে তাঁর লেখাতেই অনবদ্য হয়ে জানান দেয় আমাদের। জীবন এক নৌকো। আমরা সে নৌকোর মাঝি। আমাদের এই চলার কোনো শেষ নেই –
এই ছুটে চলাকে কবি চিহ্নিত করেন অন্যভাবে –
শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা
শুধু আলো আঁধারে কাঁদা হাসা
শুধু দেখা পাওয়া শুধু ছুঁয়ে যাওয়া
শুধু দূরে যতে যেতে কেঁদে চাওয়া
শুধু নব দুরাশায়
আগে চলে যায়
পিছে ফেলে যায়
মিছে আশা –
এই যাওয়া আসা তো আসলে শ্যাওলার মতই । কত আশা দুরাশায় পরিণত হয় তবু এই চলা তো থেমে থাকে না –যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলা শুরু করেছে বাংলা সাহিত্য তখন ধ্রুবতারার মত রবীন্দ্রনাথঠাকুরের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যকে শুধু সমৃদ্ধ করে দিয়েছেন বললে সম্পূর্ণ বলা হোল না। বলতে হয় বাংলা সাহিত্যকে পরিণতি দান করেছেন। যে টলোমলো পায়ে বাংলা সাহিত্য হাঁটতে শুরু করেছিলো সেই হাঁটাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছেন কবিগুরু এবং বিশ্বসাহিত্যের আসরে বাংলা সাহিত্যের একটা সম্মানীত আসন গড়ে দিলেন। সৃষ্টিকর্তার পরম দান বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র নামে সূর্যের দান। যার আলোতে সব আলো অনুজ্জ্বল হয়ে রবি তারাই শুধু জ্বল-জ্বল করে উঠলো।