ছন্দের দ্বন্দ্বের হোক অবসান (পর্ব-১)
আর নয় দ্বিধা ভয় দ্বন্দ্ব
আসুন শিখি কবিতার ছন্দ।
ছন্দ শেখার দ্বন্দ্ব যাদের মনে
এই লেখাটা পড়বেন
শুধু সেই জনে।
মন্দ কথার গন্ধ না ছড়ায়ে
ছন্দে পটু পণ্ডিতজনে
সযতনে যাবেন এড়ায়ে।
তাল, লয়, ছন্দ ও পর্ব:
যারা কবিতা লিখেন অথচ ছন্দকে ভয় পান অথবা আয়ত্ত্ব করতে পারেন না তাদের কথা মাথায় রেখে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের পরিসরে ছন্দ বিষয়ক আলোচনায় ব্রতী হলাম। প্রথমেই বলে রাখি কবিতায় অন্তমিলের নাম ছন্দ নয়, মাত্রার মিলেই ছন্দ হয়। ছন্দ হচ্ছে পঙক্তির অভ্যন্তরে পর্বের শৃঙ্খলা। ছন্দে থাকে তাল ও লয়। বিষয়টি সহজে বুঝার জন্য প্রিয় পাঠকগণকে নদীর দিকে দৃষ্টি ফিরাতে বলবো। দেখুন স্রষ্টার সৃষ্টি কেমন ছন্দ-তালে চলে। যখন বাতাস বয় তখন নদীর পানি কেমন নির্দিষ্ট বিরতিতে ওঠা-নামা করে ঢেউ আকারে বাতাসের দিকে ধাবিত হয়। এই নির্দিষ্ট বিরতিতে সমান মাপে ঢেউয়ের ওঠা-নামাকে বলা হয় তাল এবং লয়।
যখন জোরে বাতাস বয় তখন ঢেউগুলো দ্রুত ছুটে। আর যখন আস্তে বাতাস বয় ঢেউগুলো ধীরে ছুটে। ঢেউয়ের ছুটে চলা নিয়ন্ত্রিত হয় বাতাসের চাপে। মানুষ বাকযন্ত্রের দ্বারা যে ধ্বনি সৃষ্টি করে তাও কিন্তু নিঃশ্বাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর ফলে স্বর ওঠা-নামা করে বাকযন্ত্রে ফুসফুস থেকে আসা বাতাসের চাপে। মানুষের সৃষ্ট ধ্বনি কখনও আস্তে হয়, কখনও জোরে হয়। কখনও ধীর হয়, কখনও দ্রুত হয়। এই ধ্বনিকে বলা হয় কণ্ঠস্বর। মানুষের কণ্ঠস্বরের নির্দিষ্ট মাপে ঢেউয়ের মতো এই ওঠা-নামাকেই বলা হয় তাল এবং লয়। এই নির্দিষ্ট মাপ হচ্ছে সময়ের মাপ। আর লয় হচ্ছে স্বরের ওঠা-নামা। তাল এবং লয় একটি আরেকটির সাথে সম্পৃক্ত।
লয় ৩ প্রকার।
১। দ্রুত লয়: কণ্ঠনিসৃত ধ্বনি যখন দ্রুত গতিতে ওঠা-নামা করে তখন তাকে বলা হয় দ্রুত লয়।
২। মধ্যম লয়: কণ্ঠনিসৃত ধ্বনি যখন দ্রুত গতিতে ওঠা-নামা না করে কিছুটা ধীর গতিতে ওঠা-নামা করে তখন তাকে বলা হয় মধ্যম লয়।
৩। ধীর লয়: কণ্ঠনিসৃত ধ্বনি যখন ধীর গতিতে ওঠা-নামা করে তখন তাকে বলা হয় ধীর লয়।
লয় নিয়ন্ত্রণ হয় ছন্দ দ্বারা। তাহলে বলতে পারি ধ্বনির গতি নিয়ন্ত্রণের যতি বা বিরতিই হলো ছন্দ।
যেমন:- বন্যায় দেশ ডুবে দেশের অশেষ ক্ষতি হলো। এই বাক্যটি পড়ার সময়-“ বন্যায় দেশ ডুবে” পর্যন্ত পড়ে সামান্য বিরতি দিয়ে পরের অংশ-“দেশের অশেষ ক্ষতি হলো” পড়া হলে শোনতে ভালো লাগে। বোধগম্য এবং শ্রুতিমধুর পাঠের জন্য একটি বাক্যের যতটুকু একবারে উচ্চারণ করা হলো তাকে বলা হয় পর্ব। এই বাক্যটিই যদি সরল বাক্যে না লিখে কবিতার চরণে ভাগ করে লিখি তাহলে দাঁড়াবে:-
“বানের জলে/ডুবল দেশ
ক্ষয়-ক্ষতির যে/ নেইকো শেষ।”
এক্ষেত্রে-১ম চরণে “বানের জলে” উচ্চারণ করে সামান্য বিরতি দিতে হয়। তারপর “ডুবল দেশ” পড়তে হয়।
২য় চরণে-“ক্ষয়-ক্ষতির যে” উচ্চারণ করে সামান্য বিরতি দিতে হয়। তারপর “নেইকো শেষ।”পড়তে হয়। একটি চরণের যেখানে গিয়ে যতি পড়ে সে পর্যন্ত অংশকে বলা হয় পর্ব।
যতি দ্বারা ধ্বনির গতি নিয়ন্ত্রণের ফলে একটি মধুর ধ্বনি তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। যতি দ্বারা ধ্বনির গতি নিয়ন্ত্রণের ফলে মধুর ধ্বনি তরঙ্গের সৃষ্টি হওয়াকে বলা হয় ছন্দ।
“কাব্যের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকে ছন্দ বলে।” (বাঙলা ছন্দ : জীবেন্দ্র সিংহরায়)
“মিলের নাম ছন্দ নয়। ছন্দ হচ্ছে পঙক্তির অভ্যন্তরে পর্বের শৃঙ্খলা।” (ছন্দের সহজ পাঠ: আবিদ আনোয়ার)
অর্থাৎ, কবি তার কবিতার ধ্বনিগুলোকে যে সুশৃঙ্খল বিন্যাসে বিন্যস্ত করে তাতে এক বিশেষ ধ্বনিসুষমা দান করেন, যার ফলে কবিতাটি পড়ার সময় পাঠক এক ধরনের ধ্বনিমাধুর্য উপভোগ করেন, ধ্বনির সেই সুশৃঙ্খল বিন্যাসকেই ছন্দ বলা হয়।
বাংলা কবিতার ছন্দকে ছন্দ বিশারদগণ প্রধানত ৩ ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা:-
১। স্বরবৃত্ত ছন্দ;
২। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ;
৩। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ।
এই ৩ প্রকার ছন্দ নিয়ন্ত্রণ হয় পর্ব দ্বারা। পর্ব নিয়ন্ত্রণ হয় মাত্রা দ্বারা। আবার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ বা হিসাব করা হয় অক্ষর দ্বারা।
এ পর্যন্ত আমরা তাল লয় ছন্দ এবং পর্ব কী তা হয়তো বুঝে গেছি। ছন্দের প্রকার সম্পর্কেও জেনেছি। এবার জানা যাক মাত্রা এবং অক্ষর কী।
মাত্রা ও অক্ষর:
নিঃশ্বাসের এক চাপে একটি শব্দের যতটুকু উচ্চারিত হয় কবিতায় তাকে অক্ষর বলা হয়। যেমন:- “অক্ষর” শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলে “অক” পর্যন্ত এক চাপে উচ্চারণ করে একটু থেমে “খর” অংশটি উচ্চারণ করতে হয়। এভাবে “অক্ষর” শব্দটিকে সম্পূর্ণ উচ্চারণ করতে নিঃশ্বাসে দুইটি চাপ পড়ে। আবার “উচ্চারণ” শব্দটি উচ্চারণ করতে “উচ” এক চাপে বলার পর সামান্য থেমে “চা” তার পর সামান্য থেমে “রণ” উচ্চারণ করতে হয়। এভাবে “উচ্চারণ” শব্দটিকে সম্পূর্ণ উচ্চারণ করতে নিঃশ্বাসে তিনটি চাপ পড়ে। প্রতি চাপে শব্দের যতটুকু উচ্চারিত হলো তার প্রতিটিই একটি অক্ষর। উপরের উদাহরণ থেকে দেখা যায় অক্ষরে একটি বর্ণও থাকতে পারে আবার একাধিক বর্ণও থাকতে পারে। আরও লক্ষণীয় যে, কোনো অক্ষর উচ্চারণ করতে গিয়ে মুখে আটকে যায়- যেমন “অক”, “খর” “উচ”। আবার কোনো অক্ষর যতক্ষণ খুশি দম শেষ না হওয়া পর্যন্ত উচ্চারণ করা যায়, যেমন-“চা”। এরূপ উচ্চারণের তারতম্যের কারণে যে অক্ষর মুখে আটকে যায় তাকে বলা হয় বদ্ধাক্ষর। আর যে অক্ষর দম শেষ না হওয়া পর্যন্ত উচ্চারণ করা যায় তাকে বলা হয় মুক্তাক্ষর। এই অক্ষর উচ্চারণের সময়কালকে বলা হয় মাত্রা।
মাত্রা গণনা:
শব্দের মধ্যে অক্ষরের ওপর (বর্ণ নয়) ভিত্তি করে মাত্রা গণনা করতে হয়। ছন্দের প্রকারের ওপর অক্ষরের মাত্রা সংখ্যা নির্ভর করে। আমরা জেনেছি অক্ষর ২ প্রকার। বদ্ধাক্ষর ও মুক্তাক্ষর। স্বরবৃত্ত ছন্দে ২ প্রকার অক্ষরকেই ১ মাত্রা গণনা করা হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বদ্ধাক্ষর যেখানেই থাকুক ২ মাত্রা এবং মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা গণনা করা হয়। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের শুরুতে এবং মাঝে বদ্ধাক্ষর থাকলে ১ মাত্রা এবং শেষে থাকলে ২ মাত্রা গণনা করা হয়। অক্ষরবৃত্তে স্বাধীন বদ্ধাক্ষর সকল অবস্থানে ২ মাত্রা গণনা করা হয়। যেমন- আর নয় হতাশা। এখানে “আর” এবং “নয়” দুটি স্বাধীন বদ্ধাক্ষর। এ জন্য এমন বদ্ধাক্ষরকে অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা গণনা করা হয়।
এটি হলো মাত্রা গণনার সাধারণ নিয়ম। তবে ছন্দ ভেদে এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন প্রকার ছন্দ নিয়ে আলোচনা করার সময় ব্যতিক্রমগুলোও আলোচনা করব। তার আগে শব্দের অক্ষর বের করা শিখে নিই।
শব্দের অক্ষর বের করা:
আগেই বলেছি একটি শব্দের যতটুকু অংশ এক চাপে উচ্চারণ করা যায় তাই হলো অক্ষর। ইংরেজি sylable- এর মতো। যেমন-আমার সোনার বাংলা, এ বাক্যাংশটিতে শব্দ আছে ৩টি। আমার, সোনার এবং বাংলা। এই তিনটি শব্দের প্রতিটিতে উচ্চারণ অনুসারে দেখা যাক কয়টি অক্ষর পাওয়া যায়। অক্ষর বের করতে পারলে ছন্দ ভেদে মাত্রা সংখ্যাও বলতে পারব।
আমার শব্দটিকে উচ্চারণ করতে-আ এবং মার এ দুটি চাপে উচ্চারণ করতে হয়। এজন্য এখানে ২টি অক্ষর আছে। ১মটি মুক্তাক্ষর, ২য়টি বদ্ধাক্ষর (মুক্তাক্ষর এবং বদ্ধাক্ষর কী তা পূর্বেই আলোচনা করা হযেছে)। সোনার শব্দটি উচ্চারণ করতে তদ্রুপ সো এবং নার এ দুটি চাপে উচ্চারণ করতে হয়। আবার বাংলা শব্দটি উচ্চারণ করতেও বাং এবং লা এ দুটি চাপে উচ্চারণ করতে হয় বলে দুটি শব্দেই ২টি করে অক্ষর পাই। এভাবে “অকালপক্ক” শব্দটি উচ্চারণ করতে অ+কাল+পক+ক এ চারটি চাপে উচ্চারণ করতে হয় বলে এখানে ৪টি অক্ষর পাই; ১ম এবং শেষেরটি মুক্তাক্ষর, মাঝের ২টি বদ্ধাক্ষর।
প্রখ্যাত কবি আবিদ আনোয়ার থুতনি ধরে অক্ষর গণনার সহজ পদ্ধতির কথা বলেছেন। আপনি চিন্তারত স্টাইলে থুতনির নিচে হাত রেখে উচ্চারণ করুন “অক্ষর”। যতবার থুতনির চাপ হাতে লাগবে ততটি অক্ষর পাবেন। এ ক্ষেত্রে ২ বার চাপ পড়বে। তাই “অক্ষর” শব্দে ২টি অক্ষর পাবেন। “মাদ্রাসা” শব্দটি উচ্চারণ করুন। ৩ বার চাপ লাগবে, তাই এটিতে ৩টি অক্ষর। এভাবে আপনি সহজেই শব্দের অক্ষর বের করে ছন্দ অনুসারে মাত্রা্ গণনা করতে পারবেন।
উল্লেখ্য যে, কিছু অক্ষর একাধিক বর্ণ মিলে হলেও কিন্তু বদ্ধাক্ষর নয়। যেমন-স্ত্রী=স+ত+র বর্ণ মিলে যুক্তাক্ষর কিন্তু বদ্ধাক্ষর নয়। এরূপ কিছু ইংরেজি শব্দ যেমন-স্টার, প্লে, ক্লিক ইত্যাদি।
তাহলে আসুন আমরা শব্দের অক্ষর বের করা শিখি। তার পরে বিভিন্ন প্রকার ছন্দের বৈশিষ্ট্য ও মাত্রা গণনা শিখব।
আজ এ পর্যন্তই।
ধন্যবাদ সবাইকে।
১৪-১-২০১৯
ছন্দের দ্বন্দ্বের হোক অবসান (পর্ব-২)
আমরা এতক্ষণে শব্দের অক্ষর বের করা শিখে নিয়েছি। এখন শিখব বিভিন্ন প্রকার ছন্দে অক্ষর অনুসারে মাত্রার ব্যবহার এবং পর্ব বিষয়ে আরো কিছু তথ্য। প্রথমেই শিখব স্বরবৃত্ত ছন্দ সম্পর্কে। এর আগে আমরা পর্ব সম্পর্কে জেনেছি। এখানে পর্ব সম্পর্কে আরেকটু বিষয় জানব। যে বৃত্তের ছন্দে যত মাত্রা নিয়ে মূল পর্ব গঠিত হয় তাকে বলা হয় পূর্ণ পর্ব। পূর্ণ পর্ব অপেক্ষা কম মাত্রা নিয়ে কোনো পর্ব পূর্ণ পর্বের পূর্বে বসলে তাকে বলা হয় অতিপর্ব এবং পরে বসলে বলা হয় অপূর্ণ পর্ব। আবার পূর্ণ পর্বেও ছোট ছোট অংশ থাকতে পারে, তাকে বলা হয় উপ-পর্ব।
এখানে আমরা আরেকটি বিষয় জানব। সেটা হলো মধ্যখণ্ডন। মধ্যখণ্ডন হচ্ছে কোনো অপূর্ণ পর্বকে পূর্ণ পর্ব বানাতে পরের শব্দকে অক্ষরে ভেঙে একটি অক্ষর (বর্ণ নয়) তার সাথে যুক্ত করা। ছন্দবিষয়ক আলোচনায় যখন উদাহরণ দিবো তখন বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।
স্বরবৃত্ত ছন্দ:
স্বরবৃত্ত ছন্দকে ছড়ার ছন্দ বলা হলেও আধুনিককালে গুরুগম্ভীর কবিতাও স্বরবৃত্ত ছন্দে লিখা হয়েছে এবং হচ্ছে। স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য হলো:
ক) সাধারণত এটি দ্রুত লয়ের ছন্দ। টাট্টু ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে চলা এর মূল বৈশিষ্ট্য।
খ) পুরো কবিতায় সকল চরণে মূল পর্বটি ৪ মাত্রার হয়।
গ) মূল পর্বের পূর্বে ৪ মাত্রার কম (১-৩ মাত্রার) অতিপর্ব এবং পরে অপূর্ণ (১-৩ মাত্রার) পর্ব ধারণের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।
ঘ) ভোগ করতে পারে শব্দের মধ্যে মধ্যখণ্ডনের সুবিধা।
ঙ) মূল পর্বে সাধারণত ৪ মাত্রা থাকা আবশ্যক হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩ মাত্রার শব্দ বাক্যাংশ ৪ মাত্রার এবং ৫ মাত্রার শব্দ বা বাক্যাংশ ৪ মাত্রার মূল্য লাভের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।
চ) মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর ১ মাত্রা গোনতে হয়।
ছ) থুতনি পদ্ধতিতে অক্ষর ও মাত্রা বের করা যায়।
জ) প্রতি চরণে পূর্ণ পর্বে মাত্রার সংখ্যা সমান অর্থাৎ ৪ মাত্রার হওয়া আবশ্যক হলেও অতিপর্ব বা অপূর্ণ পর্বে মাত্রার সংখ্যা সমান হওয়া আবশ্যক নয়।
ঝ) পঙক্তি বিন্যাসে প্রত্যেক পঙক্তির মোট মাত্রা সমান হওয়াও আবশ্যক নয়।
উদাহরণ: এই ছন্দটি ছড়া এবং গানে বেশি ব্যবহার হয় বলে প্রথমে একটি গানের কলির উদাহরণ দিলাম।
দরবারে তার ছিলো আমার সোনার সিংহাসন
আমি হাজার হাতের সেলাম পেলাম পেলাম না তো মন
আজ মখমলের ঐ পর্দাগুলো
ওড়ায় শুধু স্মৃতির ধুলো
ফুলবাগানের বাতাস এসে আছড়ে পড়ে যেই
দেখি মুকুটটা তো পড়ে আছে রাজাই শুধু নেই
(কথা:পুলক বন্দোপাধ্যায়, সুর: নচিকেতা ঘোষ)
গানের এই কলিটির শব্দগুলো থেকে পূর্বে উল্লেখিত নিয়মে অক্ষরগুলো বের করে নিয়ে পর্ব বিভাজন করি।
দর+বা+রে+তার (৪ মাত্রা)/ছি+লো+আ+মার (৪)/সো+নার+সিং+হা (৪)/সন(১)
আ+মি (২)/হা+জার+হা+তের (৪)/সে+লাম+পে+লাম (৪)/পে+লাম+না+তো (৪)/মন(১)
আজ(১)/মখ+ম+লের+ ঐ(৪)/পর+দা+গু+লো(৪)
ও+ড়ায়+শু+ধু(৪)/স্মৃ+তির+ধু+লো(৪)
ফুল+বা+গা+নের(৪)/বা+তাস+এ+সে(৪)/আছ+ড়ে+প+ড়ে(৪)/যেই(১)
দে+খি(২)/মু+কুট+টা+তো(৪)/প+ড়ে+আ+ছে(৪)/রা+জাই+শু+ধু(৪)/নেই(১)
আগেই বলেছি যে, বাক্য বা চরণের যতটুকু একসাথে পড়ে সামান্য থামতে হয় ততটুকু অংশকে পর্ব বলা হয়। উক্ত উদাহরণটির ১ম চরণে-(দরবারে তার) এটুকু পড়ে যতি দিতে হচ্ছে। এ কারণে এটি একটি পর্ব। আবার (ছিলো আমার) এটুকু পড়ে যতি দিতে হচ্ছে বলে এটিও একটি পর্ব। এভাবে (সোনার সিংহাসন) এক সাথে পড়া গেলেও প্রতি পূর্ণ পর্বে যেহেতু ৪ মাত্রা থাকতে হবে সেহেতু (সিংহাসন) শব্দটি হতে (সিং+হা) অক্ষর দুটি নিয়ে (সোনার সিংহা) পর্যন্ত ৪ মাত্রার পূর্ণ পর্ব রেখে (সন) অক্ষরটি আলাদা করা হয়েছে। এরূপ শব্দ ভেঙে অক্ষর আলাদা করার নামই হচ্ছে মধ্যখণ্ডন।
২য় চরণে-(আমি) বলার পর একটু থামতে হচ্ছে। একারণে আমি একটি পর্ব। যেহেতু এই পর্বটির মাত্রা মূল পর্ব থেকে কম এবং মূল পর্বের পূর্বে অবস্থান নিয়েছে এ কারণে এটিকে বলা হয় অতিপর্ব। এভাবে ৩য় চরণে (আজ), ৬ষ্ঠ চরণে (দেখি) পড়ে সামান্য থামতে হচ্ছে এবং পূর্ণ পর্ব অপেক্ষা কম মাত্রা নিয়ে পূর্বে অবস্থান করছে বলে এগুলো অতিপর্ব।
১ম, ২য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ চরণের শেষে (সন), (মন), (যেই), (নেই) যেহেতু পূর্ণ পর্বের শেষে অবস্থান এবং পূর্ণ পর্ব থেকে মাত্রা সংখ্যা কম সেহেতু এগুলোকে বলা হয় অপূর্ণ পর্ব।
এরূপ আমার একটি গীতি কবিতার উদাহরণ:
যদি/ ভেঙে যায় ঘর/ কালবৈশাখী/ ঝড়ে
যদি/ ঊড়ে যায় প্রেম/ বাতাসের তো/ড়ে
বলো) রুখি তা কী/ করে
বলো) রুখি তা কী/ করে?
চাঁদেরো আ/কর্ষণে আ/সে যে জোয়ার
বালির বাঁধে/ কি তা মানে
ভেসে যায় য/দি বর্ষার ন/দী ভাটার টা/নে
বলো) রুখি তা কী/ করে
বলো) রুখি তা কী/ করে?
যদি/ যেতে চাও-যাও/ ডাকব না পি/ছু আর
মন চায় যদি/ নিরবধি/ ভেঙে যাও অঙ/গী কার।
ভেঙে যায় যাক/ স্বপনের ঘর,/ ভেবো না তু/মি
হৃদয়ভূমি/ পেতে দেবো/ পথ পরে
কণ্টক পথে/ হেঁটে যেতে/ যেতে
যেন) রক্ত না ঝ/রে
যেন) রক্ত না ঝ/রে।
(যদি ভেঙে যায় ঘর)
আমার লেখা আরও একটি গীতি কবিতা:
চারু বুকের/ গহীন ভাঁজে/ রিনিকঝিনিক/ চুড়ির আওয়াজ
বাজে) সকাল সাঁঝে
অন্ধকারের/ আঁচল টেনে/ পুলক প্রাণে/ সঙ্গোপনে
শরীর ঢাকি/ লাজে।
রঙের ফাগুন/ পার হয়ে যায়,/ করুণ সুরে/ পিক গেয়ে যায়
তবু মেয়ের/ দক্ষিণ দুয়ার/ আজো খুললো/ না যে!
চারু বুকের/ গহীন ভাঁজে/ রিনিকঝিনিক/ চুড়ির আওয়াজ
বাজে) সকাল সাঁঝে।
শীতের শেষে/ জীর্ণ পাতা/ উত্তরী বায় ঝ/রে
ঘুম ভেঙে যায়/ ব্যাকুলতায়/ তারই পায়ের
আওয়াজ মনে/ করে।
আসলো না সে,/ হাসলো না সে,/ ভাসলো না সে/ প্রেম যমুনায়
তার হাসিমুখ/ দেখে পাই সুখ/ ফুলের হাসির/ মাঝে।
চারু বুকের/ গহীন ভাঁজে/ রিনিকঝিনিক/ চুড়ির আওয়াজ
বাজে/ সকাল সাঁঝে।
(চারু বুকে চুড়ির আওয়াজ)
আমার লেখা একটি কবিতার উদাহরণ:
ঘুমের মাঝে চোখে ভাসে
শেখ মুজিবের ছবি
হৃদয় আলো করতে যে আর
ওঠবে নাকো তারচে বড় রবি।
.............................
(শেখ মুজিব চিরঞ্জীব)
এবার স্বরবৃত্ত ছন্দের যেসকল বৈশিষ্ট্যের কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি তার সাথে মিলিয়ে নিন। দেখবেন ঙ) ছাড়া সকল বৈশিষ্ট্যই পেয়ে গেছেন।
স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম-১
স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য ঙ) তে বলা হয়েছে মূল পর্বে সাধারণত ৪ মাত্রা থাকা আবশ্যক হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩ মাত্রার শব্দ বা বাক্যাংশ ৪ মাত্রার এবং ৫ মাত্রার শব্দ বাক্যাংশ ৪ মাত্রার মূল্য লাভের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।
সেটা কিভাবে ঘটে এবার দেখা যাক।
“লোকটি ছিলো(৪)/আর দশজন(৩)/লোকের মতোই(৪)/খুব সাধারণ(৪)
আকারে ও(৪)/বেশভূশাতে(৪)
দোহারা তার(৪)/শরীর জুড়ে(৪)/লেপ্টে ছিলো(৪)/বাঙারপনা(৪)
(লোকটি-আনিসুল হক)
এদিকে হায়(৪)/আমার নিজের(৪)/রসদ ফুরায়(৪)/অবশেষে(৪)
তবু আমি(৪)/ভয় পাই না(৩)/ফুরায় না তো(৪)/মনোবল(৩)
(একটু আরো কষ্ট সয়ে-শাসুর রাহমান)
এ দুটি উদাহরণের ১মটিতে আমরা দেখি চরণের মাঝখানে (আর দশজন) ৩ মাত্রা হওয়া সত্ত্বেও ৪ মাত্রার মূল্য নিয়ে পূর্ণ পর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার ২য়টিতে দেখি চরণের মাঝখানে (ভয় পাই না) ৩ মাত্রা হওয়া সত্ত্বেও ৪ মাত্রার মূল্য নিয়ে পূর্ণ পর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এর কারণ কী? এর কারণ হলো-
১) শব্দের শুরু থেকে পরপর ৩টি বদ্ধাক্ষর থাকলে এর উচ্চারণকাল স্বরবৃত্তীয় রীতিতে ৪ মাত্রার শব্দ বা বাক্যাংশের উচ্চারণকালের সমান।
২) শব্দের শুরু থেকে পরপর ২টি বদ্ধাক্ষর এবং পরে ১টি মুক্তাক্ষর থাকলে এর উচ্চারণকাল স্বরবৃত্তীয় রীতিতে ৪ মাত্রার শব্দ বা বাক্যাংশের উচ্চারণকালের সমান।
তাহলে স্ববৃত্তের নিয়মে আমরা প্রথম যে ব্যতিক্রমটি পেলাম সেটি হলো-
শব্দের শুরু থেকে পরপর ৩টি বদ্ধাক্ষর থাকলে অথবা ২টি বদ্ধাক্ষর ও ১টি মুক্তাক্ষর থাকলে স্বরবৃত্তীয় রীতিতে ৪ মাত্রার মূল্য পায় এবং পূর্ণ পর্ব হিসেবে মেনে নেয়া যায়। তবে শর্তটি মনে রাখতে হবে ৩টি হোক আর ২টি হোক বদ্ধাক্ষরগুলো থাকতে হবে শব্দের শুরু থেকে পরপর। শুরুতে কিংবা মাঝে একটি মুক্তাক্ষর থাকলে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এরূপ পর্বটি থাকতে হবে ৪ মাত্রার ২টি পূর্ণ পর্বের মাঝে। কারণ, চরণের শেষে হলে অপূর্ণ পর্ব, আর প্রথমে হলে অতিপর্ব হিসেবে গণ্য হতে পারে।
স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম-২
“না, কিছু(৩)/হয়নি আমার(৪)/এই তো ভালো(৪)/আছি(২)”
“হায়! তুমি(৩)/করলে এ কী(৪)/ভেবে অবাক(৪)/হই(১)”
এ উদাহরণ দুটিতে “না” এর পর কমা বসে একটু সময় নিয়েছে। আবার “হায়” এর পর বিস্ময় চিহ্ন বসে একটু সময় নিয়েছে। এরকম যতির কারণে যে সময় ব্যয় হয় তাতে ১ মাত্রার ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। ফলে ৪ মাত্রার মূল্য পায় এবং পূর্ণ পর্ব ধরা হয়।
তাহলে স্ববৃত্তের নিয়মে আমরা ২য় যে ব্যতিক্রমটি পেলাম সেটি হলো-
কোনো পর্বে ব্যবহৃত অক্ষরের পরে কমা অথবা বিস্ময় চিহ্ন বসার ফলে যে বিরতি পড়ে তার জন্য ১ মাত্রা যুক্ত হয় এবং পূর্ণ পর্ব হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম-৩
শিল্পকর্মে(৪)/আস্থা ছিলো(৪)/বলেই ক্ষুধার(৪)/দাঁতে(২)
দীর্ণ হয়ে(৪)/ক্লিন্ন প্রাণে(৪)/পোড়াই আতশ(৪)/বাজি
ঘুমাক তারা(৪)/ঘুমাক সুখে(৪)/নিদ্রা এলে(৪)/রাতে(২)
ঝুলিয়ে কাঁধে(৫)/মরা পাখি(৪)/আমরা ঘুরতে(৪)/রাজি(২)
(সম্পাদক সমীপেষু-২, শামসুর রাহমান)
উক্ত উদাহরণটিতে (ঝুলিয়ে কাঁধে) ৫ মাত্রা হলেও ৪ মাত্রার পূর্ণ পর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
তাহলে স্ববৃত্তের নিয়মে আমরা ৩য় যে ব্যতিক্রমটি পেলাম সেটি হলো-
“য়ে” যুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়া পদের সমন্বয়ে গঠিত পর্ব ৫ মাত্রা হলেও ৪ মাত্রার পূর্ণ পর্ব হিসেবে গণ্য হয়।
স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম-৪
“ইয়াসমিনের/সঙ্গে তুমি/দিনাজপুরের/বাসে
তুমিও বাড়ি(৫)/যাচ্ছিলে তো/ ইয়াসমিনের/পাশে”
(দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের গান-সৈয়দ শামসুল হক)
পদ্য লিখে/চরণ শেষে/ না দিই যদি/যতি
তুমি-ই বলো(৫)/পদ্য লেখায়/কী-ইবা এমন(৫)/ক্ষতি
উক্ত উদাহরণ দুটিতে (তুমিও বাড়ি) এবং (তুমি-ই বলো), (কী-ইবা এমন) পর্বগুলো ৫ মাত্রা হলেও ৪ মাত্রার পূর্ণ পর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
তাহলে স্ববৃত্তের নিয়মে আমরা ৪র্থ যে ব্যতিক্রমটি পেলাম সেটি হলো-
শেষে ‘ও’ যুক্ত এবং ‘ই’যুক্ত শব্দের সমন্বয়ে গঠিত পর্ব ৫ মাত্রার হলেও ৪ মাত্রার পূর্ণ পর্ব হিসেবে গণ্য হয়।
স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম ৩ এবং ৪ এর একই কবিতায় ব্যবহারের আরেকটি উদাহরণ:
“তোমার উপর/আসে যখন/আমার ভীষণ/রাগ
ভাবি তোমায়/আর দেবো না/আমার ব্যথার/ভাগ।
বাকি জীবন/তোমার সাথে/হবে না আর/কথা
দেখবো তোমায়/কাঁদায় কেমন/আমার নীর/বতা।
ডাকলে তুমি/কাছে গিয়েও(৫)/চাইবো নীরব/চোখে
তোমার আমার/বিরোধটা কী/বুঝবে নাকো/লোকে।
বুঝবে তুমি/বুঝবো আমি/জমাট বরফ/মাঝে
বুঝবে আরো/পূর্ণিমা চাঁদ/জ্যাৎস্না হাসা/সাঁঝে।
নীরব মনে/আমার ব্যথায়/আমিই যাবো(৫)/পুড়ে
করব না ভোগ/যেটুকু সুখ/তোমার জগত/জুড়ে।
থাকবে তুমি/তোমার মতো/আমার মতো/আমি
মধ্যিখানে/দাঁড়িয়ে নীরব(৫)/কাঁদবে দিবস/যামী।
(তোমার উপর রাগ-খলিলুর রহমান)
এখানে (কাছে গিয়েও), (আমিই যাবো), (দাঁড়িয়ে নীরব) পর্বগুলো ৫ মাত্রার হলেও ৪ মাত্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
