মনীষা
মনোতোষ কুমার মজুমদার

কন্যা সন্তান বলে বাবা-মার বিন্দুমাত্র দুঃখ ছিল না।
দরিদ্র বাব-মার আদুরে দুলালি হয়েই বনলতার মত সবুজ হয়ে বাড়ছিলাম।
ভালোবেসে বাবা-মা নাম রাখল মনীষা।
জানিনা কেন আমার এমন নাম রাখা হল?
স্কুলে গেলে শিক্ষক মহাশয়দের কাছে জানলাম আমার নামের অর্থ প্রতিভা।
আমার কোন প্রতিভা ছিল কিনা জানিনা।
তবে সহজেই মিশতে পারতাম সকলের সাথে।
খুব কথা বলতাম বলে প্রতুল স্যার আমায় কথারানি বলে ডাকত,
প্রতিমা ম্যাডাম বলত ফুলটুসি।
চারিদিকে ছিল মুঠো মুঠো খুশি, হৃদয়ে ছিল প্রত্যয়।
গরিব বাপের জীর্ণ কূটিরেই ছিল অনন্ত সাগরের দুরন্ত চঞ্চলতা।
যে চঞ্চলতায় ছিল নিজেকে প্রকাশের অসীম টান।
ঠিক তখনি প্রকাশের প্রকাশ আমার জীবনে।

বল্গাহীন উশৃঙ্খলতার উন্মত্ত প্রকাশ প্রকাশের মাঝে।
তার দানবীয় ললুপতায় আমার জীবনের নীল নিলীমায় ফেলল নিকষ কালো ছায়া।
কথারানির কথা গেল হারিয়ে, হারিয়ে গেল ফুল্টুসির ফুলেল সৌরভ।
প্রকাশের হিংস্র চাহনির কাছে ধর্ষিত হচ্ছিলাম প্রতিদিন।
তার বিষময় কটূক্তি জ্বালা ধারাত নিশিদিন।
কিন্তু আশ্চর্য লাগত হাটে বাজারে প্রকাশের লাম্পট্যের কাছে সভ্যতা ছিল প্রতিবাদহীন।
প্রকাশের অসভ্যতার বল্গাহীনতা সহ্যের সীমা ছাড়াল।

গর্জে উঠলাম মান হারা বাঘিনীর মত।
আমি যে তিল তিল করে হারাচ্ছিলাম নারীত্বের সম্মান, মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার সম্মান।
অপমানে দীর্ণ হতে হতে মনীষারা একদিন বাঘিনী হয়ে যায়।
নারীমূর্তি গড়ে যেখানে দুর্গা, কালিকার পূজা হয়।
সেখানে কেন বারবার নারীকে সমাজ লোলুপতার শিকার হয়ে হয়?
কেন নপুংসকেরা নারীদের অস্তিত্ব নিয়ে কাটাকুটি খেলে?
মল পরা রিনি ঝিনি পায়ে যাদের ছন্দ ছড়াবার কথা-
পান রাঙা ঠোঁটে যাদের হাসি বিলোবার কথা-
দীঘল কালো চুলে যাদের মেঘ ঢাকবার কথা-
কেন তাদের অসুর বধে তুলে নিতে হয় ত্রিশূল?
লক্ষ্মী স্বরূপা কন্যা কেন হয়ে যায় অসুর দলীনি দুর্গা কিংবা ছিন্নমস্তা কালি?
ঘরে বাইরে কন্যারা কেন লাঞ্ছিত?
প্রকাশের লাঞ্ছনার চরম প্রকাশ আমার অর্ধদগ্ধ কালশিটে মুখ।
প্রকাশদের ভালোলাগার অত্যাচারে মনীষারা আজ অ্যাসিড আক্রান্তা।
চক্রান্ত চারিদিকে , চক্রান্ত যুগে যুগে।
কিছু মনভোলানো স্তব বাক্য ছাড়া মনীষারা যোগ্যাসন পায়নি কোনদিন।
তাই হৃদয়ের লৌহ তপ্ত আগ্নেয়গিরি লাভা ,আছড়ে পড়তে চায় সমাজের বিচারহীনতার বুকে।
যখন পোড়া মনীষারা বিকৃত মুখ নিয়ে সমাজের আঙিনায় ছুটে বেড়ায় –
প্রকাশেরা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বেড়ে চলে সমাজেরই প্রশ্রয়ে।
তবু আমি মুখ লুকোব না।
এ পোড়া মুখই আমার প্রতিবাদ।
এই প্রতিবাদ শুধু জল্লাদরূপী প্রকাশদের বিরুদ্ধে নয়।
প্রতিবাদ সমাজের প্রতিবাদহীনতার কাছে।
প্রতিবাদ সমাজের নপুংসকতা ও মেকীপনার কাছে।

দেখি কখন ঘুম ভাঙ্গে এ পোড়া সমাজের?
আমার পোড়া মুখের মাংসের দুর্গন্ধে ওয়াক উঠুক চারিদেকে।
যতক্ষণ না তা হয় এ লড়াই চলবে।
পোড়ামুখী মনীষাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই।