আর নয় দ্বিধা ভয় দ্বন্দ্ব
শিখে ফেলুন কবিতার ছন্দ।
ছন্দ শেখার দ্বন্দ্ব যাদের মনে
এই লেখাটা পড়বেন
শুধু সেই জনে।
মন্দ কথার গন্ধ না ছড়ায়ে
ছন্দে পটু পণ্ডিতজনে
সযতনে যাবেন এড়ায়ে।
তাল লয় ছন্দ ও পর্ব:
যারা কবিতা লিখেন অথচ ছন্দকে ভয় পান অথবা আয়ত্ত্ব করতে পারেন না তাদের কথা মাথায় রেখে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের পরিসরে ছন্দ বিষয়ক আলোচনায় ব্রতী হলাম। প্রথমেই বলে রাখি কবিতায় অন্তমিলের নাম ছন্দ নয়, মাত্রার মিলেই ছন্দ হয়। ছন্দে থাকে তাল ও লয়। বিষয়টি সহজে বুঝার জন্য প্রিয় পাঠকগণকে নদীর দিকে দৃষ্টি ফিরাতে বলবো। দেখুন স্রষ্টার সৃষ্টি কেমন ছন্দ-তালে চলে। যখন বাতাস বয় তখন নদীর পানি কেমন নির্দিষ্ট বিরতিতে ওঠা-নামা করে ঢেউ আকারে বাতাসের দিকে ধাবিত হয়। এই নির্দিষ্ট বিরতিতে সমান মাপে ঢেউয়ের ওঠা-নামাকে বলা হয় তাল এবং লয়।
যখন জোরে বাতাস বয় তখন ঢেউগুলো দ্রুত ছুটে। আর যখন আস্তে বাতাস বয় ঢেউগুলো ধীরে ছুটে। ঢেউয়ের ছুটে চলা নিয়ন্ত্রিত হয় বাতাসের চাপে। মানুষ বাকযন্ত্রের দ্বারা যে ধ্বনি সৃষ্টি করে তাও কিন্তু নিঃশ্বাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর ফলে স্বর ওঠা-নামা করে বাকযন্ত্রে ফুসফুস থেকে আসা বাতাসের চাপে। মানুষের সৃষ্ট ধ্বনি কখনও আস্তে হয়, কখনও জোরে হয়। কখনও ধীর হয়, কখনও দ্রুত হয়। এই ধ্বনিকে বলা হয় কণ্ঠস্বর। মানুষের কণ্ঠস্বরের নির্দিষ্ট মাপে ঢেউয়ের মতো এই ওঠা-নামাকেই বলা হয় তাল এবং লয়। এই নির্দিষ্ট মাপ হচ্ছে সময়ের মাপ। আর লয় হচ্ছে স্বরের ওঠা-নামা। তাল এবং লয় একটি আরেকটির সাথে সম্পৃক্ত।
লয় ৩ প্রকার।
১। দ্রুত লয়: কণ্ঠনিসৃত ধ্বনি যখন দ্রুত গতিতে ওঠা-নামা করে তখন তাকে বলা হয় দ্রুত লয়।
২। মধ্যম লয়: কণ্ঠনিসৃত ধ্বনি যখন দ্রুত গতিতে ওঠা-নামা না করে কিছুটা ধীর গতিতে ওঠা-নামা করে তখন তাকে বলা হয় মধ্যম লয়।
৩। ধীর লয়: কণ্ঠনিসৃত ধ্বনি যখন ধীর গতিতে ওঠা-নামা করে তখন তাকে বলা হয় ধীর লয়।
লয় নিয়ন্ত্রণ হয় ছন্দ দ্বারা। তাহলে বলতে পারি ধ্বনির গতি নিয়ন্ত্রণের যতি বা বিরতিই হলো ছন্দ।
যেমন:- বন্যায় দেশ ডুবে দেশের অশেষ ক্ষতি হলো। এই বাক্যটি পড়ার সময়-“ বন্যায় দেশ ডুবে” পর্যন্ত পড়ে সামান্য বিরতি দিয়ে পরের অংশ-“দেশের অশেষ ক্ষতি হলো” পড়া হলে শোনতে ভালো লাগে। বোধগম্য এবং শ্রুতিমধুর পাঠের জন্য একটি বাক্যের যতটুকু একবারে উচ্চারণ করা হলো তাকে বলা হয় পর্ব। এই বাক্যটিই যদি সরল বাক্যে না লিখে কবিতার চরণে ভাগ করে লিখি তাহলে দাঁড়াবে:-
“বানের জলে/ডুবল দেশ
ক্ষয়-ক্ষতির যে/ নেইকো শেষ।”
এক্ষেত্রে-১ম চরণে “বানের জলে” উচ্চারণ করে সামান্য বিরতি দিতে হয়। তারপর “ডুবল দেশ” পড়তে হয়।
২য় চরণে-“ক্ষয়-ক্ষতির যে” উচ্চারণ করে সামান্য বিরতি দিতে হয়। তারপর “নেইকো শেষ।”পড়তে হয়। একটি চরণের যেখানে গিয়ে যতি পড়ে সে পর্যন্ত অংশকে বলা হয় পর্ব।
যতি দ্বারা ধ্বনির গতি নিয়ন্ত্রণের ফলে একটি মধুর ধ্বনি তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। যতি দ্বারা ধ্বনির গতি নিয়ন্ত্রণের ফলে মধুর ধ্বনি তরঙ্গের সৃষ্টি হওয়াকে বলা হয় ছন্দ।
বাংলা কবিতার ছন্দকে ছন্দ বিশারদগণ প্রধানত ৩ ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা:-
১। স্বরবৃত্ত ছন্দ;
২। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ;
৩। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ।
এই ৩ প্রকার ছন্দ নিয়ন্ত্রণ হয় পর্ব দ্বারা। পর্ব নিয়ন্ত্রণ হয় মাত্রা দ্বারা। আবার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ বা হিসাব করা হয় অক্ষর দ্বারা।
এ পর্যন্ত আমরা তাল লয় ছন্দ এবং পর্ব কী তা হয়তো বুঝে গেছি। ছন্দের প্রকার সম্পর্কেও জেনেছি। এবার জানা যাক মাত্রা এবং অক্ষর কী।
মাত্রা ও অক্ষর:
নিঃশ্বাসের এক চাপে একটি শব্দের যতটুকু উচ্চারিত হয় কবিতায় তাকে অক্ষর বলা হয়। যেমন:- “অক্ষর” শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলে “অক” পর্যন্ত এক চাপে উচ্চারণ করে একটু থেমে “খর” অংশটি উচ্চারণ করতে হয়। এভাবে “অক্ষর” শব্দটিকে সম্পূর্ণ উচ্চারণ করতে নিঃশ্বাসে দুইটি চাপ পড়ে। আবার “উচ্চারণ” শব্দটি উচ্চারণ করতে “উচ” এক চাপে বলার পর সামান্য থেমে “চা” তার পর সামান্য থেমে “রণ” উচ্চারণ করতে হয়। এভাবে “উচ্চারণ” শব্দটিকে সম্পূর্ণ উচ্চারণ করতে নিঃশ্বাসে তিনটি চাপ পড়ে। প্রতি চাপে শব্দের যতটুকু উচ্চারিত হলো তার প্রতিটিই একটি অক্ষর। উপরের উদাহরণ থেকে দেখা যায় অক্ষরে একটি বর্ণও থাকতে পারে আবার একাধিক বর্ণও থাকতে পারে। আরও লক্ষণীয় যে, কোনো অক্ষর উচ্চারণ করতে গিয়