কবি কে:

সহজ কথায় যদি বলি, যিনি কবিতা লিখেন তিনিই কবি। তাহলে প্রশ্ন আসে কবিতা কী? কবিকে বলা হয় শব্দচাষী। তাহলে আবারও প্রশ্ন আসে কীরকম শব্দ কবি চাষ করেন এবং কেন চাষ করেন? কবির আরেক পরিচয় কবিতাকর্মী। এখানেও প্রশ্ন জাগে না কি, কবির কেমন বা কী কর্মটি আসলে কবিতা? যে কোনো কর্মের জন্য প্রয়োজন দক্ষতা। আর যেহেতু কবিতাকে শিল্পজ্ঞান করা হয় সেহেতু কবির মধ্যে শৈল্পিক দক্ষতা থাকা আবশ্যক নয় কি?

তাহলে আসুন আগে জানি কবিতা কী।

কবিতা কী:

সাহিত্যের যত শাখা আছে তারমধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও আকর্ষণীয় শাখা হচ্ছে কবিতা। কবিতাকে বলা হয় সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম নির্যাস- the best extract of literature. S.T Coleridge গদ্য এবং পদ্যের মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে বলেছেন, “Prose is - the words in the best order and Poetry is - the best words in the best order."

চর্যাপদের লুইপা-কাহ্নপাদের আতুরঘর থেকে বাংলা কবিতা জন্ম নিয়ে প্রাথমিক যুগ, মধ্য যুগ আধুনিক যুগ পেরিয়ে বাঁক বদলের ধারায় প্রবেশ করেছে উত্তরাধুনিক যুগে (যদিও উত্তরাধুনিক কথাটি নিয়ে বিতর্ক আছে)। যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে পৃথিবী পরিণত হয়েছে গ্লোবাল ভিলেজে। বাংলা কবিতার প্রবহমান স্রোতধারায় যেমন মিশে গেছে ভিন্ন ভাষার ভিন্ন কাঠামোর কবিতা তেমনি বাংলা কবিতাও পরিণত হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ঐতিহ্যে। ছন্দ এবং কাঠামোতে পরিবর্তন এলেও বিষয়বস্তুতে কবিতার মানবসংলগ্নতা চিরন্তন। ধর্ম ও দ্রোহ, প্রেম ও প্রকৃতি, দুঃখ ও বেদনা, যুদ্ধ ও শান্তি, মানবতা ও মানবাধিকার, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, দেশপ্রেম ও স্বদেশলগ্নতা ইত্যাদি কবিতার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গের প্রধান উপাদান। আর এসব উপাদানের সবই মানুষকে ঘিরে, মানুষের কল্যাণে।

যেহেতু কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট এবং প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞা নেই সেহেতু কবিতাকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। এ কারণে আমার মতের সাথে অন্যকারো মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে।

ইদানিংকালে উত্তরাধুনিকতার নামে অনেক সঙ্গতিহীন বাক্যকে ঘাড় মটকে লাইন ভেঙে গদ্য কবিতা বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বলতে শোনা যায় যে, ছন্দ কবিতা সেকেলে। কাঠামোবদ্ধ ছন্দে লেখা সাহিত্য কবিতা নয়, পদ্য। ভাবেসাবে মনে হয় পদ্য অচ্ছুত। গদ্য অভিজাত। সত্যেন্দ্র, সুকুমার, নজরুল, রবীন্দ্রনাথের পরে কবিতা থেকে ছন্দ নাকি বিদায় নিয়েছে। তাই কবিতায় ছন্দের ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা নেই বলে তাদের অভিমত। আসলে ওয়াল্ট হুইটম্যানের Petty Proseকে তারা অভিজাত কবিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাকে গ্রহণ করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে এই প্রকরণ পরীক্ষার আহবান জানিয়ে সাড়া না পেয়ে আবার তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্রও Petty Proseকে কবিতা হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি। Petty Prose গদ্যের জ্ঞাতিভাই। গদ্যের পৃথক একটি শাখা।

অনেকে কবিতা থেকে ছন্দ মুক্তির কথা বলেন। Free Verse-এর কথা বলেন। Free Verse সম্পর্কে টি এস এলিয়টের কঠোর মন্তব্যটি হলো:
"As for 'free verse' I expressed my view twenty-five years ago by saying that no verse is free for the man who wants to do a good job. No one has better cause to know than I, that a great deal of bad prose had been written under the name of free verse: though whether its authors wrote bad prose or bad verse or bad verse in one style in another, seems to me a matter of indifference. But only a bad poet could welcome free verse as a liberation from form.”
(The Music of Poetry. Selected Prose. ৬৫ পৃষ্ঠা)

মন্তব্যটির ভাবার্থ দ্বারায়,  "Free Verse সম্পর্কে আমি পঁচিশ বছর আগে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছিলাম যে, যে কবি উৎকৃষ্ট কাব্য গড়তে চান তাঁর কাছে কোনো ছন্দই মুক্ত হতে পারে না; আমার চেয়ে ভালো কারণ আর কারোরই জানা নেই যে, Free Verse-এর নামে প্রচুর খারাপ গদ্য লেখা হয়েছে: যদিও এর লেখকরা খারাপ গদ্য লিখেছেন বা খারাপ পদ্য, বা খারাপ শ্লোক; আমার কাছে এসব চরম অযত্নের এবং উদাসীনতার বিষয়। কিন্তু কেবল একজন অকবিই Free Verseকে কবিতা থেকে ছন্দমুক্তি বলে স্বাগত জানাতে পারেন।” আমরা যারা নিজেদেরকে আধুনিক কবি বলছি টি এস এলিয়ট bad poet বলেছেন। এরচেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?

বিষ্ণু দে-এর মতে, “কবিতার এক অপরিবর্তনীয় শরীরই হলো ছন্দ।” তাহলে কবিতা থেকে ছন্দমুক্তি দিলে কবিতা বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে না কি? গদ্যকবিতাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতার মান্যতা দিতে যে শর্তটি দিলেন তা হলো গদ্যের শরীরে পদ্যের রঙ লাগাতে হবে। ঘুরেফিরে তিনি সেই ছন্দের কাছেই গদ্যকে সমর্পণ করলেন কবিতা হওয়ার জন্য।

অনেকে বলেন মুক্তছন্দ। আসলে মুক্তছন্দ মানে একই কবিতায় বিভিন্ন ছন্দের ব্যবহার। তবুও তো ছন্দ। একেবারে নিরেট গদ্য নয়। আজকাল বেশিরভাগ কবিতায় তাও দেখা যায় না।

অস্বীকার করছি না যে, অনেক কালোত্তীর্ণ গদ্য কবিতায় বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে এবং এসকল গদ্য কবিতার অন্তরঙ্গ ছন্দের ঝংকারে মন্দ্রিত হয়েছে বলেই কবিতা হয়ে ওঠেছে। আবার অনেক ছন্দোবদ্ধ লিখাও কবিতা হয়ে ওঠে নি কাব্যগুণ না থাকার কারণে। অনেকে পঙক্তির শেষে মিল থাকাকে ছন্দ মনে করে ভুল করে থাকেন। বুধ-এর সাথে দুধ, মাছি-এর সাথে আছি দিলেই মনে করেন কবিতা হয়ে গেছে। এর মূল কারণ কবিতার প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকা।

পণ্ডিত বামনাচার্য বলেন, “কাব্যং গ্রাহ্যমলংকারাৎ।” যার অর্থ, অলংকৃত বাক্যই হলো কবিতা। অপরদিকে পণ্ডিত বিশ্বনাথ বলেন, “বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম।” যার অর্থ, রসযুক্ত বাক্যই কাব্য। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতার মূল নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন-
“অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতির রস ধারা করি সিঞ্চন
সংসার -ধুলিজলে।”

তাহলে প্রশ্ন আসে, অলংকার এবং রস কী? এ দুটি বিষয় জানলে এবং বাক্যে জড়াতে পারলে আমরা পেয়ে যাবো কবিতার অবয়ব।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মহাশয় বলেছেন, “কবিতা নিরাভরণা নয়। নারী যেমন আকার-সাকারে, ইঙ্গিতে, সাজসজ্জায়, রং-চঙ্গে, বিলাস-প্রসাধনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলে কবিতাও তেমনি শব্দে, মায়ায়, মর্মে ছন্দে উপমায় চিত্রে ও অনুভূতির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে।”

কবিতার শরীরে এই সাজসজ্জা জড়াতে যেসকল উপাদান ব্যবহৃত হয় সেসকল উপাদানই হচ্ছে অলংকার। মানুষের ব্যবহার্য অলংকারের যেমন শেষ নেই তেমনি কবিতার অলংকারেরও শেষ নেই। তবে উভয় ক্ষেত্রে প্রকৃত সৌন্দর্য নির্ভর করে এর পরিমিত ব্যবহারের উপর। একটি বুনোফুল খোঁপায় গুঁজে একজন নারী যেমন তার রূপ সৌন্দর্যকে বর্ধিতভাবে প্রকাশ করতে পারে তেমনি একটি অলংকার দিয়েও একটি বাক্য হয়ে উঠতে পারে একটি কবিতা। যদি ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই তাহলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। যেমন - যদি বলি, মায়ের কোলে একটি সুন্দর শিশু বসে আছে। তাহলে এটি একটি বাক্য। এই বাক্যটি কবিতা নয়, এটি একটি তথ্য। যদি বলি,
“ফুলের মতো ফুটফুটে এক শিশু
মায়ের কোলে মানিক রতন দুলে
যেন-
পদ্মকোরক জুড়ে বসা কালের কল্প যিশু!”
মতো এবং যেন উপমা অলংকার যুক্ত হওয়াতে এটি একটি কবিতা।

পাঠক হৃদয়ে কবির আবেগ উত্থিত ভাবের সঞ্চারকে বলা হয় রস। অর্থাৎ কবির ভাবনা পাঠক চৈতন্যকে টোকা দিলে পাঠক হাসেন, কাঁদেন, আবার আনন্দে ভাসেন। কখনো চিত্ত বিগলিত হয়ে মুষড়ে পড়েন। কখনো সাহসী হয়ে ওঠে শূন্যে মুষ্টি ছোড়েন। কবিতা দ্বারা পাঠক হৃদয়কে এভাবে আন্দোলিত করার নাম রস। কবিতার রস কারো কারো মতে ৯ প্রকার, কারো মতে ১০ প্রকার। রসের আলোচনায় বিস্তারিত না গিয়ে শেষ করবো কয়েকজন বিখ্যাত কবির দৃষ্টিতে কবিতা কী তা উল্লেখের মাধ্যমে।

যেহেতু কবিতাকে শিল্পজ্ঞান করা হয় এবং যেহেতু শিল্পের কোনো প্রামাণ্য সংজ্ঞা নেই, তাই কবিতারও প্রামাণ্য কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে কবিতার নান্দনিকতাকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে দেখেছেন।

পাশ্চাত্যে একসময় মনে করা হতো রূপক সৃষ্টির সক্ষমতাই কবিতা। ডব্লিউ বি ইয়েটস বলেছেন- প্রতীকই কবিতা। জীবনানন্দ দাস বলেছেন- উপমা সৃষ্টির সক্ষমতাই কবিতা। ড. হুমায়ূন আজাদ বলেছেন- চিত্রকল্পই কবিতা। শামসুর রাহমান বলেছেন- প্রতীক-চিত্রকল্প সৃষ্টির সক্ষমতাই কবিতা। কিংবদন্ততী কবি ও গীতিকার রফিকউজ্জামান বলেছেন- ছন্দময়, ভাবমধুর ও রসাত্মক কাব্যই কবিতা। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের সাধারণ অর্থের অতিরিক্ত অর্থ প্রকাশ করার সক্ষমতাই কবিতা।

মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে -“কবিতা বা পদ্য শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস যা একজন কবির আবেগোত্থিত অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তাকে সংক্ষেপে এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত করে এবং শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারে সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে।”

অনেকের কথাকে একত্র করে যদি বলি - শব্দ ছন্দ রূপক, যমক, প্রতীক উপমা, উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি, অন্তমিলের যাদকুরী স্পন্দনের মাধ্যমে অলংকৃত বাক্যের সাহায্যে চিত্রকল্প ও রস সৃষ্টির মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থের অতিরিক্ত অর্থ প্রকাশের নামই কবিতা।

কবিতার প্রকৃতি তো জানলাম। এখন দেখি কবিতা লিখতে হলে কবিকে কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হয়।

কবির যা জানা প্রয়োজন:

মাইকেল মধুসূদন দত্ত যথার্থই বলেছেন, কবিতা হতে হলে “শব্দের সাথে শব্দের বিবাহ দিতে হয়”। সে বিবাহ যত যুতসই তত টেকসই ও সার্থক। অন্তত এটুকু মেনে চললে গদ্যে হোক আর পদ্যে হোক কবিতা  প্রকৃত কবিতা হতে বাধ্য। একজন কবি যত ভালো শব্দবীজ বপন করবেন, যত আন্তরিকতার সাথে, যত্নের সাথে কাব্যমাঠের পরিচর্যা করবেন তত ভালো ফলন পাবেন। যারা ইকেবানা কাজে দক্ষ, তারা জানেন কোন ফুলের পাশে কোন ফুলটি রাখলে সুন্দর ও মনোগ্রাহী মালা বা ডালা হয়।
-কবিকেও জানতে হয় কোন শব্দটির পাশে কোন শব্দটি বসালে শব্দতরঙ্গ ঝংকৃত হয়।
-কেমন করে পাঠকের ভাবনার সলতেয় আগুন ধরাতে হয়।
-কবিতাকে কেমন করে চৈতন্য প্রবাহী ও ভাবমাধুর্যে ভরে তুলতে হয়।
-ধ্বনিতরঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে কিভাবে পাঠকের অন্তরকে আলোড়িত করতে হয়।
-কেমন করে পাঠকের নিস্তেজ চেতনাকে টোকা দিয়ে জাগিয়ে সচল করতে হয়।
-লেখকের ভাবনাকে কেমন করে পাঠকের অন্তরে সঞ্চারিত করতে হয়।
-কেমন করে লেখকের কথাকে পাঠকের কথা বলে মেনে নেয়ার প্রবণতা তৈরি করতে হয়।
-কিভাবে দেশ এবং কালের সীমা অতিক্রম করে যেতে হয়।
-যে উদ্দেশ্যে লিখছেন সে উদ্দেশ্যের সঠিক প্রতিফলনের মাধ্যমে সাহিত্যের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে যেসকল ব্যঞ্জন প্রয়োজন সেসকল ব্যঞ্জন সঠিক প্রয়োগ কৌশলও কবিকে আয়ত্ত করতে হয়।
-সর্বোপরি শব্দ ছন্দ রূপক প্রতীক উপমা অনুপ্রাসের যাদুকরী স্পন্দনের মাধ্যমে পাঠক হৃদয়কে আচ্ছন্ন করার কৌশল কবিকে জানতে হয়।

কেমন হতে হয় কবিতার শরীর:

মানুষের কোনো অঙ্গে খুঁত থাকলে যেমনটি দেখতে লাগে, কবিতার শরীরে খুঁত থাকলে দেখতে তেমনটি লাগে। কবিতার শরীর নাকি নারীর শরীরের মতো কোমল এবং স্পর্শকাতর। একে নারীর মতো সাজাতে হয় বসন ভূষণ ছন্দ এবং অলংকারে। সুন্দর শব্দের সুন্দরতম বিন্যাসে ভেতরের ভাবনার স্রোতকে পাঠক সমুখে উপস্থাপন করতে হয় কবিভাষায়। ভাষার ব্যাকরণের সাথে কবিতার ব্যাকরণের মেলবন্ধনে সৃষ্টি করতে হয় কবিভাষা। বানানের দিকে রাখতে হয় বাজপাখি চোখ। বানান ভুলের কারণে ঘটে যেতে পারে অর্থের বিরাট বিভ্রাট। বানান প্রসঙ্গে কিছু গল্প প্রচলিত আছে। যেমন- এক লোক তার স্ত্রীকে মেসেজ পাঠালো এই লিখে যে, এ পর্যন্ত যত নারী চেখে দেখেছি তুমিই সেরা। হেপি ভ্যালেন্টাইনস ডে সোনাবউ।” বাসায় ফিরতেই বউ তার কলার চেপে ধরলো। আর জানতে চাইলো, আমাকে ছাড়া জীবনে কত নারী চেখে নিশ্চিত হলে আমিই সেরা? বেচারা স্বামী ভেবাচেকা খেয়ে কাতর স্বরে বলতে লাগলো, খোদার কসম! তোমার আগে কোনো নারী চেখে দেখা দূরে থাক স্পর্শও করিনি। বউ বললো, তাহলে যে লিখলা “এ জীবনে যত নারী চেখে দেখেছি?” কই দেখি, বলে স্বামীর চোখ কপালে ওঠলো। আসলে সে লিখতে চেয়েছিলো “যত নারী চোখে দেখেছি।” ও-কারের বদলে এ-কার কী মারাত্মক ঝামেলাই না বাঁধালো! এরকম আরো আছে। ডাক্তার পিরিতের নারী খুঁজে খুঁজে হয়রান। আসলে হওয়ার কথা, ডাক্তার পীড়িতের নাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান। বানান ভুলের কারণে বিপদ এবং হাস্যস্পদ বাক্য কোনোটাই কবির জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়।

ভাবের প্রকাশেও পরিমিতিবোধ থাকতে হয়। যদি কেউ লিখে-
“ওই মেয়ে তুই ভালোবাসা দিবি কিনা বল
না দিস যদি কিলিয়ে তোর হাড় করবো জল।”
এখানে ছন্দের ঘাটতি না থাকলেও ভাবের স্রোত টর্নেডোর রূপ লাভ করেছে। ভালোবাসার এহেন প্রস্তাবে পালাবে তো পালাবে। মনে মনে বলবে, তোর ভালোবাসার গোষ্ঠি কিলাই। একই প্রস্তাব যদি এভাবে দেয়া হয়-
“ওই মেয়ে তুই করিসনে আর ছল
দোহাই লাগে একবার তুই ‘ভালোবাসি’ বল।”
এমন প্রস্তাবে ভালোবাসি বলতে না পারলেও ভালোবাসার রসাশ্রিত স্রোতে অন্তর ভিজাবে এটুকু ভাবা যায়।

অপ্রচলিত এবং ভুলভাবে ব্যবহার হয় এমন শব্দ অনেক সময় কবিতার মানে এবং শানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কবির ভাণ্ডারে শব্দদৈন্যের চিত্র প্রকাশ করে। সখ্য’র বদলে সখ্যতা লিখতে আমাকে এক কবি বাধ্য করেছেন। সখ্যতা যে ভুল কোনোভাবেই তাকে অভিধান দেখিয়েও মানাতে পারিনি। অশ্রুজল তো প্রায় সকলেই ব্যবহার করেন। অশ্রুই যে চোখের জল কেউ কেউ তা মানতেই চান না। স্বাগতম বলে খুব জোরেশোরে সম্বোধন করেন অনেকে। অথচ এটি সন্ধিগঠিত শব্দ- সু+আগত=স্বাগত, জানি না বললেই চলে। তথ্যগত ভুল এবং যোগ্যতাহীন বাক্যবিন্যাস কবিতার মানকে ম্লান করার জন্য যথেষ্ট। জাতির পিতাকে জাতির জনক বলা একটি কমন তথ্যগত ভুল। “নীলাকাশের তারায় তারায় তোমার ছবি ভাসে।” এমন উক্তি গঠনে ব্যাকরণসিদ্ধ হলেও অর্থে অযোগ্যতার পরিচয় প্রদান করে তা খেয়ালই করি না। কারণ, আকাশে যখন তারা থাকে তখন রাত। রাতে আকাশ নীল থাকে না। অথবা আকাশ যখন নীল দেখায় তখন দিন। দিনে তারা থাকার কথা নয়। আবার ভুল উপমাতে মেঘে ঢাকা চাঁদও জোছনা বিলাতে দেখি।

