কিরণের সাথে আমার দেখা হয়েছিল খুব ভোরে, খুলনা রেলস্টেশনে।
তার সাথে কোনো বাক্স-প্যাটরা ছিল না। মুখটা ছিল শুকনো দুর্বার মতো
মলিন ও নির্জীব। নরকের আগুনের মতো লাল চোখের নিচে কালো দাগ
দেখে সহজেই অনুমান করা যায় খুব নির্ঘুম কেটেছে ওর বেশ কিছু রাত।
কিরণের থুতনির নিচে শণের মতো গজে ওঠা দাড়িতে যেন দিব্যি ঝুলছিল
উদ্বেগের কুণ্ডলী।

ওর পড়নে ছিল লুঙ্গি আর পুরাতন পলো শার্টের উপর বরফিকাটা
সাদা-নীল চেক সোয়েটার। কানের উপর ধূসর এন্ডিকটন নেট মাফলার।
পা খালি।
কুয়াসাচ্ছন্ন ডিসেম্বরের হিম কাকপ্রভাতে ওকে এভাবে প্রথম দেখায়
খুব চমকে গেলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করার পর কিরণের সাথে দ্বিতীয়বার আমার দেখা হয়নি।
আমরা একই আবাসিক হলের পাশাপাশি ঘরে থাকতাম।
কিরণ থিয়েটার করতো। শেকড় নাট্যচক্রের সেই ছিল প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, দেখিস শেকড় ধরে ঝুলতে ঝুলতে
তোর শেকড়ে যেন আবার টান না পড়ে, উপড়ে যেন না পড়িস।

আমি খুব অবাক হয়ে ওকে একগুচ্ছ প্রশ্ন ছুঁড়েদিলাম-
কিরণ তুই?
এভাবে, এত সাত সকালে?
কোথায় যাস?
বাসন্তী কোথায়?
একটু কাছাকাছি এগিয়ে সহাস্যে দুহাত বাড়িয়ে
ওর সাথে বুকে বুক মেলাতে চাইলাম। দীর্ঘদিন পর দেখা বলে কথা।
কিরণও কাছে এসে কোলাকুলি করল বটে কিন্তু মনে হল
ওর ভেতরে প্রাণ নেই, যেন ওর চওড়া দেহটা
আস্ত একটা শুকনো পাম গাছের গুড়ি। ওর মুখেও কোনো কথা আসছিল না,
আঠায় যেন জমে গেছে মুখ।
কিরণের আচরণে এমন অস্বাভাবিকতা দেখে আমি যারপরনাই অবাক হলাম।
মনেমনে ভাবলাম-কিরণ কি আমার নাম ভুলে গেছে?
কিরণ ছিল খুবই বন্ধুপ্রিয় ও হৃদয়বান একটি ছেলে।
গোলাপ জলের মতো ওর চরিত্রের নিজস্ব একটি সুবাস ছিল।
আর ও খুব সহজেই যেকোনো মানুষের সাথে মিশে যেতে পারতো।
এই গুণের জন্য আমরা ওকে মাঝেমধ্যে মশকরা করে বলতাম,
তুই পুরাদস্তুর একটা গোলআলু।
যেকোনো তরকারিতে সহজেই মানিয়ে যাস।

দীর্ঘদিন কিরণের কোনো সংবাদ রাখিনি। তার সাথে এ সাক্ষাৎ
যেন আমার সংকীর্ণ সেই অপরাধবোধকেই প্রজ্বলিত করছিল।
তা ছাড়া নিজের কাছে খুব লজ্জাও লাগছিল। কষ্টও হচ্ছিল।

কিরণ হল থেকে বিদায় নেওয়ার আগের রাতে ঝড়ের বেগে
আমার ঘরে আসে। বুক সেলফ থেকে আমার অক্সফোর্ড ডিকশনারিটা
টেনে নিয়ে তাতে ইকোনো বলপয়েন্টে তার স্থায়ী ঠিকানা লিখে
বলেছিল, ডায়রিতে লিখে দিলে হয়তো ফেলে দিবি।
ডিকশনারি সহজে কেউ ফেলে না। তাই এখানে লিখলাম।
ইচ্ছে হলে লিখিস। অথবা অপ্রয়োজনীয় মনে হলে ছিঁড়ে ফেলে দিস।

আজ কিরণকে দেখে আমার সেই ময়ূরকণ্ঠীনীল মলাটের
ডিকশনারির কথা মনে পড়ল।
শব্দ খুঁজতে গিয়ে অনেকবার ওর ঠিকানাটায় চোখ পড়েছে।
কিন্তু সত্যিকারের তাড়না থেকে কখনও কিরণকে লেখার তাগিদ
অনুভব করিনি। তাই দিনে দিনে ওর লেখা ঠিকানার অক্ষরগুলো
যেন অঙ্গারের মতো ক্রমশ জীবনের উষ্ণতা হারিয়ে চোখ সওয়া
খুব সাধারণ কয়লা রঙের অক্ষরে পরিণত হয়েছিল।
কথায় বলে, চোখের আড়াল হলে নাকি মনের আড়াল হয়।
কিরণ ও আমার ক্ষেত্রে এ প্রবাদই যেন মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছে।

কিরণের কী হয়েছে? ও কী কোনো সংকটে আছে?
চাকরি-বাকরি না ব্যবসা কিসে থিতু হয়েছে কিরণ?
-আমি প্রশ্নগুলোর মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলেও
আজ এসব বিষয় ওর সামনে মুখে আনতে খুব বেমানান লাগছে।
অনুভব করছি সময়ের ব্যতিচারে আমাদের পারস্পরিক অধিকারও
অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে।
তবুও স্বান্তনা পেতে নিজেকে বুঝ দেই, কিরণের হয়তো
এর মধ্যে ঘটে গেছে কোনো ঘটনা যা আমার জানার সুযোগ নেই।

