এন্টোনি ফিরিঙ্গির সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে উত্তম কুমার অভিনীত 'এন্টোনি ফিরিঙ্গি' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে । ১৯৬৭ সালের এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করে উত্তম সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার জয় করে নেন। উত্তমের অভিনয়ে কতকটা মুগ্ধ হয়েই জানার চেষ্টা করি, এই রহস্যময় বিদেশি এন্টোনি ফিরিঙ্গি সম্পর্কে । রহস্যময় বলছি এই জন্য যে, এন্টোনি ফিরিঙ্গি শুধু বাংলা ভাষাই আয়ত্ত করেননি, ভালবেসেছেন, বাঙ্গালির অন্যতম ধর্ম হিন্দুধর্ম কে, বাঙ্গালির সমাজ সংস্কৃতির বাঁধনে নিজকে যেভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তা তার সমসাময়িক শুধু নয়, পুরো ব্রিটিশ যুগের ভারতমুল্লকে আর কোন বিদেশির ক্ষেত্রে ঘটেনি । তাই তিনি বাঙ্গালির কাছে নমস্য ।
পূর্বে বাংলায় 'মগরা ' ও পর্তুগিজরা 'ফিরিঙ্গি' নামে পরিচিত ছিল। অবশ্য তখন সাধারন ভাবে সকল ইউরোপিয়ানদেরও ফিরিঙ্গি বলা হত । তাই এন্টোনি ফিরিঙ্গির প্রকৃত নাম - হেন্সম্যান এন্টোনি বদলে এন্টোনি ফিরিঙ্গিতে রূপ নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি । এন্টোনি ছিলেন, একে জাতিতে পর্তুগিজ , তার উপর ধর্মে খ্রিষ্টান । কিন্তু হিন্দু এক বিধবাকে বিয়ে করে একেবারেই নিজের ধর্ম ও ব্জাতিকে ভুলে পরম ভাবে ভালবাসলেন , হিন্দু ধর্মের মা কালি কে, দেবি দুর্গাকে । আর পর্তুগিজ থেকে হয়ে গেলেন, বাংলার সঙ্গীত জগতের অন্যতম প্রধান মৌলিকধারার সঙ্গীত কবিগানের ভক্ত ও অনুসারী ।
কবিগানের সাথে এন্টোনির প্রথম পরিচয় খুব সম্ভবত তৎকালীন প্রখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রার কবি লড়াইয়ের সাথে । কবিগান মূলত এক ধরনের লোকসঙ্গীত ঘরানার সঙ্গীত । বাংলা লোকসঙ্গীতের বিচিত্র প্রকারভেদ আছে বলে আমরা দেখতে পাই। তাদের বিভিন্ন নামও আছে, তার সংখ্যা পঞ্চাশেরও অধিক । এরই ভিতর কবিগান হল, মিশ্র ভাববিষয় ধরনের সঙ্গীত । লোকসাঙ্গীতিক পর্যায়ের ব্যাপার হলেও, কবিগানের ভিতর দিয়ে বাঙ্গালির এক ধরনের প্রথা বদ্ধ সঙ্গীতচিন্তার প্রকাশ ঘটে । অনেকে বলে থাকেন, কবিগান এসেছে কাওয়ালি গানের ধারা থেকে । তবে এই ধারনার চেয়ে বেশি গ্রহনযোগ্য হয়েছে এই ধারনাটি- কবিগান এসেছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও তার পরবর্তী বৈষ্ণবীয় পালাগানে কৃষ্ণ, রাধা, বড়াই ও সখীদের মধ্যে যে কথোপকথন ও তর্ক -বিতর্ক, তার সাথে ছড়া কাটার মাধ্যমে প্রশ্নোত্তরমূলক দলকেন্দ্রিক ও জয়-পরাজয় ভিত্তিক সঙ্গীতোস্থাপনার রীতি থেকেই কবিগানের উৎপত্তি ।
কবিগান একধরনের প্রতিযোগিতা মুলক গান। দুটি দলে এ প্রতিযোগিতা হয়। প্রত্যেক দলের দলপতিকে বলে কবিয়াল বা সরকার । কবিয়ালের সঙ্গীদের নামও খুব চমৎকার, দোহার । দল দুটি পর্যায় ক্রমে আসরে এসে গান পরিবেশন করে থাকে। কবিয়াল হয়ে থাকেন, স্বভাব কবি। দুই দলের মধ্যে প্রশ্নত্তোরের ধারায় কবির লড়াই চলে । কবিয়াল কবিতার ভাষায় ছন্দ ও সুর সংযোগে অনর্গল বলে যেতে পারেন। এই সব কবিগানে পৌরাণিক , ঐতিহাসিক , সামাজিক, ধর্মীয় , অর্থনৈতিক , ও শিক্ষা বিষয়ক কাহিনী বা সমস্যার চিত্র উঠে আসে ।
কবিগানের বেশ কয়েকটি অঙ্গ আছে- যেগুলো বিশেষ অনুক্রমে বিন্যস্ত, যেমন- ডাক , মালসি, সখিসংবাদ , কবি, কবির টপ্পা , পাঁচালি , ধুঁয়া , ও জোটের পাল্লা । মালসি, সখীসংবাদ , ও কবি নামক গানের পদক্রম এরূপ - ধরন, পাড়ন , ফুকার, মিশ, মুখ, প্যাঁচ , খোঁচ , অন্তরা, পরচিতান, ও ছুট্টি ।ডাক গান বন্দনামূলক এবং এগুলো লঘুসংগীতের মত। বাউল গানের সমতুল্য ধুয়া গান গুলিও প্রায় একইরকমের, যা পাঁচালির ফাঁকে ফাকে পরিবেশিত হয়। পাঁচালি অংশে পয়ার ও ত্রিপদী তে কবিয়ালগণ ছড়া কাটেন । সব শেষে জোটের পাল্লা অংশে দুই কবিয়াল কোন একটা গানের সুরে ছড়া কাটতে কাটতে গান শেষ করেন। কবিগানের খেউর অংশটি আদি রসাত্মক । এতে রুচির কোন বালাই নেই। খিস্তি -খেঁউড় কথাটির সেখান থেকেই উৎপত্তি । কবিগান ভাব, ভাষা , ছন্দ , সুর, বাদ্য , ও ভঙ্গি সংযোগে একটি সাংগীতিক আবহ সৃষ্টি করে থাকে, যার মুগ্ধতায় সারা রাত শ্রোতারা আটকে থাকে।
আবার আসি এন্টোনি ফিরিঙ্গির প্রসঙ্গে । ফিরিঙ্গির বাস ছিল প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের চন্দন্নগরের ফরাসডাঙ্গায় । কবিগানের প্রতি অনুরক্ত হবার কারনেই তিনি কলকাতার প্রসিদ্ধ কবিয়ালদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। প্রথম দিকে বাঙালি কবিয়ালরা এই ফিরিঙ্গিকে হতাশ ও নিরুৎসাহিত করলেও, পরবর্তীতে তার কবিগানের প্রতি প্রগার প্রেম দেখে মুগ্ধ হন । প্রথম দিকে এন্টোনি জনৈক গোরক্ষনাথ তার গান বেঁধে দিতেন, কিন্তু পরের দিকে তার গান তিনি নিজেই বেঁধেছেন । এন্টোনির গানে হিন্দু ধর্মের প্রতি গভীর বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা ফুটে উঠে । যেমন তিনি গেয়েছেন- 'আমি ভজন সাধন জানিনে মা/ নিজে ত ফিরিঙ্গি / যদি দয়া করে কৃপা কর/ হে শিবে মাতঙ্গী / ' ...আগমনী পর্যায়ের গানে তিনি আরও বলছেন- 'জয় যোগেন্দ্র জায়া মহামায়া মহিমা অসীম তোমার ...' শুধু গান গেয়েই থেমে থাকেন নি তিনি , কলকাতার বউবাজারে গড়ে তুলেছেন কালি মন্দির , যা ফিরিঙ্গি কালি মন্দির হিসেবে পরিচিত আজও । এন্টোনি ফিরিঙ্গির শেষ পরিনতি সম্পর্কে ইতিহাসে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
ফিরিঙ্গির সমসাময়িক প্রখ্যাত কবিয়াল যারা ছিলেন তারা হলেন- হরু ঠাকুর (১৭৩৮-১৮১২), ভোলা ময়রা , দাশরথি রায় , রাম বসু ( ১৭৮৬-১৮২৮) ।এদের ভিতর কয়েকজনের সাথে কবিগানের লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন, ফিরিঙ্গি । তাতে ভোলা ময়রা, রাম বসু, ঠাকুর সিংহ ছিলেন তার প্রতিপক্ষ । তবে আদি কবিয়াল ছিলেন গো্ঁজলা গু্ঁই (আনু জন্ম ১৭০৪ ) তার হাত ধরে আঠার শতকের শেষ দিকেই কবিগানের অসাধারন বিকাশ ও সমৃদ্ধি । তার পাশে ছিলেন, তার শিষ্যরা । লালু, নন্দলাল, রামজি, রঘুনাথ দাস । রঘুনাথ ছিলেন, দাঁড়া বা এইসব পর্যায়যুক্ত সুশৃঙ্খল কবিগানের প্রবর্তক । তার পরেইকবিগান ঐতিহাসিক তাৎপর্য অর্জন করে উনিশ শতকের গড়ার দিকে । এর নায়ক ছিলেন যারা , রাসু(১৭৩৫-১৮০৭) নৃ্সিঙ্ঘ (১৭৩৮-১৮০৭) হরু ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী (১৭৫১-১৮১৮) ভবানী বেনে, ভোলা ময়রাএবং আমাদের এন্টোনি ফিরিঙ্গি। অবশ্য উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিলগ্নে কবিগান গুরুত্ব হারাতে শুরু করে । কারন কবিগানের মূল ভক্ত ছিলেন, কলকাতার নব্-উত্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেনি । যারা পরবর্তীতে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির ছেলেদের প্রবর্তিত সঙ্গীতের উপর আগ্রহী হয়ে উঠেন । তারপরেও আজো কবিগান বাংলার গ্রামে গঞ্জে কবিয়ালদের কণ্ঠে জাগরিত হয়।