তবে বলে রাখি এসব ব্যতিক্রম তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন উচ্চারণে পতন বা অতিরেক কানে না লাগে। আর এসব ব্যতিক্রমী চাল অহরহ না দিয়ে মাঝে মধ্যে ব্যবহার করা উচিত। আরও বলে রাখি যারা আমার মতো নবিশ তাদের জন্য ব্যতিক্রমী চালে না যাওয়াই ভালো। ছন্দে যখন পটু হয়ে যাবেন তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা আপনি সহজেই নিতে পারবেন।
আলোচনার কলেবর ছোট রাখার স্বার্থে অল্পসংখ্যক উদাহরণ দিয়ে শেষ করলাম। আশা করি স্বরবৃত্ত ছন্দ সম্পর্কে আপনাদের ভীতি অনেকটা কমে এসেছে। এবার চর্চা করতে থাকুন। আলোচনা পাতায় ছন্দবিষয়ক আরও আলোচনা আছে। সেগুলোও দেখতে পারেন। আর কোনো পরামর্শ থাকলে মন্তব্যের মাধ্যমে জানান। কেউ সামান্যতম উপকৃত হলেও তা জানান। আমিও আপনাদের নিকট হতে কিছু শিখতে চাই। আজ এ পর্যন্তই।
সাথে থাকার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
১৭-১-২০১৯
ছন্দের দ্বন্দ্বের হোক অবসান (পর্ব-৩)
আশা করি স্বরবৃত্ত ছন্দ বিষয়ে আপনাদের আর কোনো সংকোচ থাকার কথা নয়। যদি সামান্য থেকে থাকে তবে চর্চা করতে থাকলে তা কেটে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। আসুন এবার আমরা মাত্রাবৃত্ত ছন্দ সম্পর্কে জানি।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ মূলত সংস্কৃত কবিতার সম্পদ। চর্যাপদ ও বৈষ্ণব পদাবলীতে সীমিত প্রয়োগ থাকলেও এতটা নিখুঁত ছিলো না। বাংলায় প্রথম এই ছন্দের নিটোল ও সার্থক প্রয়োগ ঘটান মাইকেল মধুসূদন দত্ত। পরে এর মধ্যে বৈচিত্র্য আনেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (মানসী ও সোনার তরী) এবং চমৎকারিত্ব ও প্রবাহমানতা আনেন কাজি নজরুল ইসলাম (বিদ্রোহী কবিতাটি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ)।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য:
১। এই প্রকার ছন্দে স্বরবৃত্তের মতো প্রতি পংক্তিতে পূর্ণ পর্বে মাত্রার সংখ্যা সমান হতে হয়।
২। পূর্ণ পর্ব ৪, ৫, ৬, ৭ বা ৮ মাত্রা বিশিষ্ট হতে পারে। তবে একই কবিতায় কোন পংক্তিতে ৪, কোন পংক্তিতে ৫, কোন পংক্তিতে ৬ মাত্রার পূর্ণ পর্ব এরূপ হবে না। প্রথম পূর্ণ পর্বটি যত মাত্রার হবে সকল পংক্তিতে তত মাত্রার পূর্ণ পর্ব হবে।
৩। স্বরবৃত্তের মতো অতিপর্ব, অপূর্ণ পর্ব এবং মধ্যখণ্ডনের সুবিধা ভোগ করতে পারে।
৪। অপূর্ণ পর্বের মাত্রা সংখ্যা প্রতি পংক্তিতে সমান হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এক মাত্রার অতিপর্বও হতে পারে আবার ৫ মাত্রার অতিপর্বও হতে পারে।
৫। বদ্ধাক্ষর সকল অবস্থানে ২ মাত্রা পায়। এবং মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা পায়। যেমন-অবান্তর=অ+বান+তর=১+২+২=৫মাত্রা
৬। যুক্ত বর্ণ ভেঙ্গে উচ্চারণ করে মাত্রা গণনা করা যায়। যেমন-অবান্তর=অ বা ন ত র=৫ মাত্রা।
৭। থুতনি পদ্ধতিতেও অক্ষর এবং মাত্রা বের করা যায়।
৮। রুদ্ধদল বা বদ্ধাক্ষর ২ মাত্রা পায় বলে স্বরবৃত্তের মতো ধ্বনি সংকোচন নেই, আছে ধ্বনির বিস্তার ও বিলম্বিত লয় এবং রুদ্ধ দলের বিশ্লিষ্ট বা সম্প্রসারিত উচ্চারণ।
৯। ভাব ললিত মধুর।
১০। এই প্রকার ছন্দের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হচ্ছে গীতপ্রবণতা বা সুর নিষ্ঠা।
১১। এই প্রকার ছন্দে ৎ, ং এবং ঃ মাত্রা পায়। যেমন-অলংকার=অ+লং+কার=৫ মাত্রা কিন্তু অক্ষরবৃত্তে ৪ মাত্রা। সৎসাহসী=সৎ+সা+হ+সী=৫মাত্রা কিন্তু অক্ষরবৃত্তে ৪ মাত্রা।
১২। যুগ্ম-ধ্বনি ঐ, ঔ ২ মাত্রা পায়।
১৩। যুক্তবর্ণ শব্দের প্রথমে থাকলে একমাত্রা এবং অন্য যে কোনো স্থানে ২ মাত্রা হিসাব করা হয়। যেমন-শ্বাস=শ্বা+স=২ মাত্রা। কিন্তু বিশ্বাস শব্দে যুক্ত বর্ণটি মাঝখানে। এজন্য-বিশ+শাস= দুটি বদ্ধাক্ষর হয়ে যাওয়ায় এটি ৪ মাত্রার শব্দ।
১৪। শব্দের প্রথমে ফলা যুক্ত বর্ণ বাড়তি মাত্রা পাবে না। যেমন প্ল প্র গ্ল শব্দের প্রথমে এসব যুক্ত বর্ণ এক মাত্রা ধরা হবে কার সহ বা কার মুক্ত। কিন্তু শব্দের মাঝে যুক্ত বর্ণ ও ফলা যুক্ত বর্ণ দুই মাত্রা পাবে। কিন্তু শব্দে ব -ফলা যদি দ্বিত্বতা না ঘটায় তবে কোনো বাড়তি মাত্রা পাবে না।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ-১:
গগনে গ/রজে মেঘ/ ঘন বর/ষা=৪+৪+৪+১
কূলে একা/বসে আছি/নাহি ভর/সা= ৪+৪+৪+১
রাশি রাশি/ভারা ভারা/ধান-কাটা/হলো সারা= ৪+৪+৪+৪
ভরা নদী/ক্ষুর ধারা/খরপর/শা= ৪+৪+৪+১
কাটিতে কা/টিতে ধান/এল বর/ষা= ৪+৪+৪+১ (সানার তরী-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ-২:
সকাল বেলা/কাটিয়া গেল/বিকাল নাহি/যায়=৫+৫+৫+২
দিনের শেষে/ শ্রান্ত ছবি/কিছুতে যেতে/চায় না রবি=৫+৫+৫+৫
চাহিয়া থাকে/ধরণী পানে/বিদায় নাহি/চায়=৫+৫+৫+২ (অপেক্ষা, মানসী কাব্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ-৩:
কেন এত ফুল/তুলিলি সজনী/ভরিয়া ডালা=৬+৬+৫
মেঘাবৃতা হলে/পরে কি রজনী/তারার মালা=৬+৬+৫ (কুসুম: ব্রজাঙ্গনা কাব্য-মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ-৪:
এমন দিনে তারে/বলা যায়=৭+৪
এমন ঘনঘোর/বরিষায়=৭+৪
এমন মেঘস্বরে/বাদল ঝরঝরে=৭+৭
তপনহীন ঘন/তমসায়=৭+৪ (বর্ষার দিনে: মানসী কাব্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
৮মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে ৪/৪ মাত্রায় ভাগ করা যায় বলে মূলত এটিকে ৪মাত্রার মাত্রাবৃত্ত বলা হয়।
অতিপর্ব, অপূর্ণপর্ব, মধ্যখণ্ডন বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে তাই এখানে আর আলোচনার প্রয়োজন মনে করছি না। তবে মধ্যখণ্ডন বিষয়ে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, বদ্ধাক্ষরে মধ্যখণ্ডন দিয়ে কোনো বর্ণকে আলাদা করা যায় না। যেমন-সম্পর্ক শব্দটিতে, সম+পর+ক এই ৩টি অক্ষর আছে যার দুটি বদ্ধাক্ষর ‘সম’ এবং ‘পর’। প্রতিটি বদ্ধাক্ষরে দুটি করে বর্ণ আছে। সম এর মাঝে খণ্ডন করে স এবং ম কে আলাদা করা যাবে না। আজ এ পর্যন্তই। এর পর আমরা অক্ষরবৃত্ত ছন্দ সম্পর্কে জানবো।
সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ।
