অনাহূত অনাসৃষ্টির দশা দেখছি
আমি সেকেলে এক মানুষ।
আধুনিকতার রঙিন সমারহে
ভাসিয়ে দিয়ে স্বপ্নাকাশে
সাদাকালো এক ফানুস।
ফানুসখানি ভাবনা হয়ে
খুঁজে ফেরে সন্ধানেতে-
কোথায় গেল আমার সেই
ছোট্টবেলার গাঁ?
কোথায় গেল ভরা নদী?
কানায় মাঝি?
মাছরাঙার দল?
আর সাদা বকের ছা?
গাঙের ঘাটে জল ভরতে
আসে নাতো কলস কাঁখে,
কেউ কোন আর পল্লীবালা।
নেইকো জোয়ার, স্রোতধারা,
নেইকো উথাল ঢেউ।
বায়ছে না কেউ ছিপখানি নাও,
জাল ফেলেনা কেউ।
আজ নদীর উদোম খোলা বুকে
চড় দখলী দখলদার।
গুদামঘর, উচ্চটিলা সরিয়ে দেবে
এ গাঁয়েতে সাধ্য কার?
মল্লিকাদির আটচালাটা
নাম নিয়েছে “স্বপ্ন ভিলা” ।
ইট পাথরে গুঁড়িয়ে দিয়ে
মল্লিকাদির স্বপ্নটা ।
মরা নদী মেঘনা পাড়ে
আর আসে না জোয়ার বেলা ।
গরুর পাল আনতে ঘরে
ত্বরা করে,
আর ছোটে না আমেনারা।
“চন্দ্র ভিলার” লক্ষিছাড়া চন্দ্রশালা
চাঁদ ছুঁতে চায় বামুন হয়ে
লাজ শরমের মাথা খেয়ে
ঠাঁই দাড়িঁয়ে চন্দ্রকর আড়াল করে।
তাই তো বুঝি,
শ্লোক বলা কাজলা দিদির চাঁদ সোনাটা
বাঁশ বাগানের মাথার ওপর
আর যে ওঠে না।
“হাতে লণ্ঠন করে ঠন্ঠন্
জোনাকিরা দেয় আলো।
মাভৈ রানার
এখনো রাতের কালো।”
চিরন্তন সে গীতটি।
সবরঙ ছাপিয়ে সাদাকালো ফানুসে
ভেসে ভেসে এলো ।
আমারই মতি দাদা একদিন
এ গাঁয়েরই ডাকহরকরা ছিল।
কাজে কামে সততাই
সময়ের জ্ঞানটাই সুনামও ছিল।
স্বর্গবাসী হয়ে দাদা
ঘুমিয়ে পড়েছে
অনেক আগেই কবরে।
চিঠির পোঁটলা কাঁধে লন্ঠন হাতে
আর ছুটে না কেউ খবর নিয়ে
এ গাঁয়ের ঘরে ঘরে।
রসুলপুরে রহিমউদ্দির
আসমানীদের বাড়ীটার
পাইনি আমি দেখা।
সবুজ পাতা, খড়ের চালা
স্যাঁত স্যাঁতে ছাঁচতলা।
হারিয়ে গেছে ছাতিম গাছের
রৌদ্র ছায়ার ছলাকলা।
আসমানিকে দেখতে কেউ
আর আসেনা রহিমুদ্দির বাড়ী।
পিচ ঢালা পথে ধূলো উড়িয়ে
শাঁ শাঁ ছোটে
আজ নতুন বিবির মোটর গাড়ী।
দুই নয়নের লোনা জলে
ত্রিশ বছর ভেজা ছিল
দাদির কবরটা ।
কেউ রাখেনা, কেউ জানেনা
বড় মর্মব্যথী খবরটা ।
কয়েক ত্রিশ পার হয়েছে
আর ভেজে না কবরটা ।
উপেনের সেই হারান শেষ সম্বল
দুই বিঘা জমিতে,
শষ্যের মধু হাসি লেগেই ছিল
ভরা মৌসুমেতে।
সোনা ফলা মাঠে সবুজ ফসল
জাগাতো কিষানি বৌ এর বুকেতে ফাগুন।
সেই জমিতে আজ ইটের ভাটা।
চিড়ে ফুঁড়ে মাটির বুক
সভ্য লোকের বানিজ্যটার গনগনে আগুন।
নাকের ওপর আটকান
টেলিস্কোপ, দূরবীন বনবনিয়ে ঘোরে
নব্য গড়া সভ্যতার রঙের চতুর্দিক।
বোবা কান্নায় সিক্ত হওয়া
পোস্টমর্টেমে নিরীক্ষণে
আমার সন্ধানি দুই দৃক।