~ প্রতুল মুখোপাধ্যায়' কে।
একটা লোক ছিল—
সে গান গাইত।
তার গলায় ছিল নদীর কলতান,
আকাশের ডাক, বাতাসের শিস,
মাটির ঘ্রাণ, রক্তের গর্জন।
সে গাইত বৃষ্টি নামলে,
গাইত খরার দিনেও।
মাঠের ফাটলে তার গলা বেজে উঠত বজ্রের মতো,
শ্রমিকের হাতুড়ির শব্দে সে গেঁথে দিত সুর।
তার কণ্ঠে ধরা থাকত পথের ধুলো,
গলির নর্দমা, শহরের পিচঢালা পথ।
তার গানের শব্দে কাপত রাজপ্রাসাদ,
কিন্তু সে থামত না।
সে ছিল এক ভবঘুরে—
শহর-গ্রাম মাড়িয়ে হাঁটত একা,
হাতে একখানা পুরোনো বাঁশি,
গলায় গাঁথা প্রতিবাদের মালা।
সে গাইত, যখন মাঠের ফসল পুড়ে যেত,
গাইত, যখন শ্রমিকের ঘর ফাঁকা থাকত,
সে গাইত, যখন বিচার চাইতে গিয়ে রক্ত ঝরত রাস্তায়।
তাকে ভালোবাসত পথশিশুরা,
তার গানে সুর মিলিয়ে নাচত কারখানার মজদুর,
শস্যের সাথে দুলে উঠত কৃষকের বুক,
তাকে চিনত নদীর স্রোত,
তাকে ডাকত অরণ্যের বিহঙ্গ।
কিন্তু তাকে ভয় পেত রাজা,
তার গানের কথা ছিল বিদ্রোহের স্লোগান,
তার সুর ছিল এক অগ্নিশিখা,
যা পুড়িয়ে দিতে পারত সিংহাসন।
তার কণ্ঠে ছিল না কোনো মধুর রাগিণী,
সে শিখেছিল সুর পথে-প্রান্তরে,
মজুরের ঘামে,
দুপুরের পুড়ে যাওয়া রোদে,
রাতের শীতল শিশিরে,
ক্ষুধার্ত বাচ্চার কান্নায়,
আর বন্দুকের গর্জনে।
সে জানত—
গান কেবল বিনোদন নয়,
গান এক শপথ,
গান এক যুদ্ধ,
গান এক প্রতিজ্ঞা!
তার সুর ছিল
মাটির প্রতিশ্রুতি,
কৃষকের বীজ বপনের গান,
জেলে-মাঝির পাল তোলার গান,
মজদুরের ঘাম শুকানোর গান,
বিপ্লবীর মৃত্যুর গান।
একদিন তার গানের শব্দ শাসকের দরজায় এসে আঘাত করল,
সেই রাতেই নেমে এলো নীরবতার সৈন্যদল।
তাকে ধরে নিয়ে গেল নগরের কারাগারে,
তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হলো শিকল,
তার মুখে চাপা দেওয়া হলো রাষ্ট্রের মোটা কাপড়।
শহর নিস্তব্ধ,
শুধু গুঞ্জন,
"সেই গায়ক আর নেই!"
কিন্তু হায়!
গান কি কখনো মরে?
গানের তো মৃত্যু নেই!
কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে
সে বসে রইল চুপচাপ,
তার চোখের তারা নিভল না,
তার বুকের ভেতর গান জমতে লাগল,
আগুনের মতো,
বজ্রের মতো,
প্রলয়ের মতো!
সে বন্দী হল,
কিন্তু বাতাস তো মুক্ত!
নদী তো মুক্ত!
কৃষকের হাত তো মুক্ত!
তাদের বুক চিরে গান বেরিয়ে এলো,
তারা বলে উঠল—
"শিকল পড়েছে তার গলায়,
কিন্তু আমাদের কণ্ঠ মুক্ত!"
তারপর একদিন কারাগারের দেওয়াল ফুঁড়ে
তার গান বেরিয়ে এলো বাতাসে।
খড়ের ঘরে, ঠান্ডা শয্যায়,
দগ্ধ মাটিতে, রক্তাক্ত বুকে—
সেই গান এখনো বাজে।
কারো কণ্ঠে শিশুর কান্নার মতো,
কারো কণ্ঠে বজ্রবিদ্যুতের ঝাঁজ,
কারো ঠোঁটে উদাত্ত শপথ হয়ে,
কারো হাতে প্রতিবাদের লাল পতাকা হয়ে।
সে গান ছুটে চলে রাজপথে,
সে গান জাগিয়ে তোলে নিঃস্ব কৃষকের ঘুম,
সে গান আছড়ে পড়ে রাষ্ট্রের কপালে,
সে গান বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
আজও যদি রাত গভীর হয়,
আর বাতাস ভারী হয়ে আসে,
তখন শোনা যায় সেই সুর—
একটা বাঁশির ডাক,
একটা কণ্ঠের বিস্ফোরণ।
"আমি এক যাযাবর,
আমি সুরের সন্ন্যাসী,
আমার দেশ এই ধুলো-মাটি-আকাশ,
আমার গান মানুষের মুক্তি!"