আমি কৌতূহল দমাতে না পেরে আবার বললাম-
কিরণ, তুই কোথায় যাস?
চুনটানা দেওয়ালের মাঝে দুটি কালো হরফের মতো
নিষ্প্রাণ চাহনিতে সে আমার দিকে নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকল।
তার চোখের পর্দায় হয়তো ঝিলের ফোটা কমলের মতো
অনেক জবাব ভেসেও ওঠল। কিন্তু মুখে কোনো জবাব না দেওয়ায়
আমি তা বুঝে উঠতে পারলাম না।
নিরুপায় হয়ে আমি ডান হাতে ওর কাঁধ শক্ত করে
ধরে একটা ঝাঁকুনি দিলাম-কিরণ আমাকে শুনতে পাচ্ছিস?
চিনেছিস তো আমাকে? আমি...
কিরণ বরফ হিম হাতে আমার বাম হাত চেপে ধরে বলল, কোথায় যাস?
আমি বললাম, সান্তাহার। তুই?
জানি না নেয়ামুল।
আমি আর থামতে পারলাম না। কী হয়েছে তোর?
কিরণ খুব নিচু স্বরে বলল, তোর কাছে পানি হবে? একটা সিগারেট?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম-চল, খুব শীত। প্লাটফরমের ঐ মাথায়
চায়ের দোকান আছে। চা খাবি?
হাঁটতে হাঁটতে আমি নাছোড়বান্দার মতো ওকে চেপে ধরলাম,
তোর কী হয়েছে? তোকে এমন উদভ্রান্ত লাগছে কেন?
আমাকে খুলে বল। প্লিজ।
কিরণ আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল, ট্রেনের ঘন্টা দিয়েছে
সেই কখন! আসছে না। ট্রেন ঠিকঠাক আসবে তো আজ, কিছু জানিস?
আমি হাত ধরে টেনে চা দোকানির সামনে পাতানো একটা বেঞ্চে ওকে
বসাতে চাইলাম।

হিম শীতে দুপায়া আর্চের মতো ও ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকল, বসল না।
আমি আর কোনো কথা খুঁজে পেলাম না।
দুজন গেরুয়াবসন মালবাহক সকালের নিস্তব্দতাকে চূরমার করে দিয়ে
বিকট শব্দে মালবোঝাই একটি লোহার ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল
পলেস্তারা উঠে যাওয়া অসমতল প্ল্যাটফরমের উত্তর থেকে দক্ষিণে।
উভয়েই আমরা টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনচিত্রের মতো সেদিকে
বিনা প্রয়োজনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম।
ট্রলির চাকার শব্দের গভীরে বেঁচে থাকা জীবনের বিষণ্ণতা
আমাদেরকে যেন হঠাৎ কুয়াশাকণার মতো ঘিরে ধরল।
আমি চোখ থেকে চশমা খুলে চশমার কাচে লেগে থাকা
বিমর্ষতাকে মুছে নিয়ে বললাম,
তুই কি এখনও থিয়েটার করিস?
আমি দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করলাম, বাসন্তী কোথায়?
কিরণ এবারও আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।
আমার কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করল না।

বাসন্তী ছিল আমার এক সহপাঠীর ছোট বোন।
আমারা যখন মাস্টার্সে তখন বাসন্তী ফলিত পদার্থে থার্ড ইয়ারে।
খুব ভালো আবৃত্তি করতো। পারিবারিক সিদ্ধান্তেই বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনের
শেষ শরতে কিরণ বাসন্তীকে ঘরে তুলে নেয়।

চা দোকানি কাপে লিকার মেশানোর ফাঁকে রেডিওর নব ঘুড়িয়ে
বিবিসি ধরল। সিরাজুর রহমান প্রভাতিতে ঘণকণ্ঠে বলছে,
ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গায় বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া
লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিক্রিয়াশীলরা দেশের বিভিন্ন স্থানে
সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নারীদের হেনস্তা করছে।...

আমি লক্ষ্য করলাম কিরণ কান দুটো যেন খরগোশের মতো
তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর করে সিরাজুর রহমানকে শুনছে।
আমি ওর মগ্নতা কাটাতে বললাম, মেশো কেমন আছেন?
প্ল্যাটফরমের ছাউনির পুরাতন টিনের একটি ছোট ছিদ্র দিয়ে
টর্চের আলোর মতো উজ্বল ভোরের আলো আসছে।
কিরণ ওদিকে তাকিয়ে হড়বড় করে বলল, ওদের বলেছি-
যে যার মতো চলে যেতে। আমি এককাপড়ে চলে এসেছি,
মাঝরাত থেকে এখানে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি।
কারও খবর জানি না।

একটি লোকাল ট্রেন এল।
সে চা দোকানিকে উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল, এ ট্রেন কোথায় যাবে?
দোকানদার মুখের ভাঁজে নিমতিতা বিরক্তি টেনে বলল, আপে।
বেনাপোল?
না, যশোর।
কিরণ সিগারেট শেষ না করেই ফেলে দিল।
হুরমুড় করে ওদিকে দৌড়াতে চাইল। তারপর কী মনে করে
আমার দিকে তাকাল।
তার দৃষ্টিতে শিকড়সুদ্ধ এক উপড়ে পড়া গাছের ছায়া।
যাই। ভালো থাকিস নেয়ামুল। এ দেশে ভালো থাকিস।