(লেখাটি  দৈনিক পূর্বদেশ সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত )
http://dailypurbodesh.com/%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%A4%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF/

সাহিত্যের উদ্দেশ্য কি ? কেনো মানুষ অযথা সাহিত্যের চর্চা করে ? এতে তো জাগতিক লাভ কমই হয় তবু মানুষ কেনো  সাহিত্য সাহিত্য করে এক অদৃশ্য আনন্দঘন জগতে ঘুরে বেড়ায় ?এই কুহক জগতে ঘুরে ঘুরে মানুষ সাহিত্য নামক শিল্পের চর্চা করে । মনের খোরাক যোগায় । কবিতা নামক এক আলো আঁধারী পথে পা বাড়ায় ।
সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবিতাই মানব মনের সর্বাধুনিক শিল্পরূপ সমৃদ্ধ ক্ষেত্র ।  কবিতার মোহময় পথে বিচরণ করে কবি অকবি সকলে । যেহেতু সকল মানুষের ভেতরেই একজন কবি বাস করে যে সন্ধ্যায় মায়াময় চাঁদ দেখে অভিভুত হয় । 'নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাত দেখি কাল ,ডাবের মত চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল (আল মাহমুদ)
এমন বাক্য রচনা করে বুঝিয়ে দেন মানুষ শুধু মানুষ নন তিনি সৃষ্টিশীল তিনি  কবি ।
কবিতা তো সহজে কথা বলে না । সে নারীর মতই লাজুক , রহস্যময়ী । নানাভাবে ,  নানা বর্ণে সে নিজেকে প্রকাশ করে । আজকের বাংলাদেশের আধুনিক কবি ময়ুখ চৌধুরীর বিচরণ ক্ষেত্র কাব্যজগতের সেই চিররহস্যময় পথ । বর্তমান  আধুনিক সাহিত্যের জগতে  ময়ুখ চৌধুরী (জন্ম – ১৯৫০) কাব্য সুষমায় সমর্পিত প্রতীত পুরুষ । বিশ শতকের নব্বই এর দশকের কবির কবিতায়" কিন্তু তিনি গেল শতকের ৭০ দশকের কবি। অর্থাৎ উনবিংশ শতকের ৭০ এর কবি। তার শরীর মন বুদ্ধির সমন্বয়ে পূর্ণ ।  কবি এক সাক্ষাৎকারে বলেন – শিক্ষকতা আমার পায়ের তলার মাটি , কবিতা আমার অথিষ্ট নীলিমা , নিঃশ্বাসের বায়ুমন্ডল , একটি জীবিকা অন্যটি জীবন ।
কাব্যচর্চায় কবি ময়ুখ চৌধুরী কাউকে গুরু মানেননি । তার কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় কাব্যিক দ্যোতনা পৃথক মন্ত্রনা দান করে । কবিতার কাব্যরস আস্বাদনে পাঠকের মর্মমূল নাড়িয়ে দেয় । যেমন – একমাত্র তুমিই দেখতে পেলে / তোমার শিক্ষিত চোখে /আমার বুকের পাড়ায় কি জবর লেগেছে আগুন “ এমন কবিতা পাঠে পাঠকও নিজের হৃদয়ে কম্পন অনুভব করে । কবির সাথে স্পর্শকাতর হন ,  মুগ্ধ হন । ভাষার বীর্যতা ,কবিতার ভেতরের সুরের নহর তার গভীর এবং দুর্বোধ্য কবিতাকেও সুখপাঠ্য করে ।
পিরামিড সংসার , জারুলতলার কাব্য , অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই কবি কবিতাকে খুঁজেছেন । শব্দের মায়াময় বন্ধনে নিজেকে লীন করতে চেয়েছেন । সেই কবিতা আরাধ্য অথচ নির্মম । সহজে ধরা দেয় না ।ক্রমশ দূরে সরতে সরতে এতটা দুরত্বেই পৌছায় যে মনে হয় আর বুঝি তাকে পাওয়া যাবে না ।  জটিল যন্ত্রনার যুথবদ্ধ জীবনে অধরা কবিতা ক্রমশই অনতিক্রম্য ব্যবধানে এসে দাঁড়ায় –
‘সারিবদ্ধ ক্ষুধার্ত অক্ষর
জমা হচ্ছে মাকড়সার ডিমের ভেতর ‘
কবিতা সংগ্রহ /পিরামিড সংসার “
আবার কবিতা যখন এসে ধরাই দিলো তখন এর ধ্যানেই কয়েক শতাব্দী কেটে যেতে পারে । স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে যান কবি ।
“স্বেচ্ছাবন্দী – পড়ে আছি  শব্দের ভিতর ,
স্মৃতিহীনতার কষ্ট খসড়াই থেকে গেল বুঝি !
কি করে বা বলি ,  উড়ে যাও  
শবদেহ কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নিঃসঙ্গ চরণ “ ।
একটি নিঃসঙ্গ পংক্তি /পিরামিড সংসার
ময়ুখ চৌধুরী উত্তরাধুনিক কবি । উত্তরাধুনিক চোখ শব্দের সংগে বহুরূপ দেখে । শব্দের ভেতর দেখে  বাহির ও দেখে । উত্তরাধুনিক কবিতায় পরাবাস্তবতা ,উপমায় কথা বলা  , নান্দনিকতা , শব্দের কারুকাজ , বাক্যের ভেতরে অলংকারের সমারোহ কবিতাকে ভিন্ন মাত্রা দেয় । ময়ুখ  তার কবিতায় গভীর ভাবের কথাটাই বার বার বলতে চেয়েছেন ।    গভীর দ্যোতনাবাহী  ,নান্দনিক শব্দ পরিকল্পনায় কবিতার পথে হাঁটাই যেনো ভবিতব্য – এ থেকে নিষ্কৃতি নেই । তবু অতৃপ্তির একটা হাহাকার – পিরামিড সংসার , “অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে”  কাব্যগ্রন্থের বেশ কটি কবিতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ।  
কাব্যদেবীকে পাবার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষায় বার বার তাকে খুঁজেছেন প্রকৃতিতে , বাংলা শব্দের সমাহারে । পরমাত্মাকে  পাবার আরাধনায় কাটে  যেমন জীবাত্মার জীবন । কবিতাকে পাবার আরাধনায় কাটে কবির জীবন ।
এ যেনো সেই রাধার আকুলতার মতন । যে রাধা কৃষ্ণকে পেতে চেয়েছেন সমসত জীবন ব্যাপী ।
“কবিতা দরজা খোলো ; আমি এক অনিদ্র জোনাকী
নিজের আগুনে পুড়ে রয়ে গেছি অবুঝ সবুজ ।
তোমাকে রচনা করি এরকম সাধ্য বলো কই !”
কবিতা তোমার দরজায়/ অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে “

ময়ুখ চৌধুরীর কবিতার শরীর  নির্মেদ টান টান  ,জ্যামিতিক নকশার মত গঠন , জামদানীর মতো ক্লাসিক  আধুনিক । পংক্তিগুলো গড়ে উঠছে শরীরের জটিল রেখায়  ক্রমবর্ধমান এক একটি ভিন্ন অবয়বের সুন্দরী রহস্যময়ী অধরা নারীর মতো । মেদহীন , ঝরঝরে , বুদ্ধিদীপ্ত কবিতার স্বভাব রোমান্টিকতা -
‘ পংক্তিগুলো বেয়ে উঠছে শরীরের টান টান জটিল রেখায়  
ক্রমশ  জ্যামিতিটুকু টানটান , উৎকন্ঠিত তোমার চিবুক ‘
নিঃসঙ্গতা বোধ কবির অন্যতম বোধ । অজানা এক বেদনায় মুক অথচ গভীর শব্দের স্ফুরন কবির মুক্তির পথ ।
“পাতালের হাতছানি ভারী  করে চোখের পাতাকে
নিরীহ জন্মের মতো আমার টেবিলে জেগে থাকে’
আমার টেবিল / পিরামিড সংসার ‘
কবিতা অহীর মতো । নাযেল হয় । আবার রহস্যময় মরিচীকার মতন । আসে মিলিয়ে যায় । অধরা প্রেয়সীর মতো সে ছুঁয়ে যায় , ধরা দিতে চায় না । আলো আঁধারী কুয়াশায় আচ্ছন্ন কবিতাই আরাধ্য হয়ে ওঠে । কবি তো কবিতার পথেই হাঁটতে চেয়েছেন । শিল্পী মাত্রই অতৃপ্ততায় ভুগেন । কবিও এর ব্যতিক্রম নন ।  যথাযথ শব্দ , বাক্য , কাব্যের অলংকার যেনো কবির কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে । ‘পিরামিড সংসার’ কাব্যগ্রন্থে কিংবা ‘অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে ‘ কাব্যগ্রন্থে কবির সেই হতাশা   ছুয়ে যায় । তবু কবি কবিতাকে ছেড়ে যান নি । কবি তো আসলে নিজেই কাব্যলক্ষী হয়ে পাঠকের ভেতরে আসন গেঁথে রাখেন । ।

