আমি জেসমিন,
চলমান শতাব্দীর তোমাদেরই একজন,
অথচ আমাকে আর কেউ চিনবে না,
কোর্ট এফিডেভিটের মাধ্যমে নাম বদলে
একটা ফুলের নাম নিয়েছি।
কারণ আমি, আমার পূর্ব নামের দুর্গন্ধে
অসহনীয় হয়ে উঠেছিলাম!
আমার প্রিয় ফুলের নামে তাই নাম দিয়েছি– জেসমিন,
শুধু কলঙ্কিত পরিচয়টা আড়াল করতে!
এখন আমার একমাত্র পরিচয়– আমি 'জেসমিন'
এর বেশি কিছু জানতে চেয়ো না কেউ!
আমি এখন পলাতক,
ভিটেমাটি ছেড়ে এই শহরের
অচেনা মুখের ভিড়ে
সাত বাই আট একটা স্যাঁতসেঁতে রুমে
নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি,
একটুখানি নিরাপদ নিঃশ্বাসের আশায়।
বহুদিন দম বন্ধ পরিবেশের বন্ধ কয়েদখানায়
আমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম
শোষিত বঞ্চিত হয়ে,
আমার সমাজ, আমার সভ্যতা, আমার পরিজন
কেউ আমার বাকরুদ্ধ গুমোট কান্না শোনেনি,
তাই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছি!
এখন আর জানালা খুলি না,
স্বচ্ছ আলোর সাথে অস্বচ্ছ বোঝাপড়ার চেয়ে
অন্ধকার ঢের ভালো।
অন্ধকারে বুকে মুখ লুকিয়ে
একটু কাঁদতে পারি বলেই
বাঁচার নিঃশ্বাসটাও নিতে পারি,
নিঃসংকোচে অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলতে পারি,
একাকিত্বে মাথা গুঁজে শান্ত হতে পারি!
যে আলোর সভ্যতা আমাকে আড়ষ্ঠ করেছে,
বাকরুদ্ধ ও শিহরিত করেছে,
সে সভ্যতা ছেড়ে আমি
একা এই অচেনা শহরে!
জানো, আমিও আলোর সারথি হতে চেয়েছিলাম,
স্বপ্ন দেখেছিলাম আলোকিত মানুষ হওয়ার,
যখন অন্ধকার ছিল আমার আতঙ্কের রঙ!
এখন আমি অনেক বদলে গেছি,
বদলে গেছে আমার নাম, আমার পরিচয়,
আমার ঠিকানা,
সঙ্গে আমার স্বপ্ন আমার পছন্দ আমার আকাঙ্ক্ষা সব!
এখনো তোমরা আমাকে চিনতে পারোনি,
আর চিনতে পারোনি বলেই তোমাদের উদ্দেশ্যে
নির্ভয়ে লিখতে পারছি আমার না বলা কথাগুলো।
আমার পূর্ব পরিচয় আমি ভুলে যেতে চাই–
তাই জানতে চেয়ো না আমি কে,
কি আমার পরিচয়?
শুধু এটুকু মনে করিয়ে দিচ্ছি–
কিছুদিন আগে কোন এক কলেজ ছাত্রীর
বাড়িতে না ফেরার যে খবর
চারদিকে হৈহৈ রই রই ফেলে দিয়েছিল,
যার ছবিসহ সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতা,
দূরদর্শনের পর্দায় একটা ছবিসহ নিখোঁজ খবর–
মনে আছে?
অবশ্য তোমাদের আন্দাজ করতে
একটু কষ্ট হবে,
কারণ এমন ঘটনার পরম্পরা অব্যাহত,
টুকরো খবরে অথবা শিরোনামে
খুন, গুম, ধর্ষণের!
প্রতিদিনের সংবাদে যে খবর শিরোনাম আসে
সেটা ভুলিয়ে দিতে আসে আর এক
মর্মান্তিক হাড় হিম করা শিরোনাম,
তাই ভুলে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়!
এখন আমার ঘটনার বয়স চার মাস
আন্দাজ করি ভুলে গেছো সবাই,
কেউ কেউ মনে রাখলেও
বাস্তবে আমি অস্তিত্বহীন,
আর সেই সুবিধায় আজ জেসমিন লিখছে
তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেই দুর্ভাগ্যের কথা!
যে বিচার চেয়ে, পেয়েছিলো হুমকি
পরিবারের মৃত্যুর বিধান,
যার মা বাবা বাধ্য হয়েছে মুখে খিল দিতে
সমাজ সংসারে যাকে নষ্টা বলে উপহাস করলো–
দেহ ব্যবসায়ীর তকমা লাগালো!
কলেজ থেকে উধাও হওয়ার ঘটনাটাও
সাজানো নাটকে পরিণত হলো!
'বাবা মায়ের মদতপুষ্ট আমি' –
ছিল যা পুলিশের ভৎর্সনা,
রাজনীতির কাছে ঘটনার চাপানউতোর!
আহ্! কি দুর্বিষহ যন্ত্রণা,
বোবার মত সহ্য করেছি–
আমার জন্য আইন ছিল না, সমাজ ছিল না,
সংবাদমাধ্যম, পুলিশ, প্রশাসন কেউই ছিল না!
যা ছিল তা মিথ্যা প্রচার!
পুনরায় নগ্ন করার সুচারু পরিকল্পনা,
ধনাঢ্য বাকবিতণ্ডার নিষ্পেষণ,
আর গরিবী'র পূর্ণচ্ছেদ নিপীড়ন!
হুমকি-ধমকি, টাকার প্রলোভন আর মিথ্যা অপবাদ
শেষমেষ বইয়ের ব্যাগে ভরে নিয়েই
চলে এলাম এই অচেনা শহরের
ঘিঞ্জি একটা স্যাঁতসাঁতে ঘরে,
সভ্যতার মুখোশমুখে ছুঁড়ে ফেলে আমার
জেগে দেখা স্বপ্নের পাঠ্যতালিকা!
এখন কেমন যেন নিজেকে বড়ো রুচিহীন মনে হয়,
মনে হয় এমন একটি কদর্য সমাজে
কেনই বা জন্ম হলো আমার?
এখন রোজ নিজের সাথে নিজে কথা বলি,
নিজেকে সান্ত্বনা দিতে দিতে
আড়াল করি
সর্বাঙ্গে থাকা ক্ষতচিহ্ন গুলো!
আচ্ছা তোমাদের কাছে কি একটা প্রশ্ন রাখতে পারি?
যদি উত্তর হ্যাঁ হয়
তাহলে বলবে, এ লজ্জা কি শুধু আমার?
নাকি তোমাদেরও?
পাশবিক বলাৎকারের পর
মুখ বাঁধা অবস্থায় দুইদিন পর
যারা আমাকে মার্সিডিজ গাড়ি থেকে
তোমাদের সমাজে ছুঁড়ে দিয়ে গেছে,
তাদের প্রত্যেককেই আমি চিনি!
অথচ তাদের নাম বলতে পারি না,
তারা অপরাধী বলতে সাহস পাই না,
প্রাণভয়ে আমি চুপ হয়ে গেছি,
ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্ধকারে মুখ লুকিয়েছি,
লালিত সব স্বপ্নের জীবন্ত কবর দিয়েছি!
শেষমেষ নিজের মৃত্যু আমি
নিজেই ঘোষণা করেছি,
তবু বলতে পারিনি আমি বিচার চাই,
আমার সর্বনাশের বিচার চাই,
কেন বলতে পারো– আমার সুজনেরা,
আমার প্রিয় দেশ, প্রিয় দেশের মানুষ,
কেন? কেন? কেন??