বাড়িতে পা দিতেই গা ছমছম করে উঠল।
শ্মশানের নীরবতা নতুন পাড়ার বাড়ি জুড়ে।
নতুন পাড়ায় বাবাই প্রথম বসতি তুলেছিল
এরপর এল বিজন বাবু, ওসমান কাকা।
নতুন পাড়া মুগ্ধনগর থেকে প্রায় শ’পাঁচেক
গজ দূরে, গাঙের কোল জুড়ে ব্যাঙের ছাতার
মতো দৈবাৎ গজে ওঠা তিনটে বাড়ি।
কাগজে কলমে আমাদের বাড়িটা মুগ্ধনগরে
হলেও গাঁয়ের সবাই বলত নতুন পাড়া।

যুদ্ধ শেষ। প্রায় সাত মাস পর
ফরিদপুর থেকে বাড়ি ফিরলাম।
ফরিদপুর ছিল আমার দক্ষিণাঞ্চল প্লাটুনের
সামরিক অধিক্ষেত্র।

দেউড়ি পেরিয়ে বাড়ি ঢুকতেই দেখি চৌকাঠের পাশে
খোলা রান্নাঘরে বাসি আটামাখা রুটি বেলার পিঁড়ি,
উঠোনে জলচৌকির পাশে গড়াগড়ি যাচ্ছে কুপি বাতির
গছা, এঁটো চায়ের কাপ ক্লান্ত হয়ে পড়ে আছে।
খড়ের বিরার ওপর কাঁত হয়ে আছে পানি রাখা পিতলের
কলসি। যেন সোজা হয়ে দাঁড়াতে হাত বাড়িয়ে বসে আছে
মহানুভব কোনো আগন্তুকের একটু অনুগ্রহের অপেক্ষায়।

এজাজের অতি প্রিয় আম আকৃতির ভাঙা মাটির ব্যাংক,
কয়েকটি খুচরো পয়সা, মলাট খোলা বই, এভারেডি কালির
শূন্য দোয়াত সবই বিশৃঙ্খলভাবে ছড়ানো বারান্দায়।
মাটিমাখা বাবার সেলুলয়েড চশমার ফ্রেম ও ক্রাচ দুটি
খুব অদরকারী চোলাই কাঠের মতো অযত্নে পড়ে আছে।
বাড়িতে মা-বাবা-এজাজ কেউ নেই।

কাউকে না পেয়ে মন উচাটন হলো।
অজানা আতংক নিয়ে দেউড়ি পেরিয়ে
খুলিঘর লাগোয়া বকুল তলে গিয়ে দাঁড়ালাম।
খুলিঘর ঘেঁষেই পতিত যৌবনা করতোয়া নদী
সে কেবল চলছে আগের মতোই।
পরিবর্তনহীন অন্ধ নদী যেন দেখেনি যুদ্ধ
শোনেনি গুলির শব্দ ও ধর্ষিতার চিৎকার
দেখেনি লাশপ্রিয় শকুনের ডানাঝাপটানি
দেখেনি আমার মা-বাবা-এজাজকে।

আমি অনুপুঙ্খ দৃষ্টিতে নদীর পারে
স্বজনদের ফেলে যাওয়া যে কোনো চিহ্ন খুঁজলাম।
আমার শঙ্কিত মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি মারল-
তারা কি নদী পার হয়ে কোথাও চলে গেছে
নাকি মিলিটারির হাতে ধরা পড়েছে?
কোথাও আমি তাদের চিহ্নের কোনো
লেশ পেলাম না।

প্রতিবেশী বিজন বাবুর বাড়ি গেলাম।
তারাও কেউ নেই। আগুনে পোড়া দশাসই বিজন কাকার
বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে ধোঁয়া-কালির কালো ছাপ এবং
হাড্ডিসার পোড়া গোবর ঘুঁটের যুগপৎ ক্যালিওগ্রাফি।
ঘরের পোঁতায় পড়ে থাকা আধাপোড়া টিনের কাঠামো
বাড়িকে বসবাসের অযোগ্য ও পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে।
পাশের ওসমান কাকার বাড়িও খাঁ-খাঁ বিরানভূমি।
আমি বিচলিত হয়ে নদীর পারে ফিরে এলাম।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
এতগুলো মানুষ গেল কোথায়?

যুদ্ধের মাঝে এক রাতের জন্য বাড়ি এসেছিলাম।
ভোরের আলো ফুটতে তখনও ঢের বাকি
মা আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় আমার হাতে
একটা খাবারের পুঁটলি তুলে দেয়।
এরপর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে আবিষ্ট মা অমঙ্গল গুণে
আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, খুব শক্ত করে। অনেকক্ষণ।
যেমন শক্ত ও নিবিড়ভাবে বাকল বৃক্ষের কাষ্টকে বুকে
জড়িয়ে রাখে।
অবশেষে
মা আঁচলে নাক মুছে আমার চিবুকে ও কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে
ধরা গলায় বলে-পথে খেয়ে নিস বাবা, সাবধানে থাকিস।
কুপির খাটো সলতের সতর্ক টিপটিপে নগণ্য আলোয়
শেষ রাতে মায়ের বিদীর্ণ অশ্রুতে সিক্ত হয় আমার চিবুক।

গাঙে দুর্বাদলের পরতে পরতে ফেলে যাওয়া
আমার সেই স্নেহময়ী মায়ের ছায়া তন্নতন্ন করে খুঁজলাম।
এখানেই মালা ছেড়া মুক্তোর দানার মতো আমি বিলিয়েছি
আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের পাক্বা উনিশটি বছর।
আমি শূন্যতার উদ্বেগে ডুবতে ডুবতে দুই মুঠোয়
দুর্বাকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে ডাকলাম-
মা...
বাবা...
এজাজ...
নদী হতাশামিশ্রিত আমার মুখস্থ কণ্ঠস্বরকেই
তরঙ্গায়িত করে ফেরত দিল।
বোবা করতোয়া মুখ ফুটে কিছুই বলল না।

বছর দুই আগে আমার ছোট বোন ফাইমা
অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য
পারাপারের নৌকা ধরতে
এখানেই দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করেছিলাম।
সেদিন এখানেই শিকারি কুকুরের মতো
আমাদের গা শুঁকে গিয়েছিল
এক দল সাঁঝের বাতাস।
ফাইমার মরদেহ যেদিন ফিরে আসে সেদিনও
বাতাসমণ্ডলী আমাদের আহাজারি ও দীর্ঘশ্বাস
স্বউদ্যোগে জমা নিতে এসেছিল।
আমি হন্তদন্ত হয়ে তাদের খুঁজলাম।
আজ তারা কোথায় কে জানে!
তারা তো মা-বাবাকে চেনে।
আমি দ্বিগুণ উদ্বেগ নিয়ে ঘরে ফিরলাম।
চৌকাঠ থেকে বিচ্ছিন্ন একপাশ ভাঙা দরজার
এক পাল্লার লোহার কড়ায় এখনও ঝুলছে পিতলের তালা
পুরো ঘরের জিনিসপত্র ভেঙ্গে তছনছ আর এলোমেলো
হা করা ঠুলির মতো ভাঙা টিনের দেওয়ালে গুলির চিহ্ন।
আমার বুক ধ্বক করে ওঠে।
গুলি!
সাথে সাথে আমার হাত চকিত হয়। অবচেতন মনে
গলায় ঝোলানো স্টেনগানের ট্রিগারে আঙুল চলে যায়।
যুদ্ধদিনের মতো পাল্টা গুলির জন্য প্রস্তুত হই।
পরক্ষণেই ভুল বুঝতে পারি। যুদ্ধ তো শেষ।
আমার চোখ ভারি হয়ে আসে।
আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লুই ব্রেইলের মতো দেওয়ালের
গুলিরন্ধে আঙুল বুলিয়ে চিৎকার করে উঠি-
মা...
বাবা...
তোমরা কোথায়?
কান্না ও কষ্টমাখা নিজের চিৎকারের প্রকোষ্ঠে
আমি হারিয়ে যাই।

বাবা রেডিও শুনতেন।
চৌকির বালিশ ঘেঁসে টেবিলের
ডান পাশে খেয়াল করি
ধূসর রংয়ের বাবার টু-ব্যান্ড ফিলিপ্স রেডিওটিও
সেখানে নেই।
ভাঙা খেলনার মতো ওটার দেহাবশেষ  
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ঘরময়
সম্ভবত ওটার ওপরও চলেছে গুলি।
এ রেডিওতেই শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধুর বজ্রমন্ত্র...
‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে
শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে...’

