★ত্রিবৃত্ত ছন্দ★ একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ:-
------------#মজনুআহাদী

*বাংলা কবিতার ইতিহাস নানা রূপ-বৈচিত্রে পরিপূর্ণ! বাংলা কবিতার ছন্দ প্রধানত ৩টি, যথা:- ১)স্বরবৃত্ত, ২)মাত্রাবৃত্ত ৩)অক্ষরবৃত্ত হলেও গদ্যছন্দ নামে এক বিশেষ ছন্দের অস্তিত্ব আছে!

বাংলায় প্রচলিত প্রধান ৩ ছন্দ মিলিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ কবিতা লেখে আসছি। কিন্তু এই রীতির নামকরণ করা হয়নি! পরবর্তীতে এই রীতির নামকরণ করি "ত্রিবৃত্ত ছন্দ"!
"ত্রিবৃত্ত ছন্দ'' প্রবর্তনের পূর্বে দুটি ছন্দ একত্র করে যেমন:- স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত একত্রে স্বরমাত্রিক, স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত একত্রে স্বরাক্ষরিক এবং মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত একত্রে মিলিয়ে মাত্রাক্ষরিক এর প্রয়োগে বহু ছড়া/কবিতা রচিত হয়েছে। কিন্তু সংস্কৃত ছন্দের লঘু-গুরু প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তের সংমিশ্রণে কোন কবিতা রচিত হয়নি! অর্থাৎ সংস্কৃত ছন্দের আদলে প্রাস্বরিক বা ত্রিমাত্রিকে কেউ কেউ কবিতা লেখেছেন!
আর বাংলা ছন্দে সংস্কৃত ছন্দের লঘু-গুরু নিয়মের প্রভাবমুক্ত হতেই "ত্রিবৃত্ত ছন্দরীতি" প্রবর্তন করেছি!

**প্রাস্বরিক বা ত্রিমাত্রিক রীতিতে কবিতা লেখলে যেকোন এক বা একাধিক ছন্দের তাল-লয় কেটে যায়! তাই সর্বোচ্চ ৩ ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লেখা সর্বোত্তম।

**কাজেই সংস্কৃত ছন্দে নির্মিত প্রাস্বরিক বা ত্রিমাত্রিক ছন্দকাঠামোর নিয়ম না মেনে শুধু বাংলা প্রধান ৩ ছন্দ স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তের মূলপর্ব ঠিক রেখে "ত্রিবৃত্ত ছন্দে'' কবিতা লেখা উত্তম!

**তবে "ত্রিবৃত্ত ছন্দ" সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে আমাদের সংস্কৃত প্রাস্বরিক বা ত্রিমাত্রিক রীতি সম্পর্কে জানা জরুরী!

**যেখানে মুক্তাক্ষর, বদ্ধাক্ষর, যুক্তবর্ণ নির্দিষ্ট ছকে পর্যায়ক্রমে প্রতি পর্বে, প্রতি পংক্তি,  চরণ ও প্রতি স্তবকে একই কাঠামো বা ছকে সুসজ্জিত থাকে, তাকেই প্রাস্বরিক বা ত্রিমাত্রিক বলে।

**কবিতার যে অংশটুকু একত্রে বা একেবারে উচ্চারণ করা হয় তাকে পর্ব বলে। একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে!
উদাহরণ:-

"হাসিকান্না/ হীরাপান্না/ দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে/ ভালোমন্দ/ তালে তালে,
নাচে জন্ম/ নাচে মৃত্যু/ পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ,/ তাতা থৈথৈ,/ তাতা থৈথৈ।"

এখানে:- "হাসিকান্না"; "হীরাপান্না"; এগুলো একেকটি পর্ব। আর প্রথম দু'চরণ মেলালে দেখা যায় একই নিয়ম-কাঠামোতে যুক্তবর্ণ, বদ্ধাক্ষর বা বদ্ধস্বর ও মুক্তাক্ষর বা মুক্তস্বর সাজানো অাছে!

**প্রাস্বরিক ছন্দরীতি কিন্তু বাংলা কবিতার নিজস্ব ছন্দ নয়। ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, ল্যাটিন, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষার কবিতার ছন্দরীতি থেকে প্রাস্বরিক এসেছে বাংলা কবিতায়।

**ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তই প্রথম সংস্কৃত ছন্দ 'মন্দাক্রান্তা'র প্রাস্বরিক রূপ দেন, যেমন:-

"পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল কই গো কই মেঘ উদয় হও,
সন্ধ্যার তন্দ্রার মূরতি ধরি আজ মন্দ্র মন্থর বচন কও।"

**সত্যেন্দ্রনাথের সংস্কৃত মন্দাক্রান্তা ছন্দই তাঁর প্রথম প্রাস্বরিক প্রচেষ্টা। তাই তাঁকেই প্রাস্বরিক ছন্দের জনক বলা হয়। তাঁর 'দূরের পাল্লা' ছড়াটিতেও প্রাস্বরিক ছন্দের প্রয়োগ দেখা যায়:-

"দূরের পাল্লা"
----সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

ছিপখান/ তিন-দাঁড় -
তিনজন/ মাল্লা
চৌপর/ দিন-ভোর
দ্যায় দূর/-পাল্লা!
         পাড়ময় /ঝোপঝাড়
         জঙ্গল-/জঞ্জাল,
         জলময়/ শৈবাল
         পান্নার/ টাঁকশাল |
কঞ্চির তীর-ঘর
ঐ-চর জাগছে,
বন-হাঁস ডিম তার
শ্যাওলায় ঢাকছে|"

**রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "রাজা" কবিতাতেও প্রাস্বরিক বা ত্রিমাত্রিক ছন্দের পরিচয় পাওয়া যায়:-

"রাজা"
       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

"মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।

তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥

হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।

কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ--
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥"

রাগ: কাফি
তাল: খেমটা-ষষ্ঠী
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1317
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1910
স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

**কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর 'আরবি ছন্দের কবিতা'য় ১৮টি আরবি ছন্দের প্রাস্বরিক রূপ দেন। তারমধ্যে 'রমল'-এর একটি উদাহরণ:-

"খামখা হাঁসফাঁস / দীর্ঘ নিঃশ্বাস
নাইরে নাই আশ / মিথ্যা আশ্বাস"

**ওপরে উল্লেখিত কবিতা বা ছড়াগুলোর মাত্রাবিন্যাস করলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রচলিত প্রধান ৩ ছন্দ স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্তের আলাদাভাবে  তাল ঠিক নেই!!

**উল্লেখিত তিনজন ছাড়াও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, গোলাম মোস্তফা, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, ভুবনমোহন রায়