‘কবিতার ভবিষ্য’ শিরোনামে গদ্য লিখেছেন বিভিন্ন কবি, কবিতাকে হাঁটিয়েছেন- পাঠিয়েছেন সমকালের অন্যান্যদের থেকে নিজের তফাৎ আঁকার চেষ্টায়/অপচেষ্টায়- নিজস্ব/ব্যাক্তি দৃষ্টিতে আকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ তৈরি করতে; যার কিছু যৌক্তিক, বাকিটা বালখিল্য। তবে এইসব গদ্যের মালিকেরা কবিতাকে কবিতা হিশেবে দেখতে পেরেছেন কতটুকু আর, যদি তারা নিজেদের কবি বলে দাবী করেন। কবিতাকে কবিতা ছাড়া জাগতিক-অজাগতিক অন্য বিষয়ের সঙ্গে মিলবিন্যাস তৈরিতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন যুক্তিরহিতভাবে, অনেকেই; এর প্রতিতুলিত বিষয় উপস্থাপন করেছেন আবেগাশ্রয়ে। হুমায়ূন আজাদের মতেঃ এর (কবিতার) সঙ্গে প্রতিতুলিত হ’তে পারে এমন আঙ্গিক আজো অনাবিস্কৃত..; মানছি, তবে এ আজাদ তার একই গদ্যে (কবিতার ভবিষ্যৎ; ১৯৭২) কবিতার প্রতিতুলনা করেছেন- বহুবার বিবাহিতা, চিরকুমারী, অসতী, সম্রাজ্ঞী.. এইসবের সাথে, অনেকটা পরোক্ষভাবে; যদিও এসব তার স্ববিরোধী। তুলে ধরা তুলনায় স্ত্রীলিঙ্গসমর্থনকারী শব্দের প্রাচুর্য লক্ষনীয়। কবিতা অপার সৌন্দর্যাধার (সৌন্দর্য যদিও আপেক্ষিক), তবে আজাদ হয়তো দৃষ্টান্তবাদীদের (দৃষ্টান্তবাদ- আধুনিক দার্শনিক ধারণা) মতোন ভাবতেন না সৌন্দর্য লিঙ্গভেদসমর্থিত হতে পারে না, হতে পারে না আর্থিক বিষয়ের প্রতিতুলিত। তিনি লিখেছেনঃ কবিতারই একমাত্র ঈর্ষাকর অতীত রয়েছে, রয়েছে লোভনীয় ভবিষ্যত। এখানে ঈর্ষা-লোভ এ-ধরনের বিশেষ্যর ব্যবহারে না গেলেই শ্রেয় হতো। আমি বোধ করছি না আজাদ অই লোভনীয় ভবিষ্যতের অংশীদার হবার লোভে কবিতা রচনা করেছেন।
বাঙলা কবিতার ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে, কবিদের অনেকেই বুঝিয়েছেন কবিতা ছিলো, কবিতা আছে এবং কবিতা থাকবে;- আমি এ-বলার পক্ষপাতি নই, নই বিপক্ষপাতিও। কারণ একসময়, আরও আগে কবিতা- আমরা যেটাকে বুঝি- এরকম ছিলো না। একশোবছর পরও একইরকম থাকবে না, বাঁক নেবে। কারণ, কবিতা থাকে পাঠকের বোধে/মনে; যে বোধ ক্রমাগত ত্রিয়া/পরিবর্তনশীল। আর এ পরিবর্তনশীলতার ওপর নির্ভর করে কবিতার ভবিষ্যৎ; অনেকাংশে। বোধের মূল উপকরণ দর্শন, যৌক্তিক-উপলব্ধি এবং প্রকাশ ক্ষমতা। কবিতার উপকরণ মূলত প্রাকৃতিক। মেধা-মন-মননের, শৈল্পিক-ভাষিক উৎসারণের আন্তরিক এবং যৌক্তিক উৎকর্ষের যোগসাধনের ফলে তা কবির সাহচার্যে কবিতারূপ নেয়। এক্ষেত্রে কবি তার ভাবপ্রকাশে নির্ভরশীল প্রতিবেশ এবং কালের ওপর। কালই কবিতাকে রবিন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, জীবনানন্দ থেকে শামসুর রাহমানের কাছে এনে দিয়েছে।
