আশ্রম থেকে বাবার খোলা চিঠি

প্রিয় খোকা

ইদানীং স্মৃতিগুলো বড্ড বেশি বেয়াড়া হয়ে গেছে । তারা রীতিমত প্রতারণায় মত্ত । স্মৃতি হাতড়ে বহুদূর চলে যাই তারপরও তোকে খুঁজে পাই না । বয়সের ভারে অনেক স্মৃতিই এখন ধূসর কোনো কাব্যিক সংস্করণ । বাজান' তোর মনে আছে, ছোটবেলায় তোর বুক আমার বুকের সাথে না মিশালে তোর ঘুম আসত না ।

প্রায়ই তুই মাঝরাতে জেগে উঠতি । আমি সারারাত কত সব অদ্ভুত গল্প শুনাতাম । জানিস বাবা, আমার এখনও সব গল্প দিব্যি মনে আছে; একই ধরনের কাহিনী বারবার বলাতে, বোধ হয় আÍস্থ হয়ে গিয়েছিল । মনে আছে বাবা, মেট্রিক পরীক্ষার সময় তোর একবার কালাজ্বর হয়েছিল । পীর বাবার কাছে তোর নিথর দেহখানি নিয়ে গিয়েছিলাম; হুজুরকে আমি ডাক দিয়ে বললাম—প্রভুর কাছে আপনি একটু দোয়া করেন যেন আমার বদলে আমার বাজান বেঁচে থাকে ।

বৌমা, দাদু ভাইয়েরা কেমন আছে ? বৌমাকে তুই ভুল বুঝিস না । সে তো আমাদের রক্তের কেউ না । আমার জন্য চিন্তা করিস না । এই আশ্রমে আমি বেশ ভালো আছি । আমরা সব দিয়ে জনা পঞ্চাশেক বাবা আছি এখানে । এদের মধ্যে আমি বোধ হয় মানসিক দিক দিয়ে একটু ঢের অবস্থানে আছি; ওই হতভাগারা বেশির ভাগই ছেলে বা ছেলের বউর হাতের চড়-থাপ্পড়, লাথিগুতা খেয়ে এই আশ্রমে পাড়ি জমিয়েছে, সেই দিক দিয়ে আমি তোর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ ! আমার সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি, বোধ হয় ।

তুই যখন আমাকে আশ্রমে দিয়ে গেলি, আমি কিন্তু খুব স্বাভাবিক ছিলাম । আমি তোকে এত বেশি  ভালোবাসি যে তোর আশ্রমে দেওয়াটাকেই আমার কাছে অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে । বাজান আমি জানি, আমার জন্য তোরও খারাপ লাগে; না বাবা' মন খারাপ করিস না । আশ্রমে দেওয়া ছাড়া তোর আর কী-ই বা করার ছিল ?

জানি না কী হয়েছে, ইদানীং প্রায়ই তোর মাকে স্বপ্ন দেখি । কী কারণে যেন মৃত্যুকেই আমার সবচাইতে আপন মনে হয় । মনে হয়, মৃত্যুই হতে পারে আমার সাঁঝের মায়া । মৃত্যুই কেবল পারে পৃথিবীর দুর্গন্ধময় বাড়তি এই উপদ্রবকে থমকে দিতে ।  

আমি মারা যাওয়ার পর তোর বেশ কিছু পয়সা খরচ হবে । দাফন-কাফন, মিলাদ, চলি­শা আরও কত কি ? অহেতুক টাকা খরচ করার জন্য বৌমা বোধ হয় তোকে অনেক বকবে । বাজান তুই ভালো থাকিস । তুই  বড় হয়ে যাওয়ার কারণে তোকে জড়িয়ে ধরে বহুকাল চুমু খাওয়া হয় না । আমার মৃত্যুর পর পারলে তুই সেই কাজটি করিস ।