তাহলে সংক্ষেপে বলতে পারি, কবিতার শরীর হতে হয় নিখুঁত এবং থাকতে হয় লাবণ্যময় অঙ্গসৌষ্ঠব। আর তা যেসকল উপাদানে গড়ে ওঠে সেগুলো মোটামুটি-
-সুন্দর শব্দের সুন্দরতম বিন্যাস
-ছন্দের সঠিক প্রয়োগ
-অলংকারের পরিমিত পরিসজ্জা
-মার্জিত ভাষায় ভাবের প্রকাশ
-বিশুদ্ধ বানান
-ভাষা এবং কবিতার ব্যাকরণে সৃষ্ট কবিভাষা
-অপ্রচলিত ও ভুলভাবে ব্যবহৃত শব্দের অনুপস্থিতি
-সঠিক তত্ত্ব ও তথ্য
-যুতসই উপমা
-রসাস্বাদনের জন্য যৌক্তিক ব্যঞ্জন এবং
-ভাবের অর্থময় প্রকাশ, ইত্যাদি।

আবার কবিতার রয়েছে কাঠামোগত বিচিত্র বিন্যাস। এই বিচিত্র বিন্যাসের খুব কমই আমরা চর্চা করি। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত আমার কাব্যগ্রন্থ “ধানমণ্ডি ৩২ এক ব্যথার জংশন”। গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে প্রচলিত ও অপ্রচলিত ১৯টি কাঠামোর কবিতা। গদ্য, পদ্য, সনেট, ছড়া, একুশ শব্দের স্তবক, ট্রায়োলেট, লিমেরিক, রুবাই, লতিফা, সিনকেইন, তানকা, কাপলেট/টু-লাইনার, ষড়পদী, মজাক্ষরা, অষ্টপদী, লান্দে, হাইকু, ক্লেরিহিউ এবং গীতিকবিতা (গান)। এর থেকে নতুন কবিগণ কবিতার রূপগত ধারণা নিয়ে কাব্য চর্চায় উৎসাহিত হতে পারবেন এবং চিন্তার প্রসারণের মাধ্যমে নতুন নতুন কাব্যধারা সৃষ্টির প্রেরণা লাভ করতে পারবেন। এর দ্বারা কারো সামান্যতম উপকার হলে আমার শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করবো।

পরিশেষে বলি, কবিতার জগত কুহকী, মায়াময় ও আলো-আঁধারীর জগত। এ জগতে যে প্রবেশ করে তার নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। নেই ঘুম এবং বিরাম। কবির থাকে না কোনো পার্থিব স্বার্থ লাভের বাসনা। থাকে কেবল নবতর সৃষ্টির উন্মাদনা। শিল্পীত মনে তৃপ্তি লাভের তৃষ্ণা। থাকে কবিতার কুহকী জগতে উঁকি দিয়ে দেখার অদম্য বাসনা।

প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই বাস করে একজন কবি। প্রকৃত কবির দৃষ্টি থেমে যায় সোনালি ধান ক্ষেতে, হলুদ সরিষার মাঠে, রাতের রূপালি চাঁদের বুকে, কলকল শব্দে বয়ে যাওয়া নদীর জলের করাতে। নিসর্গের নান্দনিকতায় বিস্ময়ে বিমুগ্ধ কিংবা মানবতার পরাজয়ে যন্ত্রণাকাতর হৃদয়ে যে সত্তাটি বাস করে তার নাম কবিত্ব। এই কবিত্ব সত্তা সবার মাঝে থাকলেও প্রকাশ একেকজনের একেকরকম। প্রকাশের সাবলীলতায়, নির্মাণের কুশলতায় যে যত বেশি দক্ষ সে তত বড় কবি। এ কারণেই বলা হয় কারো কাব্যকৃতির মূল্যায়ন বিষয়ের নিরিখে নয়, নির্মাণকলার বিচারে নির্ণীত হয় কবি কিংবা অকবি। কবি জীবনানন্দ দাস তো বলেই দিয়েছেন, “সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।”

-মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান
গবেষণা ও মূল্যায়ন সম্পাদক
অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠন
মোবাইল: ০১৮১৮৩১৮৩১১
[তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল]