অরনিকা
তোমার অগোচরে আমি আজও খুঁজে ফিরি আমার অস্তিত্বকে
মৌনতা ছাপিয়ে খুঁজে ফিরি এমন একজন মানুষকে
যে হবে শুধুই স্বামী, একজন বিত্তবান স্বামী
যে হবে শুধুই তোমার
যার উপর থাকবে শুধু তোমারই অধিকার
যে সারাদিন মরিয়া হয়ে থাকবে শুধু তোমাকে সুখী রাখতে
থাকবে না কোন মন খারাপের দিন
থাকবে না অভাব, থাকবে না অপূর্ণতা
আমি হবো ঠিক যেন আলাদিনের ইচ্ছাপূরণকারী দৈত্যরূপী স্বামী
বিনিময়ে থাকবে না কোন চাওয়া-পাওয়া
ফলাবো না অধিকার, থাকবে না আকাঙ্ক্ষা
আমি হবো শুধু তোমার মতো করে তোমার
একান্তই তোমার।
বিশ্বাস করো অরনিকা
আমিও হতে চেয়েছিলাম এমনই একজন
তবে মেরুদণ্ডহীন পুরুষ হিসেবে নয়
একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে
তোমার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি অনেকবার
কিন্তু ইচ্ছাকে বশে আনতে পারলেও পারিনি বাস্তবতাকে
বাস্তবতা আর কল্পনার মাঝে লুকোচুরি খেলতে খেলতে
কিভাবে যে মানব নামের বনসাই হয়ে উঠেছি তা জানতে পারি নি কখনো
তোমার-আমার সম্পর্কটাও হয়েছে আজ বেনামি
আর আমাদের বেনামি সম্পর্কের আজ এক যুগ পূর্ণ হতে চলেছে
আজও আমি তোমার মতো করে হয়ে উঠতে পারিনি
পারিনি একজন ভাল স্বামী হয়ে উঠতে
পারিনি একজন ভাল বাবা হতে
কারণ তেমন কিছু নয় কেবলি আমার অস্বচ্ছলতা, আমার অপূর্ণতা
যাকে তুমি অযোগ্যতা বলে সংগায়িত করেছো বহুবার, বহুজনের কাছে, বহুভাবে!
উপযুক্ত সংগাই দিয়েছ বটে
তুমি আধুনিক যুগের মেয়ে
একটুখানি স্বচ্ছলতা, একটু বিলাসিতা, একটুখানি ব্যক্তি স্বাধীনতা চাইতেই পার
হোক না তাতে ছিন্ন-ভিন্ন কিছু মায়ার বাধন
হোক না ক্ষুন্ন কিছু অধিকার
এতে কি বা আসে যায়
ওসব তো হলো  সস্তা মায়াজাল, পরাধীনতার শৃঙ্খল
আধুনিকা হতে গেলে কি আর ওসব পিছুটান মানায়, মানায় না!
সুশীল সমাজের অনেকেই বলে বটে
এতে অবশ্য দোষের কিছু নেই
তুমি বাপু বড্ড সেকেলে
মায়ের আঁচলে মুখ লুকানো মানুষ
বউয়ের ব্যাপারে এতো নাক গলাতে নেই
এমন করলে তুমি কখনো বড় হতে পারবে না
সত্যিই তো, বড় হতে গেলে এতো আবেগ থাকতে নেই
থাকতে নেই অনুভূতি, থাকতে নেই মনুষ্যত্ব
এটাই হলো আধুনিকতা
তাই দোষটা ছিল কেবলি আমার
পারিনি আধুনিক হতে
পারিনি মনুষ্য সমাজে নিজেকে বেদুইন ভাবতে
পারিনি চোখের লজ্জার অস্ত্রোপচার করতে
পারিনি কিছু দায়ভার এড়াতে
আমাকে ঘিরে তোমার অভিমানের অন্ত ছিল না কোন
তোমার অভিযোগের তীক্ষ্ণতা এতোটাই প্রখর ছিল যে
পৃথিবীর সমস্ত যুক্তিই হার মানত তার কাছে
নিজেকে বদলাতে চেয়েছি শতবার
হতে চেয়েছি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী
হতে চেয়েছি শ্রেষ্ঠতম বাবাদের একজন
প্রচেষ্টার কমতিও ছিল না তাতে
শুধু ছিল না একজন সহযোদ্ধা
সহযোগিতা যতটুকু পেয়েছি তা ছিল নিছকই সান্ত্বনা
অর্জন করতে পারিনি কিছুই
না পেরেছি দু'হাত ভরাতে দিয়ে অলংকার
না পেরেছি হতে তোমার অহংকার
তুমি ছিলে বুদ্ধিমতী নারী
আমার বিফলতার গ্লানি তুমি কেন বয়ে বেড়াবে
আমার দায়ভার  কেবলই আমার
তাইতো কোন দ্বিধাবোধ ছিল না যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে
পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি একটিবারের জন্যেও
খুব সহজেই হয়ে গেলে পৃথক
রপ্ত করলে অবহেলার সুনিপুণ কৌশল
শুরু হলো বিচরণ তোমার আপন জগতে
যদিও সমাজের চোখে আমরা বিচ্ছিন্ন নই
তোমার প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়া আর আমার ভঙ্গুর হৃদয়
দুজনের মনের মাঝে এখন এক পাথরের দেয়াল
জানি এতোদিনে তুমি হয়তো একা থাকা শিখে গিয়েছ
আমারও দিন দিব্যি কেটে যাচ্ছে
হয়েছ স্বনির্ভর, পেয়েছ মুক্ত জীবন
ব্যক্তি অর্জনে পরিপূর্ণ তুমি এখন
হয়েছ পূর্ণাঙ্গ আধুনিকা নারী।
শুধু হতে পারনি একজন আদর্শ স্ত্রী
একজন আদর্শবান মা
প্রথম প্রথম তোমাদের চলে যাওয়া অনেক কষ্ট দিত আমাকে
স্মৃতির পাজরে ঢেউ গুনেছি আনমনে
চোখের সামনে ভেসে উঠতো শিশুটির ছেলেবেলা
নিঝুম রাতে চোখ কেন জানি না প্রচন্ড জ্বালাতন করতো, জানো
তোমাদের শুণ্যতার অনল এতো ভয়াবহ ছিল যে
মনে হতো কেউ বুঝি আমার হৃদয়ে এসিড ঢেলে দিয়েছে
হৃদয়ের এপার-ওপার ছেদ করে যেত সে বেদনা
কাউকে দেখানও যেত না সে ক্ষত
হতে পারতো সবই একটা কল্পনা
হতে পারতো দুঃস্বপ্ন
হতে পারতো সবই আমার দেখার ভুল
কিন্তু না, তা আর হলো না
নির্মম বাস্তবতাকে ভুল প্রমাণ করতে পারলাম না কিছুতেই
আশ্রয় চেয়েও কোথা পাই নি ঠাঁই
আজ আমি রিক্ত
পেরিয়েছি জীবনের অনেকটা সময়
কতবার চেয়েছি নদী হতে
ভাসিয়ে দিতে চেয়েছি জীবনের সব ব্যর্থতা
মুছে ফেলতে চেয়েছি সব গ্লানি
নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছি সময়ের গহীন স্রোতে
কিন্তু পারিনি
ফিরে এসেছি জীবনের চিরচেনা বাকে
খুঁজে ফিরেছি হারানো মানুষগুলোকে
খুঁজেছি অরনিকা প্রথম দেখা তোমাকে
হ্যা তোমাকে
তোমার অগোচরে।।