আর মাত্র দুদিন। এরপর প্রেমিকের জন্মদিন।
প্রতিবারের মতো ঠোঁটের নকশা আঁকা,
কয়েক পৃষ্ঠার পত্র লিখা,
এবার বোধহয় ঠিক হবে না ।
তার উপর দিন শেষে , মেয়ে মানুষ মানে কঞ্জুস,
এমনটাই ভাবে পুরুষ ।
রাজীব ছেলেটা অবশ্য ভালো-সরল মনের
শুধু একটু 'বলদ' টাইপের।
তা না হলে কি প্রতি মাসে, টিউশন ফি জমিয়ে
আমায় নিত্য নতুন গিফট দিত কিনে!
"আপু এই মডেল টা দেখেন
একেবারে ব্র্যান্ডের ইমিটেশন। যদি নেন
শুধু আপনার জন্য সাড়ে চারশ রাখব। "
'কুল ভয়েস রক স্কুল' লেখা টি-শার্ট পড়া
ছেলেটার কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম । ভ্রণ এ ভরা
গালে, এক চিলতে হাসি নিয়ে
আমার উত্তরের অপেক্ষা করছে সে।
হু ! যুগ যুগ ধরে তো আমার পা ধুয়ে পানি খেতে তুমি, তাই না? শুধু আমার জন্য সাড়ে চারশ !
যেন আমি কত পরিচিত। আহ ! কি ঢং !
মনে মনে যাচ্ছে তাই বিরক্ত হলাম। তবু মুখে ফুটতে দিলাম না। লোকে ঠিকই বলে : মেয়েদের চেয়ে ভালো অভিনয় কেউ জানে না।
"ভাইয়া ২০০ তে হলে নিতে পারি দুই পিস নিব চারশ টাকা। পারবেন না?"
শেষটা একটু শ্লেষ, আবেগ, জড়ানো কন্ঠে বলি। কারণ ইহা ম্যাজিক এর মত কাজ করে জানি। বিড়ম্বনায় পড়ে গেল ছেলেটা। গালের ভ্রুনে হাত রেখে বিষন্ন মুখ করে কিছুক্ষণ ভাবল । তারপর বলল , "আপু আর ৫০ টা টাকা দিয়েন নইলে লস হয়ে যাবে। মালিক বকবে।"
মুচকি হাসি ফোটে আমার ঠোঁটে।
দুদিন কেটে গেছে। বসে আছি পার্কে। পাশে বসা রাজিব। ওকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। প্রথমে আমাকে খুব ভর্ৎসনা করে : কেন এত দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি কিনতে গেলাম ওর জন্য ? কি দরকার ছিল ! আবার ঠিকই ঘড়িটা বক্সসহ অত্যন্ত যত্নে আগলে ধরেছে, যেন ভয় পাচ্ছে : যদি পড়ে ভেঙে যায়। আহারে! কত সহজ-সরল ছেলেটা। মনে হচ্ছে ছোট্ট খোকা!
বক্স থেকে চিরকুট টা বের করল সে। পরম তৃপ্তি নিয়ে পড়ছে। বোধ করি জীবনের সবচেয়ে সুখময় মুহূর্ত পার করছে। আমিও কৃত্রিম লজ্জার আড়ালে ঢাকি নিজেকে দু হাতে । চিঠিখানা পড়া শেষে রাজিব নিজেই আমার লজ্জা ভাব ভাঙ্গাবে : এমনটাই প্ল্যান। তা, এক মিনিট.. দুই মিনিট.. ধীরে ধীরে পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেল । অগত্যা আমি নিজেই আমার কৃত্রিম লজ্জা ভেঙে, সত্যিকারের রাগ বিরক্তি নিয়ে,ওর দিকে তাকাই। 'ছোট্ট খোকা' দুহাতে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বসে আছে। ওরে আমার লজ্জাবতী ! চিঠি পড়ে উনি দেখি লজ্জা পাচ্ছেন। নাকি আনন্দে কেদে দিয়েছেন ? একপ্রকার ক্ষোভ নিয়ে কনুই দিয়ে রাজিবের পিঠে একটা কিল দেই। কোন নড়াচড়া নেই। কিরে! মরে গেল নাকি? আবার কিল মারি। এবার আগের চেয়ে জোরে। কাজ হয় । রাজীব আস্তে আস্তে মাথা উঁচু করে। ওর চোখ মুখ দেখে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের দাগ স্পষ্ট, যেন বিষন্নতার বন্যা, আবার সেই চোখে এক আশ্চর্য দৃঢ়তা! কিছু না বলে সে উঠে দাঁড়ায়। কয়েক কদম সামনে গিয়ে ঘড়ি-বাক্স মাটিতে ফেলে এবং পা দিয়ে পাড়ায়। তারপর হেঁটে মেইন রোডের দাঁড়ানো লোকাল বাসে উঠে পড়ে। বাস ছেড়ে দেয়।
আমি পেছন থেকে দুবার "রাজিব!" " কি হয়েছে, বলো?" ডাকলেও সাড়া দেয়না। তৃতীয়বার ডাকবো: এমন সময় চোখে পড়ে বেঞ্চে থাকা চিরকুটটা। কি মনে করে হাতে নেই । অনেকটাই ভিজে গেছে জলে। সম্ভবত চোখের পানি, তবু শেষ লাইন এ, নিজের অস্পষ্ট লেখাটা আমি পড়তে পারি,
"ভালোবাসা নিও
আমার একমাত্র প্রিয়
আবিদ আহসান নিলয়।"
আরে বেচারা! অযথা কিল টা মারলাম। মনে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে! আমিও না, কি যে করি, দিলাম তো ভুল ঠিকানায় চিঠি!
সে যাই হোক, একটা গেছে প্যারা নাই : আরেকটা গরু তো আছে! ওইটাকে কোনভাবেই কিল মারতে যাব না।