ভবিষ্যৎ সন্দেহজাগানিয়া, এর নির্দিষ্টতা নেই কিছু। এ-সম্পর্কে আমরা ধারণা অনুমান (অনুমান প্রমাণ নয়) করতে পারি শুধু। আমি দু’ বাঙলার কবিদের মতো অযৌক্তিক ভাবে, চেপেচেপে, কবিতার ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট করার কাজে হাত দিতে পারি না; শুধু আঁচ করতে পারি এর সম্ভাব্য গন্তব্য। কারণ, কোনো কিছুর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অনুমানলব্ধ জ্ঞান, পূর্ব প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ জ্ঞান/প্রমাণ অনুসারে শুদ্ধ/অশুদ্ধ দুটোই হতে পারে। লালনেরর গানÑ “জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা, দেখাই আসমানে’-এর মতোন। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। যদিও দু’ বাঙলার কবিরা কবিতার ভবিষ্যৎ জপেছেন অই লালনের মতোন শূন্যে আঙ্গুল উত্থান করে, অনেকেই।
কবিতার ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট করা মূল কাজ হতে পারে না। এর যৌক্তিক-শিল্পনিবিষ্ট গন্তব্য নির্মাণে সশ্রম অংশিদারী হওয়াই শ্রেয়। প্রত্যেক কবিই লেখেন নিজস্ব নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছানোর জন্যে; যে গন্তব্য প্রভাবিত করে কবির কাব্যচারণ। যদিও বাঙলা কবিতার কালধারার অনেকাংশেই গন্তব্য হয়ে ওঠছে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা নয়তো সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। কবির কাজ এইটুকুই; বাকিটা কালের।
বর্তমান বাঙলা কবিতা দু’-ধরনের রূপ নিয়েছেঃ দালালি এবং গালাগালি। কবিতাকর্মীরা, মাইকধারীরা এ দু’ নৌকায় থেকেই হাত-পা নেড়ে দেখিয়ে যাচ্ছেন বাঙলা কবিতার গুরত্বপূর্ণ ভবিষ্যৎ! প্রথাগত কারণে আমাদের কবিতা দূষিত হয়ে আসছে সেই অন্ধকার মধ্যযুগ থেকেই। মাঝখানে জীবনবাবুরা আলোর ঝলকানি দেখিয়েছে যা আমাদের বোধের পেটে কড়া নেড়ে গেছে ভীষণভাবে। রাজনীতি, ধর্ম, সাম্পদায়িকতা, পুঁজিবাদ, উপনিবেশিক জাল.. এখনো শকুনের মতোন কুড়ে খাচ্ছে আমাদের কাব্যবোধ। এখানকার অধিকাংশ পাঠক কবিতায় শিল্পকলা উপভোগের নামে ভোগ করছেন প্রথাগত নষ্ট-আবেগ। বিশ্বাস নয়, দৃষ্টান্তের ওপর নির্মিত কাব্যদর্শনই আবার সেই বোধের কড়া নেড়ে যাবে। এর জন্যে বাঙলা কবিতাচর্চা হয়ে উঠতে হবে নিখুঁত। দর্শনাশ্রিত বিশুদ্ধ-গূঢ় শিল্পকলাই হয়ে উঠতে পারে বাঙলা কবিতার মৌলিক ভবিষ্যৎ অভিঘাত স্রষ্টা।
দ্রষ্টব্যঃ পরবর্তিতে গদ্যটি গ্রন্থভুক্তির পূর্বে সম্পাদিত হতে পারে।
পূর্বপ্রকাশঃ নবযুগ, ২০১৩, কুমিল্লা।