কাব্য বিশ্লেষণ- মুনশি আলিম
কবি জফির সেতু সাহিত্যের একজন নিবেদিত প্রাণ। তিনি শুধু কবিই নন, উৎকৃষ্টমানের একজন সাহিত্যবোদ্ধাও বটে! ব্যক্তিজীবনে তিনি শিক্ষক হিশেবে যেমন স্বার্থক, গগনচুম্বী জনপ্রিয় তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও তিনি সিদ্ধহস্থ, পরিচিত মুখ, প্রিয়জন। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ মুরারী চাঁদ কলেজে জফির সেতুর ডক্টরেট লাভের সংবর্ধনা সভায় একদা প্রধান অতিথির বক্তব্যে একালের অন্যতম সেরা ভাষাবিজ্ঞানী ড. দানীউল হক বলেছিলেন, “জফির সেতু শিক্ষকতাকে কেবল পেশা হিশেবেই নেননি, তিনি শিক্ষকতাকে নিয়েছেন মানুষ গড়ার মিশন হিশেবে”। যেসব শিক্ষক শিক্ষাকে মানুষ গড়ার মিশন হিশেবে মনে নেয় এবং মেনে নেয়ে এবং সে অনুযায়ী ব্রত পালন করে নিঃসন্দেহে তাঁরা অনেক বড় মাপের মানুষ। এঁরা যেখানে চাষ করেন সেখানেই সোনা ফলে। হোক তা নৈতিকতার চাষ, হোক তা সাহিত্যের চাষ! কবি জফির সেতু নিঃসন্দেহে একালের একজন শুদ্ধতম কবি, গুণী কবি, ঋষি কবি, বোদ্ধা কবি, চির তারুণ্যের কবি। শুদ্ধস্বর থেকে ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যটিই নিঃসন্দেহে তার প্রমাণ রাখে।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যের তালিকা নিম্নরূপ:
বহুবর্ণ রক্তবীজ (২০০৪)
সহস্র ভোল্টের বাঘ (২০০৬)
স্যানাটোরিয়াম (২০০৮)
তাঁবুর নিচে দূতাবাস (২০১১)
সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী (২০১২)
জাতক ও দণ্ডকারণ্য(২০১৩)
সুতো দিয়ে বানানো সূর্যেরা (২০১৪)
Turtle Has No Wings (2014)
ময়ূর উজানে ভাসো (২০১৪)
ডুমুরের গোপন ইশারা (২০১৪)
প্রস্তরলিখিত (২০১৫)
ইয়েস, ইউ ব্লাডি বাস্টার্ডস (২০১৫)
কবি জফির সেতু এক আলোকিত মানুষ। এককথায় আলোর বাতিঘর। সৌরজগতে সূর্যকে কেন্দ্র করে যেমন তার চারপাশে গ্রহগুলো অবলীয় আবর্তিত হয়, রবি ঠাকুরের সময় তাঁকে কেন্দ্র করে যেমন সাহিত্য বলয় গড়ে উঠেছিল ঠিক তেমনি বর্তমান সময়েও কবি জফির সেতুকে কেন্দ্র করেও এক সৃষ্টিশীল সাহিত্য বলয় গড়ে উঠেছে। যার মধ্যমণি হলেন স্বয়ং কবি জফির সেতু।
নবীন ও প্রবীণ সাহিত্যিক যাঁরাই তাঁর সাহিত্যের সংস্পর্শে এসেছেন কিংবা ব্যক্তি স্পর্শে এসেছেন তাঁরা নিঃসন্দেহে অবগত আছেন যে, জফির সেতুর প্রতিটি কথার মধ্যেই যেমন বিশুদ্ধ সাহিত্যের সুঘ্রাণ মেলে, তেমনি তাঁর কবিতাতেও মেলে নতুনত্বতার সুঘ্রাণ! তাঁর কথার শৈল্পিক জাদুতে দর্শকমাত্রেই যেমন মোহগ্রস্থ হয়, তেমনি লেখনীর জাদুতেও সাহিত্যবোদ্ধারা কেবলি বিস্মিত হয়।
কবি জফির সেতু জানেন, জননী ও গর্ভধারিণী এক নয়, তিনি জানেন, প্রতীক্ষা ও অপেক্ষা এক নয়, তিনি জানেন সব কবিদের লেখাই কবিতা নয়! তিনি জীবনানন্দ দাশের সেই উক্তিটিও জানেন- “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। আর সেকারণেই তিনি সাধনাহীনভাবে, শিল্প-রস বর্জিত অনেক কবির প্রসব করা কবিতাকেই কবিতা বলতে নারাজ!
