কেমন আছিস দাদুভাই আমার...???
ক্ষীণ কণ্ঠে ফোনে, কাঁপা কাঁপা স্বরে,
আশি ঊর্ধ্বো বৃদ্ধার চেনা কণ্ঠ-
কালের আবর্তে যেন
অচেনা মনে হয় ।

এখনও পারেনি রিপু নিতে কেড়ে
প্রাণবায়ুকে, টিকে আছে আজও
শেষ দেখার আকুল অভিলাষে
প্রতি মুহূর্তে হাজারো মরন রিপুর সাথে
অক্লান্ত যুদ্ধ করে ।

কত তেজস্বিনী ছিল আমার শৈশবে,
মাত্র এক চোখ রাঙ্গানীতে খেতে বাধ্য হতাম-
পুরো ভাত আর সম্পূর্ণ গ্লাস দুধ,
না খেয়ে উপায় কি? সে যে ভীষণ রগচটা-
ক্রোধে যেন অনল জ্বলত প্রতিক্ষণ-
আমার “শান্তির” ।


ঠিক শান্তিই নাম তাঁর আর অশান্তিটা হতো
শুধু আমার সাথে কথামত না চলার কারনে,
সেই ছোট্টবেলা থেকে
বাবামায়ের কর্মব্যাস্ততা– শান্তিকে আমার অনেক
কাছে দেয় এনে ।

সেই পাঠশালাতে তালপাতায় দোয়াত কালি আর
বাশের কঞ্চির পেন,
বেশিই লেখা হতো হাতে,পায়ে আর জামা প্যান্টে-
ভূত কালিময় সেই শৈশবের চেহারায়;
সাবানের সুনিপুন ঘষায় আর জলের ঝাঁপটায় আমাকে হিরো বানাত-
আমার শান্তিই... ।

স্নান শেষে স্টাইল করে চুল আচড়ে দেওয়া, নতুন করে
প্যান্টশার্ট পড়িয়ে সভ্যদের দলে ঠেলায়-
তাঁর অগ্রগন্য ভুমিকাই-
আজ সভ্য সমাজে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ায়
আজ আমি অভিযোজিত ।

দুপুরে খাবার পড়ে বিদ্যুৎহীন-
তাল পাখা নেড়ে ঘুম পারানোর
শত-সহস্র প্রচেষ্টা
চোখদ্বয় চেপে উল্টো করে, একশো থেকে শূন্য গননা-
এত আমার শান্তিরই অবারিত  স্নেহশুধা ।

বিনিদ্র বালকের ছোট্ট আঁখিদ্বয়, আঙ্গুলের ফাঁকা হতে
শান্তির ঘুমের নিদ্রাহীন প্রতীক্ষা,যাতে ফাকী মেরে
যেতে হবে কাচ-গুলী খেলতে
নিঃশব্দে গুটি গুছিয়ে, পাছে
মৃদু শব্দে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায় – বাঘিনীর ।

সেই যে জড়িয়ে ধরে কত শত পচা গপ্প-
রুপকথা,ভুত,আরব্য-
আরও কত ছড়া,গান, কবিতা-
কি আগ্রহ ছিল তখন
সবকিছু করতে পারতাম যেন-- ওই গল্প শোনার লোভে ।

সারাদিন টুকিটাকি হাজারো কাজ শেষে-
ক্লান্ত শরীরে যখন রাগ মস্তিস্কে-
ঠিক তখনই উচ্চ স্বরে-
সারাদিন কি কাজ করেছ বুড়ি? হয়ত শুনতে  পাইনি ভেবে-
কি কাজটা করেছিস বুড়ি?


আধুনিক বুড়ি সেকালে জন্মালেও, শুনতে পেয়েছে দুবারই,
বিন্দু বিলম্ব না করে তীব্র রেগে,
ঝাঁটা নিয়ে তাড়া…
কি যে মজা হতো, মনে হতো যেন ওকে রাগানোয়-
পৃথিবীর সর্বসুখ ।

নিয়তির খেলায় আজ বহুদূরে-
সীমানা পেড়িয়ে  ক্ষুদ্র আশ্রয়ে ,
সেই আশ্রয়টুকুও  ছেড়ে যায় চলে-
নিঃস্ব-রিক্ত, একাকী করে-
নির্মমের মত ফেলে রেখে ।

আজ বেশ কয়েক বছর হল বৃদ্ধার সাথে  দেখা নেই,
আর মাত্র এ কয়েক বছরের ব্যবধানে-
বুড়ির না আছে সেই তেজ নাইবা কথার দম,
সব যেন ধীরে ধীরে অস্তের দিকে
নির্দিষ্ট একটা গতিতে ধাবমান ।


হয়ত গায়ের চামড়া আরও
কুচকে গেছে অন্য সব বৃদ্ধার মত-
হয়ত ধীরে ধীরে বড্ড ধীরে ধীরে
কথা পারে বলতে
একটু আধটু ।

ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে আজ, মনে হয় ছুটে যাই তীর বেগে
গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলি-
তোমায় কোথাও যেতে দেবনা,আমার কাছে থাকবে,
তোমার সাথে হ্যা হ্যা তোমার সাথে-
অনেক অনেক অনেক ঝগড়া করবো আমি ।

বাঁধা, বৃহদায়তন এক বিপত্তি,
যেখানে ইচ্ছে-মৃত্যু খুবই স্বাভাবিক,
তবুও মন তা  আর মানতে রাজী নয়-
বারবার ফিরে পেতে চায়-
শৈশবের সেই হারাদিন ।

অসম্ভব নয় তবে অত্যানুকুল সময়তো চাই,
তাইতো ফোনে চিৎকার করে বলা-
আমি আসবই আসবই আমি, আসার আগে যেওনা ছেড়ে,
কিছুই শোনেনি বলে যাচ্ছে অবিরত—
হ্যালো ও  দাদু হ্যালো... কথা বলেনা... ।


একবার ফোন রাখার আগে বলে চলে-
কেন গিয়েছিলি যদি আসতেই না পারবি?
আমি তো ইঞ্জিনিয়ার চাইনি,  এখনও চাই না-
আমি আমার দাদুকে মরার আগে একবার দেখতে চাই
মাত্র একবার- এই শেষ আশাটা কি অপূর্ণ থেকে যাবে?

প্রত্যুত্তর- তোমাকে শেষবারের মত দেখব বলে-
হয়ত আমিও এখনও মরিনি, আর হয়ত মরব ও না
সবই তাঁর খেলা, বিধিলিপি-
হবে কি হবে না, তোমার আমার দুজনার-
শেষ দেখা... ।।