বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "গদ্যের শরীরে পদ্যের রং লাগাতে না পারলে তা গদ্যই থেকে যায়। কবিতা হয় না।" প্রশ্ন জাগে, পদ্যের রং তাহলে কেমন, যে রং দেখে পদ্যকে গদ্য থেকে  আলাদা করা যায়?

কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ একটিমাত্র বাক্য দ্বারা সে রংয়ের ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, Poetry is the best words in the best order. অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসই হচ্ছে কবিতা। তাহলে পদ্যের প্রকৃত রং হলো এমন কিছু শব্দ এবং তাদের বিন্যাস যা গদ্যে ব্যবহার ও বিন্যাস থেকে ভিন্ন প্রকৃতির।

মাইকেল মধুসূদন দত্তও বলেছেন কবিতা হচ্ছে, শব্দের সাথে শব্দের বিবাহ দেয়া। তাঁর কথায়ও শব্দের পছন্দ এবং বিন্যাসের সমর্থন পাওয়া যায়। অনেক যাচাই বাছাইয়ের পর বর-কনের অনেককিছু ম্যাচ করে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। ম্যাচিং যত পারফেক্ট হয় বিবাহের স্থায়িত্ব তত স্ট্যাবল এবং সুখময় হয়। কবিতার ক্ষেত্রেও একটি শব্দের পাশে যত যুতসই শব্দ বসানো যাবে কবিতা ততই ভাবে ও স্বভাবে মানোত্তীর্ণ হবে, পাঠকের অন্তরে স্থায়িত্ব পাবে।

কবিতার আরেকটি রং হলো ছন্দ। ছন্দের ঝংকার কবিতাকে গদ্য থেকে আলাদা রঙে রঞ্জিত করে। কবি বিষ্ণু দে বলেন, "কবিতার এক অপরিবর্তনীয় শরীরই হলো ছন্দ।" ছন্দ  পদের অন্তে বুধ আর দুধ, আছি আর মাছি'র মিল নয়। আকারে- সাকারে, অলংকারে-আভরণে শব্দের মাধুর্যময় ঝংকার এবং ধ্বনির গতি নিয়ন্ত্রণের যতি দ্বারা পরিপ্লূত শব্দবিন্যাসই হচ্ছে ছন্দ।

অনেকে কবিতা থেকে ছন্দ মুক্তির কথা বলেন। Free Verse এর কথা বলেন। Free Verse সম্পর্কে টি এস এলিয়টের কঠোর মন্তব্যটি হলো-

"As for 'free verse' I expressed my view twenty five years ago by saying that no verse is free for the man who wants to do a good job. No one has better cause to know than I, that a great deal of bad prose had been written under the name of 'free verse' though whether its authors wrote bad prose or bad verse or bad verse in one style in another, seems to me a matter of indifference. But only a bad poet could welcome free verse as a liberation from form. ". (The Music of Poetry. Selected Prose  page 65)

মন্তব্যটির ভাবার্থ দ্বারায় Free Verse সম্পর্কে আমি পঁচিশ বছর আগে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছিলাম যে, যে কবি উৎকৃষ্ট কবিতা গড়তে চান তাঁর কাছে কোনো ছন্দই মুক্ত হতে পারে না আমার চেয়ে ভালো কারণ আর কারোরই জানা নেই যে, Free Verse এর নামে প্রচুর খারাপ গদ্যকবিতা লেখা হয়েছে। যদিও এর লেখকরা খারাপ গদ্য লিখেছেন বা খারাপ পদ্য বা শ্লোক। আমার কাছে এসব চরম অযত্নের এবং উদাসীনতার বিষয়। কিন্তু কেবল একজন অকবিই Free Verseকে কবিতা থেকে ছন্দমুক্তি বলে স্বাগত জানাতে পারেন।"

আমরা যারা নিরেট গদ্যের ঘাড় মটকে পঙক্তির স্তুপ দিয়ে নিজেদেরকে আধুনিক কবি বলছি টি এস এলিয়ট bad poet বলছেন। এরচেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?

কবিতার আরও একটি রং হলো অলংকার। পণ্ডিত বামনাচর্য বলেন, "কাব্যং গ্রাহ্যমলংকারাৎ।" যার অর্থ, অলংকৃত বাক্যই হলো কবিতা। অনেকেই বলতে পারেন, গদ্যেও তো অংকার থাকে। এর উত্তর হলো, নারী এবং পুরুষের অলংকার যেমন এক নয়, গদ্যের এবং কবিতার অলংকারও স্থান এবং ব্যবহারের পরিমিতিবোধের কারণে ভিন্ন হয়। অলংকারের ব্যবহার দেখেও গদ্য থেকে কবিতাকে আলাদা করা যায়।

পাঠকের অন্তরে রস সঞ্চারণের ভঙ্গি কবিতার আরও একটি চিত্তহারী রং। পণ্ডিত বিশ্বনাথ বলেন, "বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম।" অর্থাৎ, রসযুক্ত বাক্যই কাব্য। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতার এই রঙের উৎসমূল নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন-

"অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতির রস ধারা করি সিঞ্চন
সংসার-ধুলিজলে।"

অতএব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, গদ্যের শরীরে পদ্যের রং ছাড়া কবিতা হয় না বা এই রং যারা চিনেন না বা ব্যবহার করতে চান না টি এস এলিয়টের ভাষায় তারা bad poet বা অকবি; এমন উক্তি অত্যুক্তি কিনা তা কবিতাবোদ্ধাগণই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি এটা নির্দ্বিধায়  বলতে পারি, এই রঙের খেলা যিনি যত ভালো খেলতে পারেন, যত নিপুণ দক্ষতায় গদ্যের শরীরে লাগাতে পারেন নিঃসন্দেহে তিনি ততো ভালো কবি। চিত্রকরের রং ব্যবহারের নৈপুণ্যে যেমন ছবি দৃষ্টিনন্দন হয় তেমনি কবির শব্দ চয়ন ও বিন্যাস, ছন্দ ও অলংকার ব্যবহারের চমৎকারিত্বে এবং রস সঞ্চারণের নৈপুণ্যে কবিতা সাহিত্যমান সম্পন্ন ও কালোত্তীর্ণ হয় এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।

গদ্যকবিতা লিখে বিখ্যাত হওয়া ওয়াল্ট হুইটম্যানও বুঝতে পেরেছিলেন তার লেখা গদ্যকবিতাগুলো আসলে কবিতা নয়, গদ্যের একটি ভিন্ন প্রকরণ। তাই এগুলোর নাম দেন petty prose.

তাই গদ্য এবং পদ্যের রং চিনতে না পারলে এবং জায়গামতো লাগাতে না পারলে হয়তো টি এস এলিয়টের মতো কেউ অকবি বলার সাহস দেখাবে না। তবে "ব্যর্থ প্রেমিকের চেয়ে ব্যর্থ কবির সংখ্যা বেশি" এমন অপবাদ শুনতে হতে পারে।

মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান
অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়
১০ নভেম্বর ২০২৩
সময়: রাত ১.৪০ মিনিট