সত্যিকার অর্থে কবিতার কোন একক মাপকাঠি নেই, তবে তা হয়ে উঠতে হয়। আর হয়ে উঠলে তা বুঝা যায়, সুভাসেই যেমন গোলাপকে চেনা যায় তেমনি আরকি! কবির বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র কবিতার কোন একটি লাইনও যদি পাঠক হৃদয় কে ছুঁয়ে যায় তাও কবিতা বলে বিবেচিত হবে।
আমরা জানি, আঠালো মাটি যখন নরম তখন কাঁদাময়, যখন শক্ত তখন কন্টকময়। এমনি আমাদের কবি জফির সেতু। প্রয়োজনে সে নরম হতে যেমন দ্বিধাবোধ করেন না, তেমনি নৈতিকতার পরিপন্থী কোন কিছু ঘটলে সে শক্ত হাতে বিদ্রোহ করতেও কুষ্ঠাবোধ করে না। কবির চিন্তা ও দৃষ্টি-ভঙ্গি সুদূরপ্রসারি। তিনি শুধু নিজের কথাই ভাবেন না, ভাবেন সমাজের কথা, রাষ্ট্রের কথা, ভাবেন বিশ্বপরিমণ্ডলের সামগ্রিক অবস্থার কথা। সমাজকে আলোকিত করতে তিনি তিলে তিলে বিলিয়ে দেওয়ার কাজে ব্রত রয়েছেন। নানাবিধ কারণে এখন অনেকটাই প্রচারবিমুখ হয়ে পড়েছেন।
তিনি বিশ্বাস করেন মেহেদি পাতা যেমন নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে অন্যকে রাঙিয়ে তোলতে পারে ঠিক তেমনি একজন সত্যিকারের কবিও তাঁর সৃষ্টিশীল কবিতার মাধ্যমে সমাজকে, রাষ্ট্রকে সর্বোপরি বিশ্বকে আলোকিত করে তোলতে পারেন। একবিংশ শতাব্দীতে হাতেগোনা যে কয়েকজন সৃষ্টিশীল, মননশীল, চিন্তাশীল, রুচিশীল, বাকপটু, শিল্পরসিক, বাঙালি কবি রয়েছেন কবি জফির সেতু তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান।
পল্লিকবি জসীমউদদীন গ্রামীণ প্রকৃতি নিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর কবিতাতে একই সাথে যেমন পল্লীপ্রকৃতির ছাপ রয়েছে তেমনি রয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্বের ছাপ! ঠিক তেমনি কবি জফির সেতুর ক্ষেত্রেও বলা যায় ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যে একই সাথে তিনি আনয়ন করতে চেয়েছেন পুরাণ, ইতিহাস ঐতিহ্য, ভৌগলিক ক্যানভাস, চিরায়ত নারীর রূপ, মহাকাল, মানবতা, বৈশ্বিক অস্থিরতা, যুদ্ধবিগ্রহ, গতিশীলতা, বংশীয় জাত্যাভিমান, মহাকালের প্রতীকী ক্যানভাস, প্রকৃতির স্বরূপ উন্মোচন, যুগের সংঘাত, মানবিক অবক্ষয়ের নগ্ন চিত্র প্রভৃতি। তবে উল্লেখ্য যে, পল্লিকবি জসীমউদদীনের মতো কবি জফির সেতুর কাব্যেও তাঁর ব্যক্তি মানসের ছায়াপাত ঘটেছে।
কবিতা লেখার উন্মেষকাল থেকেই কবিতার ভাব, ভাষা, ছন্দ অলংকরণ, উপমা, যমক, উৎপ্রেক্ষা, বক্রোক্তি, শ্লেষ সর্বোপরি বিষয়বস্তুর ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তবে অপ্রিয় সত্য হল ভাষার কাজ হচ্ছে সরলীকরণ। আর সে প্রভাব পড়েছে সাহিত্যেও। তবে একই সাথে ভাষা মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে অন্য ভাষার শব্দকেও আত্মীকৃত করে। কালে কালে সে প্রভাব আমরা দেখতে পাই সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়।
মূলত ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যে ‘ঘোটকী’ কখনো হয়ে উঠেছে সত্যিকারের ঘোটকী, আবার কখনো হয়ে উঠেছে সময়ের প্রতীক, কখনো আবহমান সরল নারীর প্রতীক, কখনো প্রেমিকা, কখনো যুদ্ধযাত্রার সঙ্গী, কখনো আদর্শের প্রতীক, কখনো ধর্ম রক্ষার হাতিয়ার, যুদ্ধের প্রেরণা, কখনো বিশ্ববিবেক, আবার কখনো বা হয়ে উঠেছে মহাকালের প্রতীক।
মানুষ তার শরীরের চুলকে যেমন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে ডাকে বা নামকরণ করে তেমনি, কবি জফির সেতুও তাঁর ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যে ঘোটকীকে পৌরাণিক ছাঁচে ফেলে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নামকরণ ও উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন।
এটাকে মিথ নির্ভর একটি কাহিনি কাব্য ধরলে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। কেননা, কাহিনি কাব্যের মধ্যে যেমন একটি নিটোল কাহিনি থাকে তেমনি ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যেও রয়েছে। তবে এ কাহিনিটি অপরাপর কাহিনির মতো সরল নয়! কাহিনি কাব্যে কোন নায়ক নায়িকার জীবনের চড়াই-উৎড়াই শিল্প-ব্যঞ্জনার মাধ্যমে পরিসমাপ্তির দিকে ধাবিত হয়। কবি জফির সেতুর ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যেও দেখি তাঁর সৃষ্ট ঘোটকী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, মাঠ-ঘাট, নদী-নালা পাড়ি দিয়ে, রোমান্টিকতা ও রোমান্টিসিজমরে মধ্য দিয়ে নির্বাণ লাভের পথে পরিভ্রমণ করেছে।
কবি জফির সেতু ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যটিতে যেমন ভাষার সরলীকরণ আনয়নের চেষ্টা করেছেন তেমনি প্রকরণের দিক থেকেও ভিন্নতা আনয়নের চেষ্টা করেছেন। কেননা, তিনি কবিতার শুরুতে নাম ব্যবহার না করে নং ব্যবহার করেছেন। আর তা কাহিনির মতো করে পরিসমাপ্তির দিকে ধাবিত হয়েছে। প্রথম কবিতাটিই তার প্রমাণ রাখে-
মানুষের প্রথম প্রণয় ঘটেছিল তোমাকে দেখে- প্রণতি জানিয়েছিল!
