ড. সুজিত কুমার বিশ্বাস “ছন্দ মেনে কবিতা” নামে আলোচনার পাতায় বিভিন্ন লেখকের কবিতা বিশ্লেষণ করে ছন্দ ও মাত্রা মেনে কবিতা চর্চায় উৎসাহ দিতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ছন্দ ও মাত্রা সম্পর্কে আমার মতো অজ্ঞতাসম্পন্ন লেখকদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কেননা কবিতা লিখতে হলে ছন্দ-মাত্রার জ্ঞান থাকা প্রয়োজন যদিও তা মানা বাধ্যতামূলক নয়। আমি তাঁকে সাধুবাদ জানাই।
কবি মূলচাঁদ মাহাত ০৮/০৯/২০১৮ তারিখ “প্রতিভা প্রকাশ” নামে একটি কবিতা প্রকাশ করেন। কবির লিখিত কবিতা-
“প্রতিভা প্রকাশ
প্রদীপ শিখা যায়না ঢাকা
হাতের তালুতে,
জলের গতি যায়না রোখা
নদীর বালুতে।
সূর্য এলেই দিকদিগন্তে
ছড়িয়ে দিবে প্রভা,
নীরদ কভু হয়নি সফল
লুকোতে তার আভা।
ফুটলে গোলাপ সুগন্ধে তার
বাতাস মুখরিত,
জ্বল্লে আগুন উঠবে যেনো
ফুলকি শতশত।
প্রতিভা কারো কেউ কোনদিন
রাখতে পারেনা চেপে,
কারোর সাথে কারো তুলনা
করা যায়না মেপে।
কেউ যদি গান গাইতে আসে
সুরেলা কণ্ঠ নিয়ে,
এঁড়ে গলার গায়করা তাই
বাধা দিতে যায় ধেয়ে।
এমন কি না মঞ্চ জুড়েও
হট্টগোলেতে মাতে,
তাই বলে কি প্রতিভা কারো
লুকোয় অভিঘাতে।
যতই তোমার থাকনা জ্ঞান
ভেবোনা তুমিই শ্রেষ্ঠ,
অহংকারের বিনাশ সদাই
অশ্রদ্ধাতেই নষ্ট।”
শ্রদ্ধেয় কবি ড. সুজিত কুমার বিশ্বাস কবিতাটি আলোচনার পাতায় নিম্নোক্তভাবে পর্ব বিভাজন ও মাত্রা বিশ্লেষণ করেছেন -
“প্রদীপ শিখা /যায় না ঢাকা=৪/৪
হাতের তালু/তে,=৪/১
জলের গতি /যায় না রোখা=৪/৪
নদীর বালু/তে।=৪/১
সূর্য এলেই /দিকদিগন্তে=৪/৪
ছড়াইবে /প্রভা,=৪/২
নীরদ কভু /হয়নি সফল=৪/৪
লুকোতে তার /আভা।=৪/২
ফুটলে গোলাপ /সুগন্ধে তার=৪/৪
বাতাস মুখ/রিত,=৪/২
জ্বল্লে আগুন/ উঠবে যেন=৪/৪
ফুলকি শত/শত।=৪/২
প্রতিভা মন /কেউ কখনো=৪/৪
রাখেনি যে /চেপে,=৪/২
কারোর সাথে /কার তুলনা=৪/৪
করা যায় না /মেপে।=৪/২
কেউ যদি গান/ গাইতে আসে=৪/৪
সুরের কণ্ঠ/ নিয়ে,=৪/২
এঁড়ে গলার /গায়করা যায়=৪/৪
বাঁধা দিতে / এগিয়ে।=৪/৩
এমন কি না /মঞ্চ জুড়েও=৪/৪
হট্টগোলে /মাতে,=৪/২
তাই বলে কি /প্রতিভা মন=৪/৪
লুকোয় অভি/ঘাতে।=৪/২
যতই তুমি/ হও না জ্ঞানী=৪/৪
নও যে তুমি /শ্রেষ্ঠ,=৪/২
অহংকারের /বিনাশ সদাই=৪/৪
অশ্রদ্ধাতেই /নষ্ট।=৪/২”
আমার জানার পরিধি মতে কবিতাটির যদি ছন্দ-মাত্রা বিশ্লেষণ করি তবে দাঁড়ায় এরকম-
“প্রদীপ শিখা /যায় না ঢাকা=৪/৪
হাতের তালু/তে,=৪/১
জলের গতি /যায় না রোখা=৪/৪
নদীর বালু/তে।=৪/১
সূর্য এলেই /দিকদিগন্তে=৪/৪
ছড়াবে তার /প্রভা,=৪/২
নীরদ কভু /হয়নি সফল=৪/৪
লুকোতে তার /আভা।=৪/২
ফুটলে গোলাপ /সুগন্ধে তার=৪/৪
বাতাস মুখ/রিত,=৪/২
জ্বল্লে আগুন/ উঠবে জেনো=৪/৪
ফুলকি শত/শত।=৪/২
প্রতিভা তো /কোনোদিনও=৪/৪
যায় না রাখা /চেপে,=৪/২
কারোর সাথে /তুলনা যে=৪/৪
যায় না করা /মেপে।=৪/২
কেউ যদি গান/ গাইতে আসে=৪/৪
সুরের কণ্ঠ/ নিয়ে,=৪/২
এঁড়ে গলার /গায়কেরা =৪/৪
দেয় যে বাধা/গিয়ে।=৪/২
এমন কি না /মঞ্চ জুড়েও=৪/৪
হট্টগোলে /মাতে,=৪/২
তাই বলে কি /প্রতিভাটা=৪/৪
লুকোয় অভি/ঘাতে।=৪/২
যতই তুমি/ হও না জ্ঞানী=৪/৪
নিজকে ভাবলে /শ্রেষ্ঠ,=৪/২
অহংকারীর /বিনাশ জেনো=৪/৪
অশ্রদ্ধাতেই /নষ্ট।=৪/২”
দেখুন তো কোনটা বেশি নান্দনিক।
শ্রদ্ধেয় কবি কবিতাটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নিজে কিছু শব্দের পরিবর্তন করেছেন। তাই আমিও করলাম। যদিও আমি এর পক্ষপাতি নই। কেবল আলোচক কবির বিশ্লেষণই যে শেষ কথা নয় সেটা বুঝানোর জন্য করলাম। তিনি-
“ছড়িয়ে দিবে প্রভা কে করেছেন” - ছড়াইবে প্রভা। চলিতকে করেছেন সাধু। ছড়াইবে কে করেছেন ৪ মাত্রা। কবিতায় সাধু-চলিতের মিশ্রণ মাত্রা সমতার খাতিরে দূষণীয় নয়। তবে আজকাল বিজ্ঞজনেরা তা পরিহার করার পক্ষে।
“যেনো” কে করেছেন- যেন। লেখক কবি যেনো শব্দটা আমার মনে হয় জানিও অর্থে প্রয়োগ করেছেন। হয়তো অনবধানতাবশত বানানটি ভুল করেছেন যা হবে “জেনো”।
“প্রতিভা কারো কেউ কোনদিন” কে করেছেন- প্রতিভা মন। মন অর্থ-হৃদয়, অন্তঃকরণ...আরেক অর্থ ৪০ সের যা ওজনের পরিমাপক। প্রতিভা তো মনে থাকে না বা ওজনও করা যায় না। প্রতিভা থাকে মগজে। তাই মন শব্দটির প্রয়োগ যথার্থ নয় বলে আমি মনে করি।
“বাধা দিতে যায় ধেয়ে” কে করেছেন - বাঁধা দিতে / এগিয়ে। বাধা অর্থ প্রতিবন্ধকতা আর বাঁধা অর্থ বন্ধন। লেখক কবির শুদ্ধ শব্দটিকে আলোচক কবি অশুদ্ধ শব্দে পরিণত করেছেন।
“অহংকারের বিনাশ সদাই” কে কোনো পরিবর্তন করেননি। তবে আমার মনে হয় শব্দটি “অহংকারীর” বিনাশ হবে। কেননা অহংকার অতীন্দ্রীয়। তার বিনাশ নেই। অহংকারী ব্যক্তি। ব্যক্তির বিনাশ আছে।
অপূর্ণ পর্ব কোথাও কোথাও ৩ মাত্রা করেছেন যা অনায়াসেই ২ মাত্রা করা যায় এবং কবিতাটি আপাদমস্তক ৪/৪, ৪/২-১ মাত্রায় সাজানো যায়।
এবার মূল কথায় আসি। সব কবিতা যে ছন্দ মেনে হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ছন্দে পটু অনেক কবিও লেখার সময় সঠিক ছন্দের শব্দটি খোঁজে পান না। আবার সব সময় সঠিক ছন্দে কবিতা মাথায় আসে না। আসলেও যে ভাবটি প্রকাশ করতে চাচ্ছি সেটি ঠিক মতো প্রকাশ হচ্ছে না বলে মনে হয়।
তাছাড়া একেকজনের ভাবনা একেক রকম। ফলে একই বিষয় নিয়ে লেখা কবিতা একেক রকম হয়। অন্যের ভাবনার সাথে আমার ভাবনার মিল না-ও হতে পারে। আমার ভাবনাই শেষ কথা নয়। অন্যজনের ভাবনা এবং তার প্রকাশ আরো সুন্দর হতে পারে।
তাই জোর করে কারো কবিতার ছন্দ-মাত্রা মিল করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
নিজে পরিবর্তন না করে যেসকল জায়গায় ছন্দপতন হয়েছে শব্দের কারুকাজে অসঙ্গতি রয়েছে সে সকল জায়গা নির্দেশ করে লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি যদি নিজে পরিবর্তনে সম্মত হন বা সহযোগিতা চান সে ক্ষেত্রে সম্ভাব্য শব্দ সম্পর্কে ধারণা দিলে হয়তো এর থেকে ভালো শব্দ প্রয়োগ করে ছন্দ-মাত্রার সুন্দর সম্পাদনা করতে পারবেন। তাই নিজে পরিবর্তন না করে ক্ষেত্রমতো পরিবর্তনের পরামর্শ দেয়াটাই যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি।
লেখক ও আলোচক উভয় কবিকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।