৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে যুদ্ধক্যাম্পে যোগ দেওয়া মায়ের কাছে লেখা আজাদের একখানা চিঠি ।

মা

আমার উপর রাগ করো না। এই প্রথম তোমার অবাধ্য হলাম। তোমাকে বললে আমাকে তুমি যুদ্ধক্যাম্পে আসতে দিতে না তাই তোমাকে বলার সাহস পাইনি। গতকাল আতিকের মাকে পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গেছে। তুমিই বলো মা, এই খবর শোনার পর আমি কী ঘরে বসে থাকতে পারি ? আমার এই দেশটা কী আমার মা নয় ? হয়ত তাঁকে মা বলে ডাকার সৌভাগ্য আমার হয় না কিন্তু তাই বলে কী আমার অনুভূতিতে তাঁর মমত্ব প্রবাহিত হয় না ! তুমিই বলো মা, তোমার ওপর কেউ আঘাত হানলে আমি কী ঘরে বসে থাকতে পারি ?

আমি ০৭ নং সেক্টরের অধিনস্থ আছি। সারা দিন ঘুরে ঘুরে আমি হানাদারদের অবস্থান নিশ্চিত করি এবং সেই খবর আমাদের ক্যাম্পে পৌঁছে দেই’ অতঃপর আক্রমণ। আমার মনটা একটু খারাপ। গতকাল আমার সহযোদ্ধা আরিফকে পাকিস্তানি হানাদারা মেরে ফেলেছে। মা, রাইফেল যে এত ওজন, আমি জানতাম না। রাইফেল বইতে বইতে আমার কাঁধে ঘা হয়ে গেছে; না মা’  আমার ঘায়ে যদি পোকাও পড়ে তারপরও আমার মাকে উদ্ধার না করে আমি তোমার কাছে ফিরব না ।

বাবার জন্য অনেক খারাপ লাগছে । প্রতিদিন ঘুমাবার আগে বাবা আমার দুই গালে চুমু দিয়ে যেত । এখন বাবা কী করে আমি জানি না। আমাকে ডাক্তার বানানোর জন্য বাবার অবিরাম প্রচেষ্টার কী হবে তাও বোধ করি আমি জানি না। আমি জানি মা, তোমরা কিছুতেই আমার বিষয়টা মেনে নিতে পারছ না। আমি জানি, এখানে আমার বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়ার সম্ভাবনা ঢের কিন্তু বিশ্বাস করো মা, আমি ভালো আছি। দেশ নামক মা’টার জন্য কিছু করতে পারছি, কী এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে বিহবল হয়ে আছি তা তোমাকে এই ছোট পরিসরে বোঝাতে পারব না । হানাদারদের মোকাবেলা যখন করি তখন শুধু একটা কথাই ভাবি—ওপরে আমার জন্য জান্নাত আর নিচে আমার মা। এই বোধের বাইরে অন্য কোনো বোধ এখনও আমার হৃদয় গহীনে বাসা বাঁধতে পারেনি ।


শিউলির খবর কী, মা ? আমার ইচ্ছা ছিল, একটা ভালো ছেলের সাথে শিউলির বিয়ে দেওয়ার । একটা ভালো ছেলে আমার পছন্দেরও আছে। না থাক, এখন বলব না। আল্লাহ্ যদি বাঁচিয়ে রাখে তবে তারপর। আমি যখন দরজার কপাট খুলে বের হই তখন আনুমানিক রাত ০৩ টা বাজে। লুনা, আমার দুই সন্তান মিতু, নিতু কিছুই টের পাইনি। অনেকটা চোরের মতোই বের হয়েছিলাম। মিতু আগের রাতে খুব করে একটা জামা কিনে দেওয়ার বায়না ধরেছিল, পরের দিন কিনে দেওয়ার কথা বলে ওকে ঘুম পাড়িয়েছিলাম। পারলে তুমি আমার মেয়েটাকে একটা জামা কিনে দিও।

মা তোমাকে যে আমি এত ভালোবাসি তা আমি আগে টের পাইনি। ক্যাম্পে আসার সময় আমার কেবলই মনে হয়েছে, পেছন থেকে কে যেন আমাকে বাজান বাজান' বলে চিৎকার করছে। না মা’ আমি একটি বারের জন্যও পেছনে তাকাইনি। মা তোমাকে বাস্তববাদী হতে হবে ।  আল্লাহ্‌প্রদত্ত নাড়ির টানকে কুরবান করতে হবে, আমাদের আর একটা অশরীরী মায়ের জন্য।

সত্যি কথা বলতে কী' মা, আমার জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরও আল্লাহ্ যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, দেখা হবে পাক-হায়েনামুক্ত খোলা আকাশের নিচে । স্বপ্নের স্বপ্নিল আরাধনায়। নতুন এক বেশে । স্বাধীন পতাকার নিচে আমরা সবাই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ধরে থাকব ।

লুনাকে নিয়ে আমি তেমন কিছু বলব না । তুমি যদি পারো ওকে একটু বুঝিয়ে বলো। আমার সন্তান দুইটিকে তুমি দেখে রেখো। আবারও তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আল্লাহ্ যদি বাঁচিয়ে রাখে দেখা হবে বিজয়ে ।


তোমার বাজান


পুনশ্চঃ না। আজাদ আর কখনোই ফিরে আসেনি । হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলা তাঁর আর দেখা হয়নি । খবরটা শোনার পর তাঁর মা ০৭ দিন বেঁচেছিল, অতঃপর। আজাদ শহীদ হওয়ার আগে একাই বেশ কিছু পাকিস্তানি হানাদার মেরে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল । তারই পরিণামে আজাদের বাড়িতে হানাদাররা পৈশাচিক আক্রমণ চালায় । আজাদের বৃদ্ধ বাবাকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে বিবস্ত্র করে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলা হয়। আজাদের দুই সন্তানকে বুটের নিচে পিষ্ট করে হত্যা করা হয় এবং আজাদের বোন শিউলি ও স্ত্রী লুনাকে হানাদাররা তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরের দিন তাদের নিতম্বের মধ্য দিয়ে বাঁশ ঢুকিয়ে গাল দিয়ে বের করা ক্ষত-বিক্ষত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায় নদীর ধারে ।

উপরের সব চরিত্রই প্রতীকী হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু স্বাধীন বাংলার পেছনের ইতিহাস এর চাইতেও ঢের করুণ । হাজারো আজাদ, হাজারো বাবা-মার চোখের জলের বিদীর্ণ পথ পেরিয়ে, লক্ষ শিউলি আর লুনার সম্ভ্রমের দামে কেনা আমার এই স্বাধীন বাংলা। এত মহানুভবতা, এত আবেগের জলাঞ্জলি, এত রক্তের দামে কেনা এই স্বাধীন বাংলাদেশ, আমরা যারা এখনও পরাধীন করে রেখেছি কব্জির জোরে অথবা নিজের স্বার্থের তিয়াসা মেটানোর জন্য—আমরা মোটেও হানাদারদের চরিত্রের বাইরের কোনো চরিত্র আজ অবধি হতে পারিনি ।


১১ ০১ ১৬