একদিন দক্ষিণের বাতাস আছড়ে পড়েছিল ময়দানের শ্যাম দূর্বাঘাসে
তুমি লাফিয়ে উঠেছিলে, তোমার গায়ের লোমও শিহরে- কেঁপে ওঠে
এই দৃশ্য দেখে মানুষের প্রথম আনন্দ ও আকাঙক্ষা জেগে উঠেছিল।
উৎস: ১ নং, পৃষ্ঠা ৭
কবিতা মূলত অনুধাবনের বিষয়, উপলব্ধির বিষয়। কবিতার বাহ্যিক রহস্য, নিত্যদিনের বিষয়াদি বা প্রতীকী প্রচলিত প্রশ্নের ভেতর অস্পর্শ-মেটাফর মিশ্রিত অংশই হতে পারে অতলস্পর্শী। পাঠ শেষে চমক থাকবে, চোখের ভেতর আরেক চোখের খেলায় স্বপ্নজগত ও শুক্তির ভেতর হাঁটতে বাধ্য করে। এবং পংক্তির পলে-পলে জাগে কবিতার নান্দনিকতা।
কিন্তু বাস্তবতা আর অভিজ্ঞতার সাথে পাঠোদ্ধার বা রসবোধের যে ফারাক সৃষ্টি; দেহভস্ম-যাপন ব্যবস্থার অবতল খোলে তীব্র চাপে অন্তর্ঘাত তৈরি হলো কি-না; জানি না। হয়ত আমি এই অবাক মুহূর্তকে ধারন করতে পারিনি। তবুও যতটুকু ধারন করার ক্ষমতা কবিতা থেকে পাই; সেখান থেকে কবি ও কবিতাকে চিহ্নায়ন করি; ততটুকুর ভেতর পুলকিত হই।
কবির ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যে যেমন পুলকিত হবার উপাদান রয়েছে তেমনি রোমাঞ্চিত হওয়ার উপাদানও রয়েছে। কবির ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যে ‘ঘোটকী’ সত্যিকারের ঘোটকী হয়ে শাসকদের আনুকূল্যে সে উপত্যকা থেকে উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়। আর এতে করে বিজিতের ও নির্যাতিতের ক্ষরণের ক্ষতাক্ততাও সে বয়ে বেড়ায়। এমনই নিখুঁত চিত্রকল্প তিনি তাঁর কবিতায় তোলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
যখন তুমি উপত্যকা থেকে উপত্যকায় ঘুরে বেড়াও
তখন তোমার পা থেকে ঝড়ে পড় বিস্মরণের দিন
আমার জামার নিচে আমি সুগভীর ক্ষত পোষে রাখি
তোমার ত্বকের ভেতরেও উজ্জ্বল দাহ জমা আছে
উৎস: ২নং, পৃষ্ঠা ৮
বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতাঙ্গনে যে বা যারা পুরাণকে প্রধান উপজীব্য করে কাব্যকে অতিমাত্রায় রসঘন ও শৈল্পিক করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন কবি জফির সেতু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একই সাথে ঘোটকীকে প্রতীকী ব্যঞ্জনার মাধ্যমে অতীত রোমন্থন করে চিত্ররূপময় করে তুলেছেন।
তোমাকে প্রথম দেখি সন্ধ্যার ছায়ায়
প্রার্থনার ভঙ্গিতে দেহখানি বেঁকে গেছে
আগন্তুক ঋতুর মতো তোমার সজ্জা ও পোশাক
-------------------------------------
তোমাকে দেখা হলো মৃত মানুষের শহরে
স্মৃতিপূর্ণ নদীটির তীরে।
উৎস: ৪নং, পৃষ্ঠা ১০
কবি ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যে ঘোটকীকে একের পর এক তুলনা করেছেন, উপমায় উপমিত করেছেন, গুপ্ত ব্যথাকে অলংকরণে প্রস্ফুটিত করেছেন, ভাবের ব্যঞ্জনায় নিখুঁত করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ফলে তাঁর সৃষ্ট ঘোটকী সুন্দরের আল্পনায় আরো মোহনীয় হয়ে উঠছে।
এক গর্বিত সুন্দরীর মতো তুমি দাঁড়িয়েছিলে
তোমার গ্রীবা ছিল উজ্জ্বল আর অহংভরা
হেমন্তের সকালে তুমি ঘুম থেকে জেগে
সূর্যকে দেখে নিলে একনজর
তারপর উপত্যকার ঘাস যন্ত্রণাকে ছড়িয়ে দিলে।
উৎস: ৬নং, পৃষ্ঠা১২