এ রেডিওর চকচকে এ্যান্টেনা তুলে শর্ট ওয়েভে
আমরা খুব সতর্কভাবে লো ভলিয়মে
বিবিসি শুনতাম, আকাশবাণী শুনতাম
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতাম।
সন্ধ্যা হলেই খবর শুনতে প্রতিবেশীরা লার্ভাকীটের মতো
পাট খেতের আল পেরিয়ে
ভয় ও ভীতি নিয়ে ভিড় করত আমাদের উঠোনে
তাদের শুকনো ফাটা ঠোঁটে প্রকাশ্যে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও
জেলির মতো কালো ঘন চোখে লেখা থাকতো হাজারো প্রশ্ন।

যুদ্ধের মাঝামাঝি জিলা স্কুলের শিক্ষক ফজল মাস্টার
শহর থেকে পালিয়ে আমাদের মুগ্ধনগরে আশ্রয় নিয়েছিল।
তিনি এক সন্ধ্যায় হাঁসপাস করে এসে নিচু কণ্ঠে বাবাকে বললেন-
বখতিয়ার সাহেব, কিছু শুনেছেন, কাগজে নাকি বেরিয়েছে-
ঢাকায় টিক্কা খান মুক্তিযোদ্ধার হাতে মারা পড়েছে
পাঞ্জাবীরা তো এবার মরিয়া হয়ে মরণ কামড় দেবে।
আমাদের ছেলেরা তবে কী শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারবে?
অসহায়ত্ব বাবার মুখের চোয়ালটাকে
রেলওয়ের স্টিল স্লিপারের মতো শক্ত করে তুলেছিল,
তার কোনো উত্তর ছিল না।
মাস্টার সাহেবের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে বিষন্ন মনে
আমার শভিনিস্টিক বাবা কাঠের ক্রাচদুটো ঠাস ঠাস
শব্দ করে ডান পাশ থেকে সরিয়ে বাম পাশে রেখেছিল।
আমি বুঝেছিলাম এ শব্দই বাবার প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর।
একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কেরানির
যুদ্ধ নিয়ে আর কিই বা জবাব থাকতে পারে?
বাবা একদিন ফজল মাস্টারকে গলা উঁচু করে নাকি
বলেছিল- মাস্টার সাহেব, আগরতলা ক্যাম্পে
আমার সুখিন ভালোভাবে সামরিক ট্রেইনিং শেষ করেছে।
আগামী মঙ্গলবার প্রথম অপারেশন।
এখন সত্তর জন মুক্তিযোদ্ধার প্লাটুন কমান্ডার সে।
ওর জন্য দোয়া করবেন। আজ চিঠি পেলাম।
ফজল মাস্টারের নিকট করা বাবার এই গর্বের স্বাদ
আমি ফিরতি চিরকুটে পেয়েছিলাম।
জুনের মাঝামাঝি এক বাদলা দিনে ইশতিয়াক
বাবার সেই চিঠি আমার হাতে গুঁজে দিয়ে
আগরতলা থেকে সোজা কলকাতায় চলে যায়।

ইশতিয়াক ছিল প্রাক্তন মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট,
আরমানিটোলায় লজিং থাকতো
পোস্টার লেখায় ছিল ওর দুর্দান্ত হাত।
প্লাকার্ড ও ঢাকার দেওয়ালে দেওয়ালে
পাকিস্তান জিন্দাবাদের
পরিবর্তে সেই লেখা শুরু করে-
‘তোমার আমার ঠিকানা
পদ্মা মেঘনা যমুনা’
‘পিণ্ডি না ঢাকা
ঢাকা ঢাকা’
‘তুমি কে আমি কে
বাঙ্গালী বাঙ্গালী’
‘জয় বাংলা’
এমন সব রক্তটগবগে শ্লোগান।

আঞ্জুমান আরার কথা বলতে গিয়ে
ইশতিয়াক ডান হাত তার ট্রাউজারের পকেট থেকে
বের করে আমার কাঁধে আলতো রেখে বলেছিল,
সুখিন, আমাদের একটা খারাপ খবর আছে।
বিশেষ করে তোর জন্য। মন শক্ত কর। আঞ্জুমান আরা...
না থাক, এসব নিয়ে একদম ভাবিস না।
স্বাধীনতার বিনিময়ে যে কোনো পরিণতির জন্যই
আমরা শপথ নিয়েছিলাম।
দেশ স্বাধীন হোক।
তা ছাড়া আমরা যে কেউ যে কোনো দিন চলে যেতে পারি।
তোর, আমার, আঞ্জুমান আরা-
আমাদের সবার লক্ষ্য তো একটাই-স্বাধীনতা।

মাথা নিচু করে আমি ইশতিয়াকের কথা ভাবতে থাকি-
সে কোথায়?
নভেম্বরের প্রথম দিকে ভারতের সুতানটি শরণার্থী শিবিরে
রেশন বন্টনের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় দ্য স্টেটসম্যান
পত্রিকায় ওর একটা ছবি দেখেছিলাম।
পাশে ছিল আমাদের এক ডাকসাইটে নেতা।
ইশতিয়াক কি ফিরেছে?

আঙিনায় একটি লকলকে মানকচু গাছ।
তার পাতাগুলো খুব সজীব, গভীর সবুজ
কোনো ক্লেদ নেই, মলিনতা নেই তাতে।
সে যেন হাতিকান করতল প্রসারিত করে  
পতাকার মতো মেলে ধরেছে অনাগত আগামী।
তার খোলা মুষ্টিতে আমার চোখে ক্রমশ স্পষ্ট
হয়ে ওঠে এক নতুন মানচিত্র, নতুন বাংলাদেশ।

ঘরের বাম দেওয়ালে চোখ পড়তেই শিউরে উঠি।
চৌকি থেকে আমার মাথাসমান উঁচুতে স্থাপিত
আট বাই ছয় ফ্রেমে বাঁধানো ফাইমার
সাদাকালো একমাত্র ছবিটিও সেখানে নেই।
ভাঙা চিমনির হারিকেনটা কেবল দক্ষিণ দেওয়ালের
গজালে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মতো ঝুলছে।

কাঠের আনালার ওপর দু-তিনটে পুরাতন কাপড়।
বাবার তিলে পড়া আকাশি হাওয়াই শার্টের পাশপকেটে
উঁকি মারছে ক্যাপস্ট্যান সিগারেটের প্যাকেট।
ঘরে এক অচেনা কটু গন্ধ। সম্ভবত অনেকদিন
কেউ বসবাস করে না। আলো আঁধারির মালিকানায়
ঘরে যেন জমাট বেঁধেছে আইবুড়ো অভিমান।
ঘামমাখা নলপাটির শোবার বিছানায় জেঁকে
বসেছে বরফকুচির মতো মেনি মুখো ছত্রাক।
হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারের ওপর
এজাজের ছোট্ট তালপাখাটাও
নিঃসঙ্গতায় হুহু করে ডুকরে কাঁদছে।

মায়ের হাতের ক্রুশকাঠিতে বুনানো
কাচে বাঁধা একটা আয়তাকার ওয়ালম্যাট
খুলে পড়তে গিয়েও কী মনে করে
উত্তর জানালার ওপর রুইতনের টেক্কার মতো
টেরচা হয়ে ঝুলে আছে।
নীল জমিনে সাদা সূতায় পরম মমতায় তাতে লেখা-
‘যাও পাখি বল তারে
সে যেন ভোলে না মোরে।’
আমার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে।
আমি চিৎকার করি-
মা...
এবার আমার কান্নার কোনো প্রতিধ্বনি হয় না।
বুঝতে পারি, আমি খুব একা।