১৮-২-২০১৯
ছন্দের দ্বন্দ্বের হোক অবসান (পর্ব-৪)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ:
বাংলা ছন্দের সবচেয়ে অভিজাত, গুরুগম্ভীর, ধীর লয় ও বৈচিত্রময় ছন্দ হলো অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। এই ছন্দ লেখকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। স্তবকে পর্ব সমতারও ধার ধারে না। মুক্তাক্ষর বদ্ধাক্ষর মাত্রা গণনায় মাত্রাবৃত্রের থেকে এটি ভিন্ন হলেও ক্ষেত্রবিশেষে শব্দে যত বর্ণ তত অক্ষর তত মাত্রা লাভের সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। অনেকে এই ছন্দটিকে কঠিন ছন্দ মনে থাকেন। আসলে ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে গেলে মনে হবে এটি আসলেই সহজ একটি ছন্দ। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া শব্দ দেখেই মাত্রা গণনা করা যায়। আবার শব্দের প্রথমে বা মাঝে বদ্ধাক্ষর ১ মাত্রা পাওয়ার বিধান থকলেও ক্ষেত্রমতো এলায়িত উচ্চারণের মাধ্যমে ২ মাত্রার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। শব্দচয়ন এবং প্রক্ষেপণের দিকে খেয়াল রাখতে পারলে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে গদ্য কবিতা লেখা মোটেও কঠিন কিছু নয়।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে বর্ণ বৃত্ত ছন্দও বলা যায়। আর আমরা যদি বর্ণবৃত্ত বলি তবে বাংলা বর্ণমালার সব বর্ণ, বর্ণবৃত্ত ছন্দে এক মাত্রা ধরবো।
ক – ঃ প্রতিটি বর্ণ এক মাত্রা। ঁ কোনো মাত্রা পায় না।
এই ছন্দের বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে-
১। সাধারণত শক্দের প্রথমে বা মাঝে বদ্ধাক্ষর থাকলে ১ মাত্রা এবং শেষে থাকলে ২ মাত্রা পায়।
২। স্তবকে পর্বসমতা রক্ষা করতে হয় না। একটি স্তবকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার পর্ব থাকতে পারে।
৩। অতিপর্ব বা অপূর্ণ পর্ব বলে কিছু নেই। পঙক্তিতে ব্যবহৃত মোট মাত্রার সংখ্যা থেকেই এর নামকরণ করা হয়।
৪। ক্ষেত্রবিশেষে শব্দে যত বর্ণ তত অক্ষর বা মাত্রা লাভের সুবিধা গ্রহণ করে থাকে।
৫। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া শব্দ দেখেই মাত্রা গণনা করা যায়।
৬। আবার শব্দের প্রথমে বা মাঝে বদ্ধাক্ষর ১ মাত্রা পাওয়ার বিধান থাকলেও ক্ষেত্রমতো এলায়িত উচ্চারণের মাধ্যমে ২ মাত্রার স্বাধীনতা যেমন ভোগ করতে পারে। তেমনি অক্ষর গুটিয়ে ১ মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। যেমন- অনেক বাংলা শব্দ চার অক্ষরের। কিন্তু উচ্চারণ হয় তিন অক্ষরের মতো। এদের তিন মাত্রাই দেয় অক্ষরবৃত্ত। যেমন- চারজন, হাড়গিলে, কাতরাতে, কলকাতা, বুলবুলি উচ্চারণের সময়ে হয়ে যায় চার্জন, হার্গিলে,কাত্রাতে, কল্কাতা, বুল্বুলি। তাই এদের মূল্য তিন মাত্রা। একই ভাবে কিছু তিন অক্ষরের শব্দ উচ্চারণের সময়ে গুটিয়ে দুই অক্ষরের শব্দে পরিণত হয়। তাই তাদের মূল্য ২ মাত্রা। যেমন- বাজনা, খাজনা, সজনে ইত্যাদি গুটিয়ে গিয়ে বাজ্না,খাজ্না,সজ্নে হয়ে যায়।
আবার একদিন, আজকাল, রাজপথ ইত্যাদি শব্দে এক, আজ, রাজ বদ্ধাক্ষর এবং শব্দের প্রথমে হওয়ায় ১ মাত্রা পাওয়ার কথা। কিন্তু এরূপ বদ্ধাক্ষর ২ মাত্রা লাভ করে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে এসকল শব্দের দুটি অংশই আলাদা আলাদা অর্থপূর্ণ শব্দ। তাছাড়া ১ মাত্রা ধরার স্বাধীনতাও ভোগ করা যায়। তবে একই কবিতায় এরূপ সুবিধায় একবার ১ মাত্রা আরেকবার ২ মাত্রা ধরা সিদ্ধ নয়। ক্রিয়া পদ, সমাসবদ্ধ পদ, নির্দেশক পদে এরূপ সুবিধা নেয়া যায়। যেমন-একটি=এক+টি, শব্দের প্রথমে বদ্ধাক্ষর ‘এক’ সাধারণ নিয়মে এক মাত্রা পায়। সে হিসেবে “একটি” ২ মাত্রা পাওয়ার কথা। কিন্তু ৩ মাত্রায়ও ব্যবহার করা যায়।
আসলে লেখার অক্ষর নয়, উচ্চারণের কানই ছন্দের প্রধান অঙ্গ।
৭। শব্দে মধ্যখণ্ডনের ব্যবহার নাই বললেই চলে।
৮। অক্ষরবৃত্ত এক সর্বগ্রাসী ছন্দ। যুক্ত বর্ণকে অনায়াসে গিলে নিতে পারে।
৯। লেখক অবারিত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।
১০। পর্ববিন্যাস ২. ৪, ৬, ৮, ১০, ১৪, ১৮, ২২, ২৬, ৩০/ মাত্রায় হতে পারে।
১১। পর্ব এবং মাত্রা মিলোনোর সহজ পদ্ধতি হলো জোড়ের পাশে জোড় এবং বেজোড়ের পাশে বেজোড় অক্ষরের শব্দ বসিয়ে লিখা।
১২। মাত্রা গোনার নিয়ম যত অক্ষর, তত মাত্রা। তবে উচ্চারণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। উচ্চারণ গুটিয়ে গেলে মাত্রা কমে যাবে। এলায়িত হলে মাত্রা বেড়ে যাবে।
১৩। স্বাধীন বদ্ধাক্ষর ২ মাত্রা লাভ করে। যেমন- পান খাই, চুন খাই। এখানে প্রতিটিই শব্দ- পান, চুন, খাই বদ্ধাক্ষর। ফলে এরা ২ মাত্রা লাভ করে।
১৪। কিছু জোড়া শব্দও ৩ মাত্রার স্থলে ৪ মাত্রা ধরা যায়। যেমন-আজকাল, রাখঢাক, রাতদিন ইত্যাদি।
১৫। ধ্বনির গতি ধীর।
১৬। দ্বিরুক্ত শব্দের প্রথম বদ্ধাক্ষরকেও ২ মাত্রা ধরা যায়। যেমন- কলকল, ছলছল, ফ্যালফ্যাল, ঢলঢল, কড়কড়, ইতাদি।
১৭। নামবাচক পদের ক্ষেত্রেও প্রথমে বদ্ধাক্ষর থাকলে ২ মাত্রা ধরা যায়। যেমন- মেঘনা, গোমতি, সাওতাল, হারমোনিয়াম ইতাদি।
কিছু উদাহরণ:-
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
জীবনানন্দের 'অদ্ভূত আঁধার এক'- কবিতাটির বিশ্লেষণ :-
অদ্ভুত আঁধার এক/৩-৩-২ এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/৪-৪-২
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি/২-২-৪-২
আজ চোখে দ্যাখে তারা;/২-২-২-২
যাদের হৃদয়ে কোনো/৩-৩-২ প্রেম নেই – প্রীতি নেই –/২-২-২-২ করুণার আলোড়ন নেই/৪-৪-২
পৃথিবী অচল আজ/৩-৩-২
তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/৩-৫-২
যাদের গভীর আস্থা/৩-৩-২ আছে আজো মানুষের প্রতি/২-২-৪-২
এখনো যাদের কাছে/৩-৩-২
স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়/৪-২-২-২
মহত্ সত্য বা রীতি,/৩-৩-২
কিংবা শিল্প অথবা সাধনা / ২-২-৩-৩
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য/৪-৪-২
আজ তাদের হৃদয়/ ২-৩-৩
তিনি এসেছেন ফিরে – শামসুর রাহমান
লতাগুল্ম, বাঁশঝাড়, বাবুই পাখির বাসা আর
মধুমতি নদীটির বুক থেকে বেদনাবিহ্বল
ধ্বনি উঠে মেঘমালা ছুঁয়ে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়।
এখন তো তিনি নেই, তবু সেই ধ্বনি আজ শুধু
তাঁরই কথা বলে;
মেঘনা নদীর মাঝি যখন নদীতে
ভাটিয়ালী সুর তোলে, তার
পালে লাগে দীর্ঘদেহী সেই পুরুষের দীর্ঘশ্বাস,
যখন কৃষক কাস্তে হাতে
ফসলের যৌবনের উদ্ভিন্ন উল্লাস দেখে মাতে,
তখন মহান সেই পুরুষের বিপুল আনন্দধ্বনি ঝরে
ফসলের মাঠে,
যখন কুমোর গড়ে মাটির কলস, ঘটিবাটি,
নানান পুতুল চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে,
তখন সৃজনশিল্পে তার
জেগে ওঠে মহান নেতার স্বপ্নগুলি,
উচ্ছসিত লাউডগা, কচুপাতা, কুয়োতলা, পোয়াতি
কুমোর বউ।
ওরা তাঁকে হত্যা ক’রে ভেবেছিল তিনি
সহজে হবেন লুপ্ত উর্ণাজাল আর ধোঁয়াশায়,
মাটি তাঁকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-
কিন্তু তিনি আজ সগৌরবে
এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দীপ্র উচ্চারণে,
সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে,
শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের
আন্দোলনে,
রৌদ্রঝলসিত পথে মহামিছিলের পুরোভাগে।
এটি একটি আধুনিক গদ্য কবিতা চমৎকার অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের যে সকল বৈশিষ্ট্যে উল্লেখ করা হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই এই কবিতায় পাওয়া যাবে।
বলছিলাম অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মধ্যখন্ডনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে আধুনিক বাংলা কবিতার দিকপাল কবি শামসুর রাহমান অপূর্ব দক্ষতার সাথে অল্পবিস্তর মধ্যখণ্ডনের ব্যবহার করেছেন। কবি আবিদ আনোয়ার এই বিষয়টি সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। এখানে তার লেখাটি হুবহু কোট করছি।
“অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মধ্যখণ্ডন সচরাচর চেখে না-পড়লেও তা হয় না এমনটি বলা যাবে না। কবি শামসুর রাহমান তাঁর অক্ষরবৃত্তীয় রচনায় গদ্যসুলভ ধ্বনিরণন সৃষ্টি করেছেন অনেক ক্ষেত্রে্ই মধ্যখণ্ডন ঘটিয়ে। ৮-মাত্রার পর্ব সাধারণত ৩+৩+২ মাত্রার সমন্বয়ে গঠিত হয় যেখানে অসচেতন পাঠকও ছন্দের দোলা অনুভব করতে পারেন, যেমন জীবনানন্দের “হাজার(৩)+বছর(৩)+ধরে(২)”। এধরনের অতিস্বাভাবিক পর্ববিন্যাস অন্যদের মতো শামসুর রাহমানও প্রচুর করেছেন বটে, তবে অনেক ক্ষেত্রে পরবর্তী পর্বের ২-মাত্রার একটি অংশকে টেনে এনেছেন ৮ কিংবা ১০-মাত্রা পূরণের জন্য, যেমন “ওষুধের শিশি, থার্মো-(৮)মিটার ইত্যাদি অপসৃত”, “পিতার প্রাচীন ফটো-(৮)গ্রাফের সান্নিধ্যে প্রজাপতি”। এধরনের সুক্ষ্ণ মধ্যখণ্ডন অজস্র ব্যবহারের ফলেও অনেক পাঠক তাঁর অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতাকে গদ্যকবিতা মনে করেন। কখনো কখনো ৪-মাত্রার পর্ব নির্মাণের জন্যও অভাবনীয় মধ্যখণ্ডনের আশ্রয় নিয়েছেন শামসুর রাহমান, যেমন “দেয়ালে সর্বদা জয়-(৮)/নুল আবে-(৪)/দিনের দুর্ভিক্ষ” ইত্যাদি। (-) চিহ্ন দিয়েে উপরোক্ত পঙক্তিগুলোতে ‘থার্মোমিটার ‘, ‘ফটোগ্রাফের’‘, ‘জয়নুল’, ‘আবেদিনের’ শব্দগুলোর মধ্যখণ্ডন দেখানো হলো। শামসুর রাহমান ছাড়া অন্যদের রচনায় এধরনের ব্যবহার খুব একটা চোখে পড়ে না।”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানেও অক্ষরবৃত্তে মধ্যখণ্ডন লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
“ তুমি কি কেবলই ছবি,/ শুধু পটে লিখা? ৮+৬
ওই-যে সুদূর নীহা/-রিকা ৮+২
যারা করে আছে ভিড়/ আকাশের নীড়, ৮+৬
ওই যারা দিনরাত্রি/৮
আলো হাতে চলিয়াছে/ আঁধারের যাত্রী/ গ্রহ তারা রবি, ৮+৬+৬
তুমি কি তাদের মতো/ সত্য নও।” ৮+৪
মাত্রা গণনার ব্যতিক্রম: কবিতায় মাত্রা গণনায় সংখ্যার চেয়ে ধ্বনির মূল্য বেশি। যেহেতু মাত্রা হচ্ছে অক্ষরের উচ্চারণ কালের সময়ের একক সেহেতু অক্ষরের সংখ্যার চেয়ে উচ্চারণ প্রাধান্য পায়। মূলত এ কারণেই স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যতিক্রম অনুচ্ছেদে আলোচিত ব্যতিক্রমের মতই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কোন ক্ষেত্রে ২ মাত্রার অক্ষর ৩ মাত্রার, ৩ মাত্রার অক্ষর ৪ মাত্রার মূল্য পায়। আবার ৩ মাত্রার অক্ষর ২ মাত্রার এবং ৫ মাত্রার অক্ষর ৪ মাত্রায় ব্যবহার লক্ষণীয়। বিশেষ করে সমাসবদ্ধ পদ, ক্রিয়া পদ, নির্দেশক পদ, ক্রিয়া বিশেষণ পদ, নাম পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমগুলো ব্যবহার প্রচুর। যেমন- উপরে শামসুর রাহমানের কবিতায় “মেঘনা নদীর” শব্দবন্ধে “মেঘনা’কে ৩ মাত্রা ধরে নদীর সাথে ৬ মাত্রার পর্ব সৃষ্টি করা হয়েছে। মেঘনা একটি নাম পদ। আবার “লাউডগা”কে ৪ মাত্রা ধরা হয়েছে। লাউডগা সমাসবদ্ধ পদ।
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
০৫-০১-২০২০
ছন্দের দ্বন্দ্বের হোক অবসান (পর্ব-৫)
কবিতায় ছন্দ চেনার সহজ পদ্ধতি:
১। ধ্বনির গতি দেখে। যেমন- “বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ ওঠেছে ওই” দ্রুত চালে চলছে বলে এটি স্বরবৃত্ত ছন্দ।
“শুধু বিঘে দুই ছিলো মোর ভূঁই, আর সবই গেছে ঋণে”-মধ্যম চালে চলে। তাই মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।
“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃতিবীতে আজ” ধীর চালে চলে। তাই অক্ষরবৃত্ত ছন্দ।
২। পর্ব বিভাজন দেখে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের পর্ব বিজোড় মাত্রা হয় না।
৩। শব্দ পক্ষেপণ দেখে। জোড়ের পাশে জোড়, বোজোড়ের পাশে বোজোড় শব্দ থাকলে কিংবা তিন বর্ণের দুটি শব্দ যদি পাশাপাশি বসে এবং একটির মধ্যে যুক্ত বর্ণ থাকে অন্যটিতে যদি না থাকে নিশ্চিত অক্ষরবৃত্ত ছন্দ।
৪। অক্ষর দেখে। যুক্তাক্ষর যেখানেই থাকুক ২ মাত্রা ধরে পর্ব বিন্যাস করা হলে বুঝতে হবে এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।
ছন্দ শেখার গুরুত্ব: যে কোনো জিনিস নির্মাণের কৌশল জানা থাকলে জিনিসটি নান্দনিক হয়। আবার এটি ভাংগার প্রয়োজন হলে ভাংগাও সহজ হয়। একাধিক কৌশল প্রয়োগ করে নতুন কিছু সৃষ্টির আনন্দও লাভ করা যায়। কবিতার ছন্দ হচ্ছে কবিতাকে নান্দনিক ও শ্রুতিমধুর করার কৌশল। এই কৌশল প্রয়োগে যিনি যত বেশি দক্ষ তিনি তত বেশি শৈল্পীক ও নান্দনিক কবিতা নির্মাণ করতে সক্ষম ও তত বড় এবং ভালো মানের কবি। একজন চিত্র শিল্পীকে যেমন জানতে হয় কোথায় কোন রং দিলে ছবিটি জীবন্ত হয়, তেমনি একজন শব্দ শিল্পীকেও জানতে হয় কোন শব্দের পরে কোন শব্দ বসালে কলকল নির্ঝরিনীর মতো শব্দের দোলা সৃষ্টি হয়। শব্দ তরঙ্গের এই দোলাই হচ্ছে ছন্দ। ছন্দের সাথে অলংকার প্রয়োগের কৌশল জানা থাকলে কবিতা হয় লাবণ্যময়, রসোত্তীর্ণ ও কালোত্তীর্ণ।
কবিতার অলংকার বিষয়ে অন্য কোন পর্বে আলোচনা করার আশা রাখছি। ছন্দ জানার গুরুত্ব সম্পর্কে কতিপয় বিশিষ্ট কবির মতামত তুলে ধরলাম।
বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য গবেষক সৃব্রত অগাস্টিন গমেজ উষ্মার সঙ্গে লিখেছেন, “আমাদের কবিদের ছন্দ শিখতে-শিখতে কবিতা লেখার বয়স পার হয়ে যায়…ভুল বললাম, বরং ছন্দ যে একটা শেখার মতো ব্যাপার, ছন্দ মানে যে লাইনের শেষে মিল নয় এটা বুঝবার আগেই ১০-১৫টি বই বের করে প্রতিষ্ঠিত কবি হয়ে যান, আর তারপর এমনসব কথা বলেন যে, মনে হয় ছন্দ-ফন্দ সব পুরানা বস্তাপচা বিষয়, এবং আজকের আধুনিক-উত্তরাধুনিক কবিতার জন্য একটা নিষ্প্রয়োজনীয় জিনিস” (কবিসভা ২০০৪)।
কবি আল মাহমুদ তাঁর একাধিক লেখা ও সাক্ষাৎকারে কবিতায় ছন্দের গুরুত্ব নিয়ে এবং নবীনদের কবিতায় গদ্যরীতির প্রাবল্য দেখে আরও স্পষ্ট ও তীব্র ভাষায় জানিয়েছেন—”যে-কবি ছন্দ জানে না, সে (কবিতার) কিছুই জানে না…”
(ইনকিলাব সাহিত্য, ৩ অক্টোবর ১৯৯৭)
আধুনিক কবিতায় ছন্দের গুরুত্ব সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ লিখে গেছেন, “আগামী কালের কবি তাঁর বিষয় স্থির করবেন যত্নে, হঠাৎ-জাগা প্রেরণার প্রাবল্যে নয়…আমাদের কবিদের হাতুড়ি ঠুকতে হবে বাক্যসৃষ্টিকৌশলের ওপর….স্তবকবিন্যাসের দিকে চোখ ফেরাতে হবে…..বাঙলা কবিতায় ছন্দ (যেন) একটি অক্ষরবৃত্ত; অপর দু’টি স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত শোভা: তবু ওই শোভা দু’টির কাছে যেতে হবে ঘনঘন; অক্ষরবৃত্তের ওপর চাপ বর্তমানে মারাত্মক হয়ে উঠেছে..অন্ত্যমিল সাম্প্রতিক কবিতার সর্বাধিক অবহেলিত ও অব্যবহৃত সোনা। তিরিশের কবিতায় অন্ত্যমিলের ব্যবহার হয়েছে প্রচুর, কিন্তু তারপরে এলো দুর্দিন, ফুরিয়ে গেলো দোলা…অন্ত্যমিলকে অনাধুনিক ভেবে ভয় পেয়েছিলেন অনেকে, তাই একে অবহেলা করেছেন অনেকে…অন্ত্যমিলকে পুনর্বাসিত করতে হবে…কবিতার ভাষাকে মুক্তি দিতে হবে অতি-মৌখিক বাচালতা থেকে”
(আধার ও আধেয়, পৃ. ৩৬-৩৯)।
হাজার বছরের বাঙলা কবিতার মৌলিক নির্মাণশৈলীর পথ ধরেই আমাদের এগোতে হবে সামনের দিকে—কেবল নতুন ভাষাভঙ্গির সন্ধানে ও কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য কিন্তু ছন্দকে অস্বীকার করে নয়। (আবিদ আনোয়ার- ছন্দের সহজ পাঠ।
তপন বাগচীর ভাষায়-“রবীন্দ্র-নজরুল-সত্যেন দত্তের পর বাঙলা কবিতা থেকে ছন্দ বিদায় নিয়েছে বলে অনেকে বিভ্রান্তি ছড়ান। আর এই বিভ্রান্তকে সম্বল করে ছন্দ বিষয়ে অনভিজ্ঞ কবিরা যে যেমন ইচ্ছা বাক্যের পর বাক্য লিখে এগুলোকে আধুনিক কবিতা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।
যেকোনো যুগের কবিতায় ছন্দ ছিল কবিতার প্রাণ এবং তা-ই থাকবে অনাগত কাল। পরিবর্তন ঘটবে কেবল প্রয়োগ-কৌশলে, যেমন ঘটিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমান, শক্তি-সুনীল-আল মাহমুদ তাঁদের নিজ নিজ উপায়ে।” (মুক্তমনা ও কবিসভা ২০০৬)।
পরিশেষে বলতে চাই, ছড়া, পদ্য, গদ্য কবিতা যা-ই বলিনা কেন, আশা করি ছন্দ মেনে লিখতে এখন আর কোনো অসুবিধা হবে না। কবিতা লেখায় যাদের হাত পেকে গেছে। নতুন ছন্দ সৃষ্টি করতে পারেন বলে দাবী করেন তারা পরামর্শ দিয়ে এই লেখাটিকে সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করবেন তাদের জন্য- যারা নতুন কবি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন অথচ ছন্দ জানেন না বলে লিখতে গিয়ে কুণ্ঠিত হন। ছন্দ ছাড়াও আধুনিক কবিতা লিখা হয়, হচ্ছে। তবে প্রতিষ্ঠিত ছন্দকে ভাংতে হলে গড়ার নিয়ম জেনে ভাংতে হবে।
রাস্তায় পুলিশের সামনে অপরাধ সংঘটিত হয়। পুলিশ গুলি করতে পারে না। এর কারণ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ নেই । অথবা বন্দুকে গুলি নেই। তারপরও পুলিশ বন্দুক নিয়ে হাঁটে। পুলিশের আত্মবিশ্বাস আছে যে, গুলি না ছুঁড়তে পারলেও প্রয়োজনের সময় বাট দিয়ে অন্তত একটি বাড়ি দিতে পারবে আর অপরাধি জানবে এই লোক পুলিশ এবং তার কাছে বন্দুক আছে বলে কিছুটা হলেও ভয় পাবে। আপনি কবি। মানুন আর না মানুন আপনার কবি সত্তার পরিচয় দিতে এবং আত্মবিশ্বাসের জন্য হলেও ছন্দ জানা থাকা আবশ্যক।
সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ।
০১-০৬-২০২০
কৃতজ্ঞতা: কবি আবিদ আনোয়ার, গ্রন্থ: ছন্দের সহজ পাঠ, বরেণ্য কবিদের নির্মাণকলা;
কবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, গ্রন্থ: বাংলা গান রচনাকৌশল ও শুদ্ধতা
এবং
অন্তর্জাল।
মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান
গবেষণা ও মূল্যায়ন সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি
ও
সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিভাগীয় কমিটি
অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠন।
মোবাইল: ০১৮১৮৩১৮৩১১