আমার চশমার কাচে ইদানীং ভয়াবহ গন্ডগোল। দূরের অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই যেন বেশি বেশি স্পষ্ট দেখতে পাই অথচ চোখের কাছেই পড়ে থাকে প্রয়োজনীয় সব দৃশ্যমান বস্তুসমূহ।চশমার কাচে ঢুকে গেছে কতসব জঞ্জাল, কি সব আজেবাজে ছবি।
এক আকাশ সর্বনাশ হাতের মুঠোয় নিয়ে পাশের বিল্ডিং এ ই একটা হাভাতে মেয়ে সুখী হয়েছে দেখলাম। আগুনের ঝাঁপি খুলে আত্মসমর্পণে টালমাটাল এক মাতালের শরীরে দেখলাম চার ফোঁটা শিশির গড়িয়ে পড়ল, মাতাল তবু নির্বাক। কখনো দেখি ঘর আছে জানালা নেই অথচ বিশাল এক মহাশূন্য খুলে বসে আছে মুগ্ধ কিশোর। কখনো কখনো আবার দেখি পদ্মপাতায় অফুরন্ত মৃগয়া। বহুদূরে পৃথিবীর কোন এক অজানা প্রান্তরে একদিন দেখলাম ভিখিরির দু'পয়সার মত সস্তা সংসারে এসে বসেছে ঝাঁকঝাঁক নীল প্রজাপতি। এক বিজিত সৈনিক যুদ্ধে সমস্ত সৈন্য পেয়েছে এক মোহিনী ঘরের হৃদয় থেকে, তবু সেই সৈনিক কোন এক লেবুপাতার সৌরভে গন্তব্য ভুলে কোথায় যে চলে গেল। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেই ঘর সমস্ত অন্ধকার, কুয়াশা আর দুর্যোগ সরিয়ে সম্পূর্ণ ব্যথিত রাস্তায় বিজয়ের প্রদীপ জ্বালিয়েছে একাকী।
আমার চশমার কাচে কি সব লণ্ডভণ্ড রোদ, এলোমেলো রঙ আর কেমন সব আঁকাবাঁকা ভাঙাচোরা পথ। চশমার ডানচোখের কাচে নক্ষত্রের ক্যামেরা আছে একটা, বামদিকে সূর্যবসানো দূরবীন। এগুলো নিছক গণ্ডগোল শুধু। আমার চশমার কাচগুলো সত্যিই এখন কেমন গোলমাল করতে থাকে। চশমার মধ্যে অসংখ্য ঝোপঝাড়, মাঝেমধ্যে কেমন অরণ্য হয়ে ওঠে সবকিছু।
একদিন দেখলাম ধ্রুবতারাকে ভালোবেসে ঝড়ে জলে ডুবে গেলো এক নবীন জাহাজ। অনেক রঙীন পট নিয়ে জন্মানো প্রতিমা কোন দুঃখে যে সাদাকালো বেশবাস বেছে নিলো তাই দেখে আমার মনে হলো আমার চশমার কাচ তছনছ করে বুঝি চোখে ঢুকে গেলো কতগুলো আগুনের মতো হলুদ ফুলকি। নিভৃতে সাজানো ছিল এক রমনীর সতের বছর বয়সী ভালোবাসা, সেখানেও দেখলাম রক্তাক্ত সিঁড়ি নেমে গেছে বুকের গভীর পাতালে। বেশি তাকাতে গেলেই আরো বেশি গোলমাল বেঁধে যায় চোখে। অথচ আমার চশমাটাই মনে হচ্ছে যত গোলমালের মূলে। নয়তো আমি কিভাবে দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে এক ছোট্ট শিশু লজেন্স পেয়ে গেলে যেরকম হাসে, একটা আমড়া বিক্রি করতে পেরেই সেইরকম হেসে রূপোলি দাঁত দেখিয়ে সমাজকে হিসহিসিয়ে বলে গেলো, তার চোখে নাকি এক অগ্নিকুণ্ড থেকে অন্য অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইতিহাস লেখা আছে, চাইলেই পড়ে ফেলা যায়। আমি বাসায় বসে কত বই পড়ে ফেলি কিন্তু সেই ইতিহাস পড়তে পারলাম না। আমার চশমার কাচ বড্ড সেকেলে আর একগুঁয়ে। পড়তে দিলোনা কিছুতেই।
শীতের এক ঘোলা বিকেলে দেখেছিলাম বাইশ বছরের এক যুবক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আগুন অন্ধকার এক ঝুমকো জবা নদীকে। ভুরু কুঁচকে বিরক্ত সেই সরল নদী বিশ্বাস করেছিল সেই প্রতিশ্রুতি। ট্রেনের হু হু ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গেল সেই প্রতিশ্রুতি ওরা কেউই জানেনা। সভ্যতার বিরুদ্ধে গিয়ে নদী শুকিয়ে লুকিয়ে গেলো, তবু প্রতিশ্রুতি রাখতে পারলোনা সেই যুবক। এখন যুবকের গায়ে দুঃসময়ের দুর্গন্ধ। আমি প্রায়ই দেখি নদী ঘাড় গুঁজে নষ্ট জলরেখা নিয়ে শুয়ে বসে থাকে, আর আমার চশমা চোখ জ্বালিয়ে, সাগর -অরণ্য, পাহাড় ডিঙিয়ে কি সব দৃশ্য নিয়ে আসে আমার সামনে।
আরেকবার দেখলাম লাল শাড়ির এয়োতী রঙ নিয়ে নতুন বউ কিভাবে যেন পুরনো নারী হয়ে গেল, পুরনো মেঘ বৃষ্টিতে ভাসতে ভাসতে সেই পুরনো নারী তার স্বামীকে তার সংসারের মাঠে আরেকটু লাল এয়োতী রঙ আনতে দেখল। তারপর সেই পুরনো নারী বনবাসী হাওয়ার হাতছানিতে যুবতীর ভঙ্গিমায় মৃত্যুর সংসারে প্রতিমা হয়ে গেল।
বাইরে যখন সূর্যকিরণে জেগে ওঠা সকাল তখন আমি দেখি যে পাখি উড়তে ডানা মেললো তার পালকে, ডানায় রক্ত লেগে আছে।
ফাল্গুনের অহংকারী বনভূমিও অরণ্যের অধিশ্বর হৃদয়ে বসতি গড়তে গিয়ে তুমুল ভাঙচুর নিয়ে সবকিছু ছিঁড়েখুঁড়ে বালিশে চোখের জল চাপা দেয়, আমি দেখেছি।
এসব দেখতে দেখতেই আমি পৌঁছে যাই এমন সব শীতের রাতে যেখানে পৃথিবীর সমস্ত ফাল্গুনই পৌঁছাতে পারে শীতকালের হিম হওয়া দিন রাত্রি অতিক্রম করে।