‘তুমি নও , তোমার মতন কেউ , দূরে থাকে ঘরে থাকে
অংশত  লুকিয়ে থাকে ভাসমান বরফের মত
অথবা লুকিয়ে থাকে মলাটের ফিরোজা আঠায় ‘
পুনরাবৃত্তি / পিরামিড সংসার “

কেউ পায় তার দেখা
শুয়ে আছে ফুটপাতে মলাটবিহীন খুব একা “
‘কবিতা সংগ্রহ
পিরামিড সংসার ‘

সারিবদ্ধ ক্ষুধার্ত অক্ষর জমা হচ্ছে মাকরসার ভিতর ডিম “/                       কবিতা সংগ্রহ

ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় নৈরাশ্য অন্তর্মূখীনতা ,তিক্ততা একাকীত্ব বোধ কবিতাকে  দেয়  রহস্যময় ঘনত্ব । প্রতীক ছেয়ে থাকে মনোগহবরের নিরালোকে”
নৈরাশ্য এমন এক বোধ এ থেকে বেরুনো দুঃসাধ্য । আশার তরী থেকে বার বার ছিটকে পড়ে মানুষ । বেঁচে উঠতে চায় খরকুটো যা পায় তা ধরেই । তবুও মুক্তি নেই ।  নৈরাশ্যে জীবনের সাথে লেপ্টে থাকে । হতাশাবোধ আচ্ছন্ন করে ।
তীব্র হতাশাবোধ থেকে কবি উচ্চারণ করেন --
‘বোতামেরও ঘর থাকে
আমার তো হলো না কিছুই ।“
অথবা
‘নিজেকে গোছানো বুঝি এ জীবনে হলো না আমার “
কি যেনো পকেটে ছিলো
এখনো পাইনি খোঁজ পুরনো জামার “
পিরামিড সংসার / পুরনো জামা ‘

বিষাদ ও নৈরাশ্য আক্রান্ত কবি অন্তর্মুখী । মমির মত জীবন যাপন করেন । মমির থাকে না জীবনের চঞ্চলতা । স্থবিরতা শুধুই স্থবিরতা । গভীর হতাশা জীবনকে ঘিরে থাকে । যে জীবন হতে পারতো  পাখির মতো স্পন্দনশীল  সে জীবন আশাহীন মমি ছাড়া কিছু তো নয় । প্রাচীন মিশরীয়দের মতে মৃত্যুর পরেও মানুষ বেঁচে থাকে । কিন্তু সে বেঁচে থাকায় চঞ্চলতা নেই , নেই জীবনের অবিরাম স্ফুর্তি ।
‘ পাথরে শ্যাওলার মত পড়ে আছে মন
পিরামিড সংসারে বেঁচে আছি মমির মতন / পিরামিড সংসার ‘

“অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে’ কাব্যগ্রন্থে কবি হৃদয়ের ডাল পালা লতাপাতা আলো আঁধারী রহস্য নানা ভাবে বিচ্ছুরীত হয়েছে ।তার  বক্তব্য ঋজু , স্পষ্ট ,  হৃদয়স্পর্শী । কবি হৃদয়ের অস্থিমজ্জার  স্ফুরন টের পাওয়া যায় ।

পিরামিড সংসারে এসে কবি যেনো অনেকটাই শান্ত সংহত । কবির কল্পনা প্রবণ মন বিজ্ঞানমনস্কতাকে আঁকড়ে ধরে এগোয় প্রগতির পথে । কিন্তু কবির বাস মাটিতে হলেও অনুভব করেন এই অস্থায়ী পার্থিব জীবনের স্থুলতা ।

শোক , মৃত্যুচিন্তা মাত্রা পেয়েছে বৃক্ষ অথবা মানুষের এলিজিতে । সবিতা কবিতায় এসেছে নাগরিক জীবনে নারীর  প্রেমের নামে নির্যাতনের  বার্তা  । টুথপেস্ট ‘কবিতায় মানবিকতার নামে আজকের বিশ্বের নির্মমতার কথা মনে পড়ে যায় ।
“মানবতা কাকে বলে ছোটরা  জানে না ,
বড়রা দোকান থেকে প্রয়োজনমতো কিনে নেয়
টুথপেস্ট আর মানবতা “ ।
পিরামিড সংসার কবিতায় একাকী নিঃসঙ্গতার হাহাকারের শব্দ পাওয়া যায় ।
সমস্ত দিনের শেষে জামাকাপড়ের ভাঁজ থেকে ,নিজেকে আলগা করে দেখি ,খুব একা -

  যদিও বেঁচে থাকেন  সে যেনো প্রাণহীন ।
“এতোগুলো মৃত্যু গেঁথে থাকে বুকের ভিতরে তুই একা একা খুঁজছিস কাকে ?”
এবং মিলন চৌধুরী /পিরামিড সংসার
  ময়ুখ চৌধুরী রোমান্টিক কবি । তার  কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু প্রেম । সাহিত্যে প্রেমের কামনামিশ্রিত শরীর ,  চেতনাতপ্ত রূপ চিরকালই স্বীকৃত । কিন্তু শরীর কামনামাত্রই প্রেম নয় । তার শরীর মন বুদ্ধির সমুহ্নয়েই পূর্ণ ।
প্রেমহীন জীবনও কবির নয় । কবি প্রেমে পড়েন , বার বার পড়েন ,  ডুবে থাকেন এক অবিশ্রান্ত প্রেমের সমুদ্রে   । প্রেম , রমণী শরীরের প্রতি কাব্যময় শিহরনে কবি  লীন হয়েছেন  । কবির কাছে কাম ও নারী  অবিচ্ছেদ্য ।  পরম আরাধ্য নারীকে পেয়েছেন অথবা পান নি কিন্তু কবি হৃদয় আর শরীরের কামনা বাসনা লুক্কায়িত রাখেননি  । স্বাভাবিক ভাবেই  তৃষ্ণার্ত হয়েছেন । অনন্ত কামনা বাসনার নদীতে নিজেকে ডুবিয়ে  পবিত্র হয়েছেন । প্রেম তো আরাধনারও নাম ।
“ সারা দেহে জ্বালা ধরে জমে ওঠে লালা
তখনই পবিত্র হই
যখন তোমাকে দেখি আজও মধুবালা ‘
‘ দি মিথ অব মধুবালা / পিরামিড সংসার ‘
“জীবনের দুপুরবেলায় আবার পিপাসা লাগে
নরম নগ্নতা থর থর
ছোঁয়া লেগে কেঁপে ওঠে প্রবীন পাথর
নতচক্ষু হয়ে আজ দেখি
অনায়াসে ডুবে যেতে পারি “
ঝর্ণার দেখা /জারুলতলার কাব্য
নারীর শারীরিক স্পর্শে মোহগ্রস্ততা তৈরী করে । ইন্দ্রিয় ঘনিষ্ঠতায় মোহগ্রস্থ কবি নদী ,  নারী , দেশ প্রকৃতি ঐতিহ্য  প্রেম রসে সিক্ত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌছে যান লৌকিক থেকে অলৌকিকতায় , বাস্তব থেকে পরাবাস্তবে – অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতায় মোহগ্রস্থ কবি তার উঁচুমার্গের কবিতায় পাঠকের হৃদয়  ছুঁয়ে যান ।

“তোমার উন্নত গ্রীবা রজনীগন্ধার মতো  একদিন নগ্ন মনে হয়েছিলো
সে দৃশ্য প্রাক্তন আজ , গ্রীবাময় হৈম কারুকাজ “
রানী বিভাবতী / অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে
তবে যদি হও তুমি রাজহংসী
তবে আমি ঘুমভাংগা শংখচুড় আজ
তুমি রানী বিভাবতী , আর আমি কুমার সন্ন্যাসী “
অথচ এই অহংকারী অবিনীত প্রেমিকার কতটা কাছে ছিলেন , জমকালো অবজ্ঞার প্রসাধন  “ আজ সে প্রেমিকার সাজে সজ্জিত করেছে নিজেকে তার সকল গুপ্ত  রহস্য জানেন বলে কবি বঙ্কিম  হেসেছেন –
“ বলো কেন ?
আমি তো জানি
তোমার ওখানে একটা তিল আছে রাণী “
রানী বিভাবতী / অর্ধেক রয়েছো জলে অর্ধেক জালে
প্রেমের সাথে কাম স্থুল সুক্ষ্ণ দুভাবেই সংশ্লিষ্ট । কামজ ঘ্রাণ পাওয়া যায় “কাটা পাহাড় ‘ “রোহিনীর স্নান” কবিতায় ।
“এইসব দৃশ্যের আগুন নিয়ে একা জলাশয়ে
মাছের স্পর্শ পেতে রোহিনী রচনা করে অর্থহীন স্নান । “
নারী কবির কবিতার এক প্রধান অনুষঙ্গ । কবি ময়ুখের কাব্যের দুই প্রধান অনুষঙ্গ নারী এবং প্রেম । নারী এসেছে নানা রূপে নানা বর্নে ,  ঢং এ  , নানা ভাবনায় ।

‘সবিতা দেখতে ভালো
মানিপ্ল্যান্টের মত সতেজ , আর টগবগে
‘সবিতা নামের অর্থ ‘/ পিরামিড সংসার
‘ লজ্জাবতী নাম তার সম্রাজ্ঞীর বাগানে ফুটেছে ।
‘ সামান্য ছোঁয়ায় শরমে সে মরে যেতে চায় “
ক্রমশ লজ্জাবতী ‘ /পিরামিড সংসার
“যেনো তুমি অভিঘাতে রাজহংসী আজ
তোমার চোখের  সামনে সবকিছু খরকুটো
আর্শি ব্যাতিরেকে “

“ এভাবে তাকানো তুমি শিখলে কবে থেকে “
রানী বিভাবতী /অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে ‘

“উড়ছে মাতাল চুল ,এলোমেলো আঁচলের ঢেউ
লাবন্য ধরেছো নারী , সারা অঙ্গে তরঙ্গ প্রবণ “
তুমি কি মাছের বোন ?
আঙ্গুর চোরাবালি চরের নেশায়
মানুষের ছদ্মবেশে লোকালয়ে এসে
লতাগুল্মে ফেলে গেছো বরশীর মতন চাঁদ “

শরীর কামনার আধার হলেও প্রেম কামনা বাসনার উর্ধ্বে । যদিও শরীরকে আশ্রয় করে প্রেম বেড়ে ওঠে । কিন্তু একসময় তা হয়ে ওঠে অলৌকিক । প্রেম মানে তুমি , তুমি মানে আমি  । তাকে অস্বীকার করলে নিজেকেও অস্বীকার করা হয় ।
‘তোমার শরীর ছোঁয়া সরীসৃপ জল
সেই কবে শিখিয়েছে চিরায়ত প্রেমের কৌশল
সিন্ধু সভ্যতা / দুই পর্ব /অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে ‘

“আমি কাল চলে যাচ্ছি দেহটাকে নিয়ে যাচ্ছি
ছায়াটা তোমার কাছে যাক ( যাওয়া থেকে যাওয়া )
তবে প্রেমের কবিতা লেখলেও তার নিজস্ব  একটি দর্শন আছে।  একই সাথে মানবিক সংকটময় মুহুর্তের কবি বলা যায় তাকে , যার কবিতায় মুহুর্মুহু গল গল করে শব্দগুলো আর্তি করতে থাকে প্রায়শ ভিন্নতর ব্যঞ্জনায়। কাব্যে  নিছক প্রেম কিংবা ভালোবাসা নয় ,শব্দ আর চিত্রকল্পের  চেয়েও অধিক জ্ঞানী শব্দাংশ পরিপূর্ণ একটি বিশ্বাসের জোরে খাঁটি মানবিক  আত্মার নির্যাস রয়েছে। তার প্রেম কামনায় যেমন আছে দেহজ লতার সুঘ্রাণ তেমনি জেগে ওঠার অদম্য আকুতিও আছে।  

অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জলে ‘ কাব্যগ্রন্থে পূরান ,  ইতিহাস চেতনা , ঐতিহ্যপ্রীতি , মিথ , প্রেমের জন্য আকুতি , কাম একই সাথে সমান্তরালে চলেছে । ঘন বনের ভেতর সাদা বাড়ির রহস্যময়তা তার কবিতাকে ঘিরে রাখে –ইতিহাস চেতনায় কবিতাগুলো ভাস্মর অনন্যতায় ।  

“মহেঞ্জোদারোর এক জাতিস্মর প্রাচীন প্রেমিক
পাথরে খোদাই করে দুঃখ তার জমা রেখেছিলো “
কিংবা
“দ্বিতীয় বাল্মিকী নেই
তাই পাখিরা মিথুন লগ্নে মানুষের সামনে আসে না “
“তোমার কালিতে কালোর অনেক ঋন
কোন বনে আজ ঘুরিয়া বেড়ায় শকুন্তলার হরিণ “ ‘
তুমি ছিলে তুমি আছো
সেই কথা জানে দুষমন্তের আংগুরী গেলা মাছ ও
         বাল্মিকী ,কালিদাস, ভুসুকু/ অর্ধেক রয়েছি জালে অর্ধেক জলে “
, অস্থির সময় । সম্পর্কগুলো ক্রমশই পলকা হতে হতে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে ।
যুগ যন্ত্রনার শিকার কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না । দাম্পত্য সম্পর্ক খসে যায় , গভীর ভালোবেসে প্রেমে বিরহে  মাখামাখিতেও থাকছে না আর অনুবন্ধগুলো  । সংসারের আনুসাংগিক প্রয়োজনীয় সবই হয় কিন্তু সংসারটাই টেকে না ।
“ বিয়ে হয়ে গেলো
পেয়ারাতলায় ঘরবাড়ি
বিস্কুট প্যাকেটের খাট, পাতার সবুজ বালিশ
সন্ধ্যার আগেই জামাই বউতে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো ।
পুতুলের বিয়ে / পিরামিড সংসার
ময়ুখ চোধুরী কবিতার মধ্যে ব্যাপকভাবে সংলাপ , কথোপকথনের ভঙ্গি ব্যবহার করেছেন । এ থেকে যে সত্যটা উপলদ্ধি হয় তা হলো বহুমাত্রিক সংলাপধর্মীতা ।
আবার আত্বগত উচ্চারণ মথিত হয়েছে অনেক কবিতায় । অনেক কবিতায় এইসব স্বগত উচ্চারণ ডায়ালগ সদৃশ  ।  কবির হৃদয় উৎসারিত আবেগ মননের বহিপ্রকাশ কিন্তু কোনো প্রতুত্তরের প্রত্যাশা নেই । স্বগত সংলাপের প্রভাব ময়ুখের কবিতায় পাওয়া যায় । স্বগত উচ্চারণের পাশাপাশি সত্যিকার ডায়ালগ ও কথোপকথন ঢুকে পড়েছে তার কবিতায়  -

“ দুপুরবেলায় খাবার বেড়ে গিন্নী আমায় ডাকতে এল পুকুরপাড়ে
ভাত খাবে না ? বলার আগে বললো হেসে – বয়স কতো ?
উত্তরে তার বলতে পারতাম
পুকুরপাড়ে বয়স বারো ‘’
“নদী পাথরের গল্প’/‘অর্ধেক রয়েছি জালে অর্ধেক জলে ‘

‘যা উড়ে যা উড়ে যা বনিকবাড়ির ঝি
নাইওর এলে আমার নায়ে উঠিস
ফিসফিস করে বলিস একটিবার
কেমন আছিস মাঝি ?
“সোনা মাঝির ঘাট’/ অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে ‘
স্বগত সংলাপ’
লবনাক্ত মানুষের মতো
কতোরাত ঘুমিয়েছি পাথরের বুকে মাথা রেখে
তা বলে ইর্ষায় চাঁদ সেই থেকে পাথর হয়েছে ‘
বনানী গিয়েছে বলে কাল রাতে খুব একা একা
কথা ছিলো কার সাথে তার ?
শেষ দেখা আহা শেষ দেখা
হয়নি তো তার সাথে , কারো সাথে
শুধু বেদনার লতাপাতা ‘
বনানী গেছে বনে ‘/ অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক  জালে “

ময়ুখ চৌধুরী নিজস্ব কাব্যভাষা  ও নতুন শিল্প  নির্মাণে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। চিত্রকল্প নির্মানে তিনি যে দক্ষ কারিগর সে নতুন করে বলার নেই   । চিত্রকল্প নির্মিত হয় কল্পনার বস্তুকে নতুন শব্দযোজনায় কল্পনার রঙে  চিত্রিত  করে । নতুন চিত্রকে নতুন শব্দে  নান্দনিকতার সাথে উপস্থাপনে পাওয়া যায় কবির স্বাভাবিক সৌকর্য  । শ্রেষ্ঠ চিত্রকল্প শ্রেষ্ঠ কবিতা নির্মানের প্রাথমিক ভিত্তি বলা হলেও বেশী বলা হবে না ।
“ কি জন্যে দৌড়াচ্ছ এভাবে !
তুমি কি পালাচ্ছ নাকি ছুটে যাচ্ছো ? লাটাইয়ের টানে
বাড়ি যাচ্ছ ? – কেন যাচ্ছ , কি আছে ওখানে !
ট্রেনের ছাদে বাড়ি যাওয়া দেখে / পলাতক পেন্ডুলাম

“ বন বিভাগের রাস্তা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ফুটপাতে , ব্যাপার তেমন কিছুই নয় । গতকাল শেষরাতে মারা গেছে উলঙ্গ পাগল । “
মৃত মানুষের কাছে লজ্জা ঢাকা / পলাতক পেন্ডুলাম “
“খাটিয়া বহন করতে যেয়ে
নুইয়ে যাচ্ছে এতগুলো বলিষ্ঠ শরীর
“লোককথা ‘/পিরামিড সংসার

মূলত ত্রিশের স্বভাব তার মর্মগত। ময়ুখ চৌধুরী আধুনিক কবি কিন্তু ঐতিহ্যচেতনা তার বেশীর ভাগ কবিতাকে করেছে ঋদ্ধ ।  । অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাতেই কবি পূরান , চর্যা আর মধ্যযুগের আলো আঁধারীকে মর্মে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়েছেন ।। প্রাচীন ভারতবর্ষ এবং প্রাচীন বাংলার বাকচিত্র এখানে চাঁদের আলোর মতই মসৃন মায়াময় । প্রাচীন মহেঞ্জোদারো , ফুল্লরার সংসার , ঈশ্বর পাটনী অলঙ্করণ পদ্ধতিতে স্পষ্ট করেছেন প্রাচীন বাংলার সাহিত্য  এবং ঐতিহ্যকে ।
“ আষাঢ় শ্রাবণ দুই চোখে
বয়ে যাক বেহুলার নদী
ভাসান লাশ নিয়ে
তুমি চলে যাও নিরবধি
“আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে / অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে “
“দেবতার ঘরে বসে লেখা এক নিয়তি নাটক  
সংসার শ্রমিক কাজে দায়বদ্ধ সূত্রধার
অবিচারে ফুঁসে ওঠে আজও কালিন্দীর বোবা জল
কাহার গাভীর দুধ পান করে সাপ নিশিরাতে ‘
আইহন গোয়ালা / অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে

“ফুল্লরা বৌ ফুল্লরার বৌ গাঁও গেরামের ঝি
তোমার নাতি গঙ্গা ঘাটে ঈশ্বরিনীর মাঝি “
“ঈশ্বর পাটনীর সংসার / অর্ধেক রয়েছিজলে অর্ধেক জালে “
একই সাথে সমাজের শোষণ বঞ্চনার চিত্র অনবদ্য ভাবে এসেছে । গরীব সকল সময়ই নির্যাতীত । প্রাচীন বাংলায় কিংবা আধুনিক সভ্য সমাজেও একই ভাবে গরীব ইশ্বরের আশির্বাদ পুষ্ট হলেও তার ভাগের চিড়ে ধনীর পাতেই পড়ে ।
‘দেবী দিলো পয়সা বিনে  ঈশ্বরীরে বর
দুধ মাখা ভাত কাকে খেলো সন্তানেরা মর “
“ঈশ্বর পাটনীর সংসার / অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে “

নাগরিক জীবনে , আধুনিক মিডিয়া নারীকে আরো বেশী নির্যাতনের মুখোমুখি করে । নারীর নির্যাতন একই থাকে কিংবা বেড়ে যায় । নির্যাতনের ধরনের পরিবর্তন হয় ।
“এমন সময় চারজন যুবক
তারপর অজানা অচেনা একটা ঘর
পরপর চারজন যুবক
সংবাদপত্রের খাদ্যে পর্যবসিত করলো সবিতাকে “
সবিতা নামের অর্থ / পিরামিড সংসার

মৃত্যুচিন্তা থেকেও কবি পালাতে পারেন নি । মৃত্যু কবিতার আর এক অনুসংগ ।
তার অনেক কাব্যেই মৃত্যুচিন্তা এসেছে প্রাসংগিক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে  ।
“ঘুমের সাদা বাড়ি , মানে সাদা বাড়ি । সেই বাড়ির শাদার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে কালো মানে অন্ধকার ঘুম । আলখাল্লা ফাঁক করে ঢুকে পড়ে সকালের রোদ । স্পষ্ট শাদা জাগরণ । গতরাতে বিছানা থেকে উঠে আসে খবরের কাগজ । কালো কালো পোকা থেকে স্পষ্ট শাদা নড়াচড়া ।“
কিংবা
“যাবতীয় শাদা হিশাবনিকাশ ঝিমিয়ে পড়লে
প্রচন্ড ভারি কালো একটা ঘুমকে পড়ানো হবে শাদা জামা “।
একটা খাটিয়া নামানোর জন্য ক’জনকে কষ্ট দেবো ! তাই / পলাতক পেন্ডুলাম

মরে যাওয়া মানেই তো চলে যাওয়া । আর এই পৃথিবীকে না দেখার আফসোস । তার চাইতেও বেশী আফসোস প্রিয়জন রেখে যাবার বেদনা ।
মানুষ আসবে যাবে , এই  আমি আর আসবো না “
অথচ তখনো প্রিয়তমাকে নিজের করে রাখার বাসনায় মরেও যেন শান্তি নেই
“ একদিন থাকবো না , তাই
তোমার সারাটি অঙ্গে চুম্বনের প্রহরী বসাই ।
পূর্ব প্রস্তুতি / পলাতক পেন্ডুলাম

কবি বেঁচে থাকতে চান প্রিয়তমার মাঝে ।   মৃত্যুর পরেও নিজেকে দৃশ্যমান রাখতে চান প্রেমিকার শরীরে ।
“ তোমার প্রতিটি মোড়ে প্রহরী চুম্বন ছাড়া আর কেহ নাই
এইভাবে থেকে যাওয়া “
পূর্বপ্রস্তুতি / পলাতক পেন্ডুলাম
“আমাদের সমুদ্র সাময়িকী ‘ কবিতায় প্রকৃতিকে কবি একটা স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোন থেকে দেখেছেন । প্রকৃতির প্রতি আবিষ্ট মুগ্ধতা থেকে সরে এসে তাকে দেখা যায় ভিন্ন অবয়বে  --  
“নদীর তীর ধরে হেঁটে যাওয়া লাঠির মত সতর্ক ,সরল
অতএব পাখির ওড়াওড়িকে মনে হচ্ছিল ছেঁড়া পলিথিন । “

কবি ময়ুখ চৌধুরীর কাব্য ভাষা যে খুব  স্বতন্ত্র তা নয় । কিন্তু  তার কবিতার  প্রেম  রোমান্টিকতা নান্দনিকতার সাথে জায়গা করে নেয় পাঠক হৃদয়ে । টের পাওয়া যায় দীর্ঘদিন  আড়ালে আবডালে  থাকা কবির শক্তি । তার বাকরীতি সংক্ষিপ্ত , নিগূঢ় অথচ অর্থবাহী ।  কাব্যভাষায় , শব্দনির্মাণে অভিনবত্ব  , প্রতীক, উপমা তাকে চিনিয়ে দেয় জাত কবি হিসেবে । শব্দের খঞ্জনীতে তিনি যে ছন্দ লয় নিয়ে আবির্ভাব হন তার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে কালান্তরে । সংকোচহীন ভাবে কবি ময়ুখ চৌধুরীকে বলা যায়  বাংলা সাহিত্যের   মেধাবী কবি  ।