কবিতায় উপমার ব্যবহার কবি জফির সেতু সিদ্ধহস্থ। মূলত মৌলিক কবিরা তাদের কবিতায় শব্দ বুননেই বেশি বৈচিত্র্য আনয়ন করে থাকেন। উপমাগুলোও একই সাথে যেমন হৃদয় হরণ করে নেয়, তেমনি ভাবনার জগৎকেও প্রসারিত করে তুলে। কবির কবিতার ভাষায়-
তোমার চোখের নিচে পুড়ছে সাতটি গ্রীষ্ম
আর ক্লান্ত পায়ে ঠেকেছে বিষাদের পাথর
কিন্তু তুমি অপেক্ষমাণ মূক জনতার মাঝে
উৎস: ৭নং, পৃষ্ঠা ১৩
কবির উপমায় ঘোটকী কখনো হয়ে উঠেছে নারী আবার কখনো হয়ে উঠেছে অতীতের খোরাক! সে অতীত রোমন্থনের সাথে মিশে আছে যুগের হতাশা, দুঃখ, ক্লেদ। এর মধ্য দিয়ে পুরাণের ছায়াপাতও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তোমার চিবুকে লেগে আছে কান্নার দাগ
ভ্রাম্যমান মানুষের মতো যেই তুমি তা ধুতে গিয়েছ
প্রাচীন নদীটির পানি তখন বহুরঙ্গে ছেয়ে গেছে।
উৎস: ৮নং, পৃষ্ঠা ১৪
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক কবিতায় বলেছিলেন, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি…! সত্যিই আমরা বিশাল পৃথিবীর অনেক কিছুই জানি না। পৃথিবীকে জানার জন্য মানুষের আগ্রহের শেষ নেই! বহিরাঙ্গনে তাকালেই মনে হয় প্রকৃতির নবরূপ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নতুন সুরের ব্যঞ্জনায় মুখরিত প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধের সুধা নিতে নিত্যই সে হাতছানি দেয়। কখনো সে বিশ্ব পরিব্রাজক রূপী ঘোটকী সেজে হাতছানি দেয়, কখনো বা প্রিয়ার মতো করে নিভৃত্তের দুয়ার ভেঙ্গে হাতছানি দেয়। কবির কবিতায় সেরকমই একটি চিত্রকল্প-
সিন্ধুপারের এক ঘোটকী আমাকে ডাকে
তার চামরায় লেগে আছে মরুভূমির বালি
সেই ঘোটকীর আকাঙক্ষার ভেতর আমার শরীর আর্তনাদ করে
যদিও রোজ রাতে আমি সেই ঘোটকীর সুগন্ধী ঠোঁটে
এঁকে দিই প্রণতি ও অন্ত্যেষ্টির চিহ্ন।
উৎস: ১০নং, পৃষ্ঠা ১৬
কবিতা সকল ভাষার সাহিত্যের ক্ষেত্রেই অমূল্য সম্পদ। ফলে উৎকৃষ্ট কবিতার ভাষাকে হৃদয়ের রঙতুলি দিয়ে চিহ্নায়নের চেষ্টা করা উচিত; প্রথমে কবিতাটির ভেতরের সপ্রণোদিত ভাষার স্বাতন্ত্র্যটি খোঁজতে হবে। মনে রাখতে হবে, কবিতার শিল্প-ব্যঞ্জনাই কবিকে কবিতা পাঠে বারবার তাগিদ সৃষ্টি করবে। জফির সেতুর কবিতাতে সেরকমই শিল্পরসের ছোঁয়া পাই। যেমন-
তোমার চোখের ভেতরে একটি চেরির বাগান
অদূরে দাঁড়িয়ে আমি দেখেছিলাম এক বিকেলে
---------------------------------------------
তোমার আছে সুপুরুষ যোদ্ধা আর তুমি ভালোবাসায় পূর্ণ
কিন্তু আমি একটি রক্তিম চেরি হয়েই থাকতে চেয়েছি।
উৎস: ১৫নং, পৃষ্ঠা ২১
ফুলের সাথে যেমন সুভাসের সম্পর্ক তেমনি কবির সাথেও কবিতার সম্পর্ক। কবির একান্ত মনযোগের উপরই কবিতার গুণাগুণের মান নির্ভর করে। কবিতার ভাষা কবি তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি থেকে প্রকাশ করেন। পাঠককেও সে বিষয় ও ভাষার প্রতি ভাবিত করে, আকৃষ্ট করে। কবিতার বিষয় ও ভাষা দিয়ে পাঠককে ধরে রাখার ভেতরই কবি শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।
বর্তমান স্যাটেলাইট চ্যানেলের যুগে কোন একটি টিভি প্রোগ্রাম যদি দর্শককে আকৃষ্ট করতে না পারে তবে দর্শক কিন্তু চ্যানেল পরিবর্তনে বিন্দুমাত্রও সংকোচবোধ করে না। কবিতার ক্ষেত্রে বর্তমানে তেমনটি ঘটছে। কবির কবিতার কোন লাইন বা উপমা যদি পাঠকে না টানে পাঠকও সে কবিতার বই ছুড়ে ফেলত দ্বিধাবোধ করে না। কবি জফির সেতুর কবিতাতে পাঠক ধরে রাখার সকল উপকরণই বিদ্যমান রয়েছে। নিচের কবিতাত্রয় লক্ষ্য করলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় আমরা হেঁটেছি পাশাপাশি
