রাস্তায় খুব ট্রাফিক। অফিসে পোঁছাতে বেশ দেরি হয়ে যাবে।
এক বাটা সিগন্যালে আটকা পড়ে আছি প্রায় পঁচিশ মিনিট।
অথচ জরুরি বোর্ড মিটিং আছে।

ফোন বাজছে। অচেনা নম্বর। কয়দিন হলো এ ফোন আমাকে
তাড়িত করছে। এ নম্বর থেকে ফোন বাজলেই চোখে খুদিশাপলার
মতো ভাসছে আমার অতীত। মন বলছে, এটা ধর্মদাসই হবে।
ওর ফোনে বিরক্ত হই বলে সে মাঝে মাঝে অচেনা নাম্বার থেকে
ফোন করে। ফোন তুললেই হয়তো ওদিক থেকে কানে আসবে
ধরা গলার এক মাতাল কণ্ঠ। সাতসকালে ফোনটা ধরে মন তেতো
করতে চাই না।

ধর্মদাস আমার স্কুল জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
স্কুল ও কলেজে সেই ছিল আমার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে
ভালো বন্ধু। আমি জানি, আমার কাছে সে হয়তো খুব অল্প চাইবে।
এই বাজারে এক পুড়িয়া গাঁজা কিংবা এক বোতল ফেন্সিডিল
কেনার জন্য কয় টাকাই বা লাগে!
এও জানি, এটা সে সরাসরি বলবে না। বলবে একটু ঘুরিয়ে-
যেমন: মেয়েটার গৃহশিক্ষকের বেতন দিতে পারছি না তিন মাস।
বন্ধু, কিছু টাকা ধার দাও। পাঁচ হাজার, তিন হাজার, ন্যূনতম
এক হাজার দাও। এক হাজার টাকা তো তোমার কাছে কোনো
টাকাই না। বিকাশ নাম্বার দেবো?
এই এক হাজারে হয়তো ধর্মদাস লাভই দেখবে শতভাগ।
এ টাকা হলে সিদ্ধি সেবনে অন্তত সাত দিন ওর নিশ্চিন্তে
চলে যাবে।

এবার ক্ষুদে বার্তা চোখ পড়ল। খুব বিপদে আছি, ফোনটা ধর।
-ধর্মদাস।
ধর্মদাসের বিপদের কথা জেনে আঁতকে ওঠলাম।
ওর ক্ষুদ্র আহূতি আমাকে আড়ষ্ট করে তুলল।
ফোনে টুকটাক দু-চারবার কথা বলা ছাড়া ওর সাথে
আমার অনেকদিন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই।
তবে আমার কাছের বন্ধু বলে পরিচিতজনরা আমাকে
ওর খবর নিয়মিতই দেয়।

কলেজের প্রথম দিক থেকে বদলে যেতে থাকে ধর্মদাস।
নেশা তাকে পেয়ে বসে। দিনে দিনে নেশায় চুড়মত্ত হয়।
গাঁজার কলকিতে টান দিয়ে ও যখন বিশেষ কায়দায় রুপার
ব্রেসলেটের মতো ধোঁয়ার বৃত্ত বাতাসে ছেড়ে খেলা করত
তখন নিদ্রালুতার স্বপ্নভঙ্গ আমাকে বিচলিত করে তুলতো।
ওর বাবা ধীরেন কাকা ছিল নিছক মাটির মানুষ। ধর্মদাসের
এমন অধোগমন দেখে ওর বাবার জন্যও আমার খুব করুণা হতো।
কতবার কতভাবে ধর্মদাসকে ওপথ থেকে ফেরাতে চেষ্টা করেছি,
কিন্তু কে শোনে কার কথা! শতভাগ ব্যর্থ হয়েছি।
দীপান্বিতাও চেষ্টা করেছে। সেও পারেনি।
শেষমেষ আটপৌরে জীবন ছেড়ে নির্বিকল্প দীপান্বিতাও
দুই সন্তান ফেলে তাকে নিঃস্ব করে চলে গেছে।
কিন্তু নেশা ধর্মদাসকে ছাড়েনি।

ধর্মদাস তরুণ বয়সেই রুচিতে ছিল খুব আধুনিক।
লো-টিউন্ড গিটারে বনিএম এর রাশপুটিন ওর মুখেই প্রথম শুনেছি।
ভালো ক্রিকেট খেলতো। সেকেন্ড ক্লাস ক্রিকেটে পয়েন্টে
ওর জন্টি রোডস এর মতো ফিল্ডিং প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হতো সকলে।
আমরাও ওকে তারিফ করে ডাকতাম-‘জন্টি’।  
সে সময়ে সবাই সাহিত্যের নামে ছাইপাশ গিলতো। কিন্তু সে ছিল
ব্যতিক্রম, নিখাদ রবীন্দ্র ভক্ত। পুরোহিত পিতার সন্তান হয়েও
ধর্মের প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা ছিল না। সে ছিল শতভাগ
অসাম্প্রদায়িক, আধুনিকমনস্ক একজন পূর্ণাঙ্গ মুক্তমনা মানুষ।

অনেক দিন দেখা নেই। দীপান্বিতার সাথে ওর বিচ্ছেদের পরপরই
ধর্মদাসের সাথে আমার যোগাযোগ বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
সে সময় শত চেষ্টা করেছিলাম ওদের সংসারটা টেকাতে। পারিনি।
তারপর থেকেই বলা যায়, ব্যক্তিগত রাগ আর অভিমান থেকেই
ধর্মদাসের সাথে ছিন্ন করি সব যোগাযোগ।

ধর্মদাসের সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ওর বাবার মৃত্যুর পর।
ধীরেন কাকার শবযাত্রায় ধর্মদাসের সাথে হাঁটতে হাঁটতে
শিমুলতলা শ্মশানঘাট পর্যন্ত গিয়েছিলাম।
ধর্মদাস সেদিনও ছিল নেশায় বেঘোর। খুব লাল ছিল ওর ঘুম ঘুম
টোপা টোপা চোখ। গায়ে রংজ্বলা একটা লালজবা প্রিন্টেড শার্ট দেখে
বুঝেছিলাম ধর্মদাস ধর্ম বিশ্বাসের খোলনলচে পাল্টায়নি। তবে ওর
দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে পানের কষের কালো দাগ যেন উচ্চারণ
করছিল বিপন্ন নাগরিকতার বিজ্ঞাপন। আর চিতার আগুনের বিপরীতে
ওর কুঁচকে যাওয়া ম্রিয়মাণ ত্বকে যেন জেঁকে বসেছিল ক্লান্তির শিল্পকলা।

ধর্মদাস নিমতলি হাটে ভাঙ্গারি ব্যবসা করে। মরিচা ধরা গাঢ় ধূসর
রং ঢেউটিনের আধো অন্ধকার এক টঙ ঘর, দোকান ঘর তো নয়
যেন মাকড়সার জালের আস্তানা। অবাধে তাতে ইঁদুরের যাতায়াত।
সেই দোকান একদিন খোলে তো তিন দিন বন্ধ থাকে।
দোকান ঘরটা যেন ধর্মদাসের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
এই সমাজে আমরা যাকে প্রতিষ্ঠা বলি, ধর্মদাস তার কানাকড়িও
অর্জন করতে পারেনি। বিএ পরীক্ষায় ড্রপ করে পড়াশুনা ছেড়ে দেয়।
রাজনীতিতে নাম লিখিয়েও সে অর্থে এগুতে পারেনি, ভাটির স্রোতে
হারিয়ে যায়। অথচ ওর এমনটি হবার কথা ছিল না। ভালো ছাত্রের
তকমা ছিল তার। সেই যুগে এসএসসিতে স্টার মার্কড পাওয়া
ডিস্‌ট্রিক্‌ট ফার্স্ট ছাত্র জীবন যুদ্ধে এতটা ব্যর্থ হবে তা একেবারে
মেনে নেওয়া যায় না।

এই যে, আবার কল দিয়েছে।  
ওর ফোন ধরে যা শুনলাম তার জন্য আমি কোনো মতেই
প্রস্তুত ছিলাম না।
তার বড় ভাইয়ের লিভার সিরোসিস হয়েছে। চিকিৎসার জন্য
অনেক টাকা প্রয়োজন। এলাকায় এক দপ্তরে লোক নেবে।
আমি যেন একটু হ্যালো বলে দেই। সে একজনকে ঠিক করেছে
চাকরি দেওয়ার প্রতিদানে তার কাছে কিছু পয়সাপাতি নিতে চায়।
সে টাকায় বড়দা’র চিকিৎসা করাবে।

আমি মুহূর্তের উদাসীনতায় মূঢ় হয়ে গেলাম।
এই সেই ধর্মদাস, যে রবীন্দ্রনাথ পড়তো? নেশার জারণে তার
এত ক্ষয়, এত বিচ্যুতি!
আমি আমার চেনা ধর্মদাসকে আজ চিনতে পারি না। নিজের মধ্যে
ক্ষরণ ধ্বনিত হতে থাকে-এই সেই ধর্মদাস, যে কিনা কলেজের
প্রচণ্ড বিরুদ্ধ দিনে মিছিলে ঘাম ঝরিয়ে শুদ্ধ চেতনার শ্লোগান দিত,
সেই কিনা আজ চাকরির লোক নিয়োগে দালালি করবে?
নেশার কাছে আপাদমস্তক আত্মসমর্পণকারী ধর্মদাস কি এখন
দারিদ্রের কাছেও মাথা অবনত করবে?
দারিদ্রের সাথে আপস করে মানুষ ঠকাবে?
মানুষ এতটা ভঙ্গুর?

সমান্তরাল এক প্রতিভাবনাও আমাকে পেয়ে বসে।
-নেশা ও জীবন যুদ্ধে পর্যুদস্ত মধ্যজীবনের ধর্মদাসের কাছে
ব্যারোমিটারের কাঁটা ধরে কৈশোরের আদর্শ তালাশ করা খুব
সমীচীন কিনা?
পরক্ষণেই মনে হয়-সোনালী স্বপ্নের অঙ্কুরিত প্রভাত গ্রহণের
অমানিশায় ডুবে লীন হবে, এটা কখনো, কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই
কাম্য হতে পারে না। ধর্মদাস যে মানুষ! মানুষ তো এত ক্ষুদ্র কিছু না।
মানুষকে হতে হবে মানুষেরই সমান।

ধর্মদাসের ফোনের জবাবে আমি খুব বিনত কণ্ঠে আর্তনাদের সুরে
ওকে আশ্বস্ত করলাম-ধর্মদাস, ভাবিস না। দেখিস, বড়দা বেঁচে যাবে।
এরপর আমার আর গলা ওঠেনি। আমি অশাব্দিক শব্দে ওর সাথে
বাকি আলাপ সারলাম-ধর্মদাস তুই জানিস, আজ ঘোর পরকাল?
তোর মৃত্যু হয়েছে? অথচ তোর মৃত্যুর পর আমাদের এ পরাবাস্তব
আলাপচারিতা আমার কাছে যেন খুব বাস্তব মনে হচ্ছে।

রাস্তায় জ্যাম ছুটে গেছে। জমে যাওয়া গাড়িগুলোও সচল হতে
শুরু করেছে। আমার কানে চারপাশের গাড়ির হর্ন। সেই কোলাহল
ভেদ করে একজন সংবাদপত্রের হকার চিৎকার করে বলছে, এই যে
পড়ুন মানবতার খবর-বড় ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য ধর্মদাসের কিডনি
বিক্রির বিজ্ঞাপন।

সংবাদপত্রের ছবিতে আমার চোখ আটকে যায়। আমি স্পষ্ট শুনতে পাই,
একজন পথচারী ফিসফিস করে বলছে-
ধর্মদাস বেঁচে থাক, ধর্মদাসরা বেঁচে থাক।
ধর্মদাসরা হেরে যায়, কিন্তু পরাজিত হয় না।