চুল কাটতে কাটতে কেউ ডাক্তার হয়ে গেছে এমন কথা কি কেউ শোনেছেন? আমি শোনেছি। এক নাপিত চুল কাটতে গিয়ে অসাবধানতায় কাঁচির খোঁচায় তার সেবাগ্রহিতার মাথার ফোড়া ফেটে পুঁজ বেরিয়ে যায় আর কদিনেই লোকটির ফোড়া ভালো হয়ে যায়। নাপিতের নাম ছড়িয়ে যায় ফোড়া কাটার ডাক্তার হিসেবে। নাপিতের দৈবাত ডাক্তার হওয়া ও পরের ঘটনা আপনারা জানেন। কথাটির অবতারণা করলাম এজন্য যে, কেউ কেউ নাপিতের মতো দৈবাত কবি হওয়ার বাসনা পোষণ করেন। আর কবিতার গঠনমূলক আলোচনা করলে নাপিতের দৈবাত ডাক্তার হয়ে ওঠার গল্প শোনান।

বাঙালির রক্তে কবিতা মিশে আছে। বাংলা ভাষার জন্ম যেদিন থেকে সেদিন থেকে বাংলা কবিতার জন্ম। কেননা ৯৫০ অব্দের চর্যাপদ থেকে শুরু করে ১৮ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে চর্চিত হয়েছে শুধুই কবিতা। বাঙালির মননে মগজে চিন্তা চেতনায় আজও কবিতার স্রোতস্বিনী প্রবাহমান। তাই বাঙালি ঘটনাচক্রে দৈবাত কবি বলে আমি মনে করি না। আমি মনে করি বাঙালি মাত্রই কবি। জন্মজাত কবি। হাঁ, সবাই কালোত্তীর্ণ কবি নন। তবে কবি। যে যত বেশি দক্ষতার সাথে ভাবের কাব্যিক প্রকাশ ঘটাতে পারেন তিনি তত ভালো কবি। আর ভালো কবি হয়ে ওঠতে হলে ভালো কবিদের কবিতা চর্চার কোনো বিকল্প নেই। ভুল চর্চা করে ভুল কবিতা লেখা যায়, সস্তা বাহবা কুড়ানো যায় কিন্তু সত্যিকারের কবি হওয়া যায় না।

কবি হচ্ছেন সত্য ও সুন্দরের ধারক এবং বাহক। তিনি সব সময় সত্য ও সুন্দরের চর্চা করবেন এটাই সবার প্রত্যাশা। তবে হাঁ, ভুল করতে করতেই কিন্তু মানুষ শিখে। এই শেখার আগ্রহটা কিন্তু থাকতে হবে। এমনও কেউ কেউ আছেন যারা ২০-৩০ বছর ধরে কবিতা লিখেন; তাদের অনেককে বলতে শোনি “মনের ভাব প্রকাশ করে পাঠককে গিলাতে পারলেই কবিতা হয়ে যায়। এর বেশি কিছু ভাবার দরকার নেই। কিসের ছন্দ-মাত্রা, কিসের অলংকার, কিসের ব্যাকরণ?”

হাঁ। আমি মানছি ভাষা আগে, পরে ব্যাকরণ। কবিতা আগে, পরে কবিতার অলংকার। তবে এটা তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা কেবল কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। যারা ৪-৫টা বই প্রকাশ করে ফেলেছেন কিংবা ২০-৩০ বছর ধরে কবিতার জগতে বিচরণ করছেন তাদের জন্য এমন কথা যেমনি বেমানান তেমনি কবিতার জন্য এটি অশনীসংকেত।।

নতুনরা পুরনোদের দেখে শিখে। পুরনোরা যদি ভুল লিখে রেখে যান নতুনরা সঠিকটা কোথা থেকে শিখবে? যুক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে অনেকে বলেন, “এখন আর শেখার সময় কোথায়?” আবার অনেকের মধ্যে অহমিকাবোধ কাজ করে, “আমি তো কবি হয়েই গেছি, আমাকে আর কবিতা শেখাতে হবে না।”

আজকে অনেককে আক্ষেপ করতে শোনি, কবিতার বাজার ভালো না; কবিতার পাঠক নেই। প্রকাশকগণ আগের মতো আর কবিদের কাছে ছাপার জন্য কবিতা চাইতে আসেন না। কবিদেরকে যেতে হয় প্রকাশকের কাছে। নিজের লেখা কবিতার বই প্রকাশকের কাছ থেকে নিজের টাকা দিয়ে কিনে আনতে হয়। কবি ও কবিতার এমনি দুর্দিন চলছে!

কবি ও কবিতার এ দুরবস্থা কেন? আমি মনে করি, এহেন দুরবস্থা উত্তরাধুনিকতার নামে ভুলের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেবার জন্য; কবিতার ব্যাকরণ অনুসরণ না করার জন্য; কবিতাকে কবিতাময় করে তোলার ব্যর্থতার জন্য; কবি ও কবিতার প্রতি ভালোবাসাবোধের অভাবের জন্য।

কবিতার সুদিন ফিরিয়ে আনতে কবিদেরকেই সচেষ্ট হতে হবে। শুদ্ধ ও সুন্দরতম কবিতা সৃষ্টির মাধ্যমে লেখকের ভাবকে সঞ্চার করতে হবে পাঠকের হৃদয়ে। এজন্য নতুনদেরকেই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। ভুলের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে থাকতে হবে সত্য সুন্দর শুদ্ধতার সংস্পর্শে। ভাবের আতিশয্যে নয়, ভাবের উৎকর্ষতায় হতে হবে শুদ্ধতম কবি। কবিতার প্রতিষ্ঠিত নিয়মকে, ছন্দকে ভাঙতে হলে সেই নিয়মকে, ছন্দকে স্পর্শ করতে হবে, নিয়ম ও ছন্দের কাছাকাছি যেতে হবে। দর্শনে, মননে, চিন্তার গভীরতায় সুন্দরকে ঠাঁই দিয়ে বের করে দিতে হবে অসুন্দর ও অকল্যাণের দাঁতালো দৈত্যকে। সৃষ্টি করতে হবে কবিতার বিশুদ্ধ বিপ্লব। ফিরিয়ে আনতে হবে কবিতার হারিয়ে যাওয়া সুদিন।

মনে রাখতে হবে কোন বিষয়ে জানার ঘাটতি দোষের কিছু নয়। দোষের হচ্ছে, না জেনে জানার ভান করা। আর যিনি জানেন এবং মানার চেষ্টা করেন তাকে কটাক্ষ করে কথা বলা। এটা মিথ্যে অহমিকা। এ অহমিকা পরিহার করতে হবে।

প্রকৃতিগতভাবে মানুষ বিচিত্র মনের হয়ে থাকে। প্রত্যেকের ভাবনাও আলাদা ও বিচিত্র। যিনি কবিতা লিখেন তার ভানার সাথে পাঠকের ভাবনার মিল নাও থাকতে পারে। কবি লিখেন কবির দৃষ্টিকোণ থেকে। কবিতার আলোচনার জন্য যাকে ডাকা হয় তিনি আলোচনা করেন তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে। লেখকের ভাবনার সাথে আলোচকের ভাবনা নাও মিলতে পারে। কারো লেখা সাহিত্যের মূল্য বিচারে কিছুটা এদিক সেদিক হতে পারে। তাই বলে এমনটি বলা মোটেই উচিত নয় যে এটি কোনো কবিতাই হয়নি। অন্যদিকে এটাও বলা উচিত নয় যে আলোচক কবিতার কিছুই বোঝেননি। না বুঝেই কিছু বই পড়ে পান্ডিত্ব জাহির করেছেন। তত্ত্বকথা উগড়ে দিয়েছেন। কবিতার গঠনমূলক আলোচনাকে মেনে নিয়ে আলোচক ও লেখক উভয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।

একজনের কবিতা আলোচনা করা হয় যাতে অনেকেই তার থেকে শিখতে পারে। যখন কোনো কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হয় অন্যরা আলোচকের বক্তব্যের সমালোচনা পরিহার করতে হবে। সমালোচনার ব্যাখ্যাদানের সুযোগ কবিকেই দিতে হবে। সহনশীল মনোভাব যার নেই, শেখার মনোবৃত্তি যার নেই তার কবিতার আলোচনা বা সমালোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। পিঠ চাপড়ে বাহবা দিয়ে দিবেন। খুশিতে গদ গদ হয়ে ভুল পথে হেঁটে যাবার পথটা এমন ভাবে সুগম করে দিবেন যাতে কিছুদিন ভুল পথে হেঁটে ভুল থেকে উত্তরণের পথটা একদিন নিজেই খুঁজে নিতে পারে।

ধন্যবাদ সবাইকে।
১৭-১১-২০১৮