তুমি ভিজে গেছ আমি ভিজে গেছি
কিন্তু তোমার চোখে জ্বলছিল মহাকালের বিচ্ছুরিত আলো
উৎস: ১৬নং, পৃষ্ঠা ২২
আমি তোমার মাথায় রাখি হাত
অনুভব করি কতটা পথ তুমি পেরিয়ে এলে
আর কতটা পথ তোমাকে পাড়ি দিতে হবে।
উৎস: ১৮নং, পৃষ্ঠা ১৯
একটি নদীর উৎস খুঁজে খুঁজে আমি পেয়ে যাই
তোমার এক পিতামহীকে, দেখতে তোমারই মতো
--------------------------------------------
আমি তার পাশে দাঁড়াই স্পর্ম করি কটিদেশ
একটা রাজকীয় দৃষ্টি হেনে তোমার পিতামহী
আমাকে অবজ্ঞা করে নেমে যান নদীর গহ্বরে।
উৎস: ১৯নং, পৃষ্ঠা ২৫
কবিতার মধ্যে নানাভাবেই কবিকৃতি খোঁজে পাওয়া যায়। ভাষাবুনন, শব্দবুনন, বাক্যবুননের পদ্ধতিতেও কবিদের নিজস্বতা লক্ষ্মণীয়। কারণ কবিতার ভাষানুভব জাদু-স্পর্শের মতো, অনুভূতি, উপলব্দি যেন রসায়নের মতো ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় মিশে খেলা করে। বাতাস যেমন সহজেই শরীর-মনকে ছুঁয়ে যায় তেমনি কবিতার ভাব-ভাষা, উপমাও পাঠককের হৃদয়কে খুব সহজেই ছুঁয়ে দিতে পারে।
তবে এটাও সত্য যে, কবিতার ভেতর নিজের জীবনটাকেও পাঠ করা। যখন কবিতাটি ভালো লাগে তখন কবিতার ভাষার সঙ্গে কবির যাপিতভাষা কতটুকু ফুটেছে তা-ও দেখার বিষয়। আর কবিতার মধ্যে যদি থাকে পৌরাণিক শিল্পরস তবে তো কথাই নেই! কবি ইচ্ছে করলেই তাঁর কবিতার পংক্তির ভিতর দিয়ে পাঠককে দেশ থেকে দেশান্তরে, ইতিহাস থেকে ইতিহাসের গভীরে নিয়ে যেতে পারে। এটা যে বা যিনি পারেন তিনি নিঃসন্দেহে স্বার্থক কবি। সে দৃষ্টিকোণ থেকে কবি জফির সেতুর নিম্নোক্ত কবিতাত্রয় ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখে।
তোমার পূর্বপুরুষেরা এসেছিল পশ্চিম থেকে
তাই তুমি পূর্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাও আজ!
তোমার রক্তে শুধু গ্রিস-রোম আর ব্যবিলনের নেশা
কিন্তু তোমার অশ্ব থেকে যাবে এই দেশে
এই মাঠে এই প্রান্তরে অন্তত আমি এটা জানি
উৎস: ২১নং, পৃষ্ঠা ২৭
আমাদের দেখা হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক কালে
তুমি ছিলে স্ফিংসের দুহিতা আর অভেদ্য-অবধ্য
ট্রয়ের পুরুষেরা চেয়েছিল তোমাকে তৃণের শয্যায়
-------------------------------------------
তোমার শ্যাম উরুতে উরু সংযোগ করেছিল ট্রয়যুদ্ধে
যেই হেক্টর, কুরুক্ষেত্র সেই একই অভিমন্যু ও অর্জুন!
তোমার নাভিতে আমারও প্রাণের চিহ্ন লেগে আছে।
উৎস: ৩৫নং, পৃষ্ঠা ৪১
জাভা নারীর গর্ভে তোমার জন্ম হয়েছে কি হে আর্য- অনার্যের দুহিতা?
মধ্য এশিয়ার ভূমি ফুঁড়ে এসে এই মাটি জলঘাসে রক্তের
মিশ্রণ? ইতিহাসের এই রাতে তোমাকে দেখেছি তুলনাহীন!
আমি কিরাতজন, প্রাকৃত পুরুষ- আমাকে ডেকে নিয়েছিলে
টোটেমের রাতে, আমার চোখ ঠুকরে খেয়েছিল পদ্মার মাছ আর
তুমি বলেছিলে, আসলে তুমি মৎস্যগন্ধ্যা- যোজনগন্ধ্যা সত্যবতী!
---------------------------------
আমার আঙুলে জ্বলে ক্ষেতের ফসল
আর আমি তোমার গর্ভ ফুঁড়ে বেরিয়েছি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ!
উৎস: ৪৪নং, পৃষ্ঠা ৫০
কবিতা পাঠককে ঘোরের ভেতর আচ্ছন্ন করে রাখবে এটাই স্বাভাবিক। কবিরা মূলত কবিতার ভেতর জাগিয়ে তোলে ঘোরের খেলা। চিন্তনধর্মী এক ধরণের অজানা অনুভব-অনুভূতি জাগিয়ে তুলে; কারণ কবিতার বিষয়-বৈভব আমাদের আবেশি ও জাগতিক চিন্তাসীমাকে জাগ্রত করে। চিন্তার পরিসরকে সমৃদ্ধ করে। কাব্যজগৎ আর যাপিতজগৎ যখন একসাথে হাঁটে বা সম্পর্কস্থাপন করে তখন নিজের ভেতরের চিন্তা, ভাবনা, অজানা, অদেখা মনোটানের অন্বেষায় অতিগোপন টানগুলোও এসেন্স ছড়ায়। নতুনন্ত্ব আস্বাদনে বুদবুদ সৃষ্টির মতোই ক্ষণে ক্ষণে হৃদয়ে উচাটন করে। কবির কবিতাদ্বয় সেরকমই চিত্রকল্প প্রকাশ করে।
যেন টিউলিপ ফুল তোমার স্তনগুলো
নিঃশব্দ আর টকটকে লাল
যখন তোমার অশ্বের দিকে তাকাও টসটসে স্বচ্ছ ফলগুলো কেঁপে কেঁপে ওঠে
মুরুভূমিতে আজ চাঁদ উঠেছে
তোমার স্তনগুলোতেও ফুটেছে দুধের ধারা
তুমি অম্বকুলের প্রেমিকা ও জননী।
উৎস: ২৬নং, পৃষ্ঠা ৩২
হ্রদের ধারে দাঁড়িয়েছিলে তুমি
তোমাকে দেখে আহ্লাদে নেচে উঠেছিল
একটা ছোট্ট মাছ
একটা পাইনের ছায়া পড়েছিল জলে
এই দৃশ্য দেখে তুমি পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরে পেলে
টলটলে হ্রদের ধারে তোমাকে তেজি ও মায়াবী দেখায়।
উৎস: ২৮নং, পৃষ্ঠা ৩৪
কবি একই সাথে সহজ বিষয়ক যেমন সহজভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে তেমনি দুর্বোদ্ধ বিষয়কেও সহজভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে। তবে এ কঠিন কাজটি যারা পারেন তারা সত্যিকার অর্থেই বড় মাপের কবি। কবি জফির সেতু পুরাণের মতো কঠিন বিষয়কে সহজভাবে, সহজভাষায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। নিচের কবিতাদ্বয়ই তার প্রমাণ রাখে।
তোমার মুখে দেখেছি আমি অস্তাচলের দৃশ্য
তরঙ্গিত যুদ্ধক্ষেত্রে দেখেছি তোমার রুদ্রমূর্তি
----------------------------------------------
তোমাকে আর চিনেছিল রাজা সলোমন
উৎস: ৩৬নং, পৃষ্ঠা ৪২
প্রাচীন গুহাচিত্রে যে ঘোটকীর ছবি আঁকা আছে
তুমি সেই নারী? লাল বিন্দু দিয়ে আঁকা সে ছবিতে
বিষণ্ণ দাঁড়িয়ে আছ! আজ দুপুরেও এমনটা দাঁড়িয়েছিলে
আমার কাছ ঘেঁষে, আমি নিশ্চিত তুমি ছিলে টোটেমের দেবী!
আলতামিরা গুহায় তোমাকে এঁকেছিল এ নিয়ানডার্থাল পুরুষ
তার জায়গায় আজ আমি যাযাবর মানুষ!
উৎস: ৩৮নং, পৃষ্ঠা ৪৪
কবির ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যে তিনি পৌরাণিক কাহিনিকে যেভাবে শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর ঘোটকী মহাকালের বুকে চেপে দেশ হতে দেশান্তরে পাড়ি জমিয়েছে। যুদ্ধের রাজসাক্ষী হয়েছে। মানব কান্নার রাজসাক্ষী হয়েছে। তাবৎ পৃথিবী চড়াট করতে করতে তার ঘোটকীরূপী বিবেক সত্ত্বা দেখলো পৃথিবীর সকল মানুষের হৃদয়েই অনুভূতি রয়েছে। সুখের আনন্দ রয়েছে, ব্যর্থতার রোদন রয়েছে। অনুভূতির জায়গাতে পৃথিবীর সকল মানুষই সমান, ঠিক মানুষের বাসস্থানগুলো যেমন সমান। কবির কবিতার ভাষায়-
আমরা এখন দানিউব পার হয়ে এলাম
এর আগে পেরিয়ে এসেছি সিন্ধু, নীল ও মধুরা!
আমরা এডিনের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম আর
পার হয়ে গেলাম জিপসি ও ইহুদিদের আস্তানা
---------------------------------------
আমরা আবিষ্কার করলাম- মানুষের বাড়িঘরগুলো
মোটামুটি একই চেহারার আর পৃথিবীর সব
নদীই সায়ংকালের দুঃখ, একটাই নাম মধুরা!
উৎস: ৩৯নং, পৃষ্ঠা ৪৫
তোমার পায়ে লেগে আছে ঘাম নুন আর যুদ্ধজয়ের বারুদ
শিরদাঁড়ায় দড়িটানা আর্তনাদ আর উৎসুক চোখে মধু ও বিষ
------------------------------------------------
তোমাকে ডেকে নিয়ে নিজেই ডুবেছিল
সমুদ্র এককালে, যুদ্ধে জিতেছিল তরুণ আলেকজান্ডার!
হে ঘোটকী, তোমার সোনাল চুল, সূর্যাস্তবেলায় একলা এই মাঠে
জয়োৎসবের ভোজ আর উল্লাসের শব্দে তুমি কেঁদে উঠেছিলে?
উৎস: ৪৫নং, পৃষ্ঠা ৫১
সাংবাদিকরা যেমন সমাজের শিক্ষক, তেমনি কবিরাও প্রকৃতির অনিদ্যরূপের বার্তা প্রেরক। কবিতা লেখার আগে কবি একটি থিম দ্বারা তাঁর অনুভূতি, উপলব্ধি জাগিয়ে রাখেন। এই জাগিয়ে তোলার ভাষাটাও হতে পারে গল্পের, গদ্যের, কিংবা ছড়ারও; কিন্তু একজন কবি সে গল্পের ভাষা, গদ্যের ভাষার ছড়ার ভাষার রূপটিকে বদল করে কবিতার ভাষায় প্রকাশ করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন। উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও তাঁরা তাঁদের নিজস্বতা অবলম্বন করে।
কবি শুধু শিল্পদ্রষ্টাই নন, তিনি একজন ভাবুকও বটে! একজন পাঠক হিসাবে আমার মনে হয় যে অনূভূতি, উপলব্ধি আর চিন্তার গভীরতাই কবিতার ভাষা। যেমন একটি গল্প লিখতে হলে অনেক বিষয়-আশয় সম্পর্কে বিস্তর জানাশোনা বা আলোচনা করতে হয়; গদ্য লিখতে হলে অনেক তত্ত্বের জোগান দিতে হয়; কিন্তু কবিতার বেলায় এর বালাই নেই, একটি কবিতা লেখার পর সে বিষয়টি পাঠকের সামনে ব্যাখ্যা করার দায় থাকে না।
অবশ্য এর কারণও আছে। কবি তার নিজস্ব ভাষা দ্বারাই কবিতা লিখেন; তা হতে পারে দেখার ভাষা, অদেখার ভাষা, চিন্তার ভাষা, কল্পনার ভাষা, বুদ্ধির ভাষা, রূপক ভাষা, সহজ সরল সাবলীল ভাষাও হতে পারে; সব মিলেই একটি ভালো কবিতা জন্মে; যা পাঠককে বারবার টানে। কবি জফির সেতুর কবিতাগুলোও সেরকম ধাঁচের।
তোমার কাছে কি বিদায় চেয়েছি আমি? তবু তুমি বিদায়ের ভঙ্গিতে
রোজ আমার সামনে দাঁড়াও! তুমি কি দেখনোনি আমার বিষণ্ন গুমোট মুখ
মেঘরং ত্বকের নিচে কালনাগে দংশিত পাণ্ডু ও দুঃসহ দেহ? চক্রব্যুহে
পড়ে থাকা অভিমন্যু এবং হাহাকার ঘেরা ইউলিসিসের দুঃখ, অস্থিরতা?
উৎস: ৫৫নং, পৃষ্ঠা ৬১
তোমার সিঁথির সূর্য মুছে দেবে মৃতের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি, তুমি কি জানো?
----------------------------------------------------------
হে দ্রাবিড়া, মাটি-আকাশে তোমার গমক্ষেত সূর্য হয়ে জ্বলবে।
উৎস: ৫৬নং, পৃষ্ঠা ৬২
কবি জফির সেতু তার কবিতাতে একই সাথে যেমন পুরাণকে নিয়ে এসেছেন তেমনি সভ্যতার ইতিহাসকেও সুনিপুণভাবে আলংকরিক উপমার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তিনি কবিতায় দুটি সভ্যতার কথা বলেছেন।
এক. মায়া সভ্যতা
দুই. আজটেক সভ্যতা।
মূলত মায়া সভ্যতার ভৌগোলিক সীমা মায়া অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। ইতিহাসবোদ্ধামাত্রেই এ সম্পর্কে ধারণা পেয়ে থাকবেন। মায়া অঞ্চলের জলবায়ু অনেক ভাবে পরিবর্তন হয়েছে। নিচু-অবস্থান এলাকা হওয়ার ফলে মরুভূমির যাত্রীরা নিয়মিত প্রবল হারিকেন ঝড় এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের সম্মুখীন হয়।
প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ওল্মেক সভ্যতার শুরু হয়। তারা ছিল মায়াদের পূর্বপুরুষ। পণ্ডিতরা প্রারম্ভিক মায়া এবং প্রতিবেশী প্রাকধ্রুপদী মেসো আমেরিকা সভ্যতাসমূহ, যেমন, টাবাস্কো নিচুভূমি অঞ্চলের ওল্মেক সংস্কৃতি এবং চাপাস ও দক্ষিণের ও আজাচার যথাক্রমে মিক্স-জোক এবং জাপোটেক ভাষাভাষী মানুষের, ভৌত এবং সাংস্কৃতিক বিস্তারের সাথে একমত না।
আজটেক জাতি ছিল সুসংহত, কৃষিপ্রধান ও ধর্মনিয়ন্ত্রিত। ১৩ শতকের প্রথম দিকে এরা উত্তর দিক থেকে এসে মেক্সিকো উপত্যকায় বসতি স্থাপন করে। এইসব ছোট ছোট নগররাষ্ট্রগুলি ছিল মূলত রাজতান্ত্রিক। এই অঞ্চলে আজটেক জাতির লোকেরা আসার আগে থেকেই যে সব শহর ও বসতি ছিল, ধীরে ধীরে তারাও আজটেক সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যায়।
আজটেকরা প্রকৃতি পূজা করত। তারা ভূমি, বৃষ্টি ও সূর্যকে দেবতা মনে করত এবং দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে মানুষ বলি দেয়া অপরিহার্য মনে করত। তারা বিশ্বাস করত সূর্যকে প্রতিদিন সন্তুষ্ট করতে না পারলে পরের দিন আর সূর্য উঠবে না। সাধারণত বলি হিসেবে কয়েদিদের ব্যবহার করা হত এবং আজটেক যাজকরাই একাজ সম্পন্ন করত। আজটেকদের শিল্প-সংস্কৃতিতে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। গাছের বাকল ও দেয়ালে তারা চমৎকার রঙের চিত্রকর্মের মাধ্যমে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, দেবতাদের প্রকাশ করত।
কবি তাঁর কবিতায় সংক্ষিপ্ত ব্যঞ্জনায় পুরো ইতিহাসের ছায়াপাতকেই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। কবির ধারণা, বিশ্বের বহুল আলোচিত এই সভ্যতা দুটি ইতিহাসকে নিজের মতো করে বেঁধে ফেলেছে। উভয় সভ্যতার আচার- বিশ্বাস, সংস্কৃতি বিশেষ করে জলবায়ুর বিরূপ পরিবেশেও যেরূপ যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল সে কারণেই এ সভ্যতা মহাকালে স্মৃতিবহ হয়ে থাকার দাবি রাখে। তাছাড়া আধুনিক পুঞ্জিকার সূত্রপাতও কিন্তু সে মায়া সভ্যতা! অর্থাৎ ঘোটকীরূপী কবির মানসপ্রিয়াকে সে এই দুই সভ্যতার যুগেই কবি দেখেছে। কবির কবিতার ভাষায়-
মায়া ও আজটেকদের যুগে তোমাকে কি দেখিনি আমি? আকাশে
সূর্য জ্বলছে আর তুমি বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে ছুটে গেছ যুদ্ধক্ষেত্র
থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে! খাঁড়া পাহাড়ের ঢাল থেকে আমিও পাথর ছুঁড়েছি!
উৎস: ৫৭নং, পৃষ্ঠা ৬৩
কবি তাঁর ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যে ঘোটককীকে যখন বিশ্ব অস্থিরতার কারণে, শাসকবর্গের শোষণের কারণে, প্রকাশ্য নির্যাতন-নিপীড়ণের কারণে, মানবতা প্রতিনিয়ত ভুলুণ্ঠিত হতে দেখে- তখন তাঁর কবি হৃদয় দগ্ধ হয়। ভেতরে ভেতরে কষ্টের রোদন চলে। তিনি নিজে সেইসব শাসকের প্রতিনিধি হয়ে অবলীলায় ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এ ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যে কোন দীনতা নেই, নেই কোন সংকোচ। কেবল আছে সত্য ও সুন্দরের জন্য, মানবতার জন্য নতুন করে বিশুদ্ধ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
হে ঘোটকী, আমাকে করুণা করো তুমি আজ! চেয়ে দেখো
আমি সেই পুরাকালের চক্রবর্তী রাজা- তোমার বুকের মাংস
দগ্ধ করে যে-অঘ্রাণ নিয়েছিলাম নিঃশ্বাসে আজও লেগে আছে!
উৎস: ৭৪নং, পৃষ্ঠা ৭৯
সাহিত্যকে যারা নতুন ধারায় নতুন রূপ দান করেন কবি জফির সেতু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি অনুকরণ করতে যেমন পছন্দ করেন না, তেমনি কারো নির্দেশিত পথে হাঁটতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এজন্য নিজেই কাব্যের ক্ষেত্রে নতুন ভাব-ভাষা, ছন্দ, অলংকরণ, পুরাণ, ইতিহাসের সংমিশ্রণে সর্বোপরি নতুন প্রকরণে তাঁর ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যকে অনন্য করে তুলেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে যেমন বলা হয় কবিতা সম্রাট তেমনি কবি জফির সেতুকেও নিঃসন্দেহে কাব্যের অন্যন্য গুণের কারণে কবি সম্রাট বলা যায়! তাঁর ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যটি বোদ্ধা পাঠকের জন্য তো বটেই বাংলা সাহিত্যের জন্যও নিঃসন্দেহে মাইল ফলকস্বরূপ।
--------------
২৯.০৮.২০১৫
মুনশি আলিম
পূর্ব শিবগঞ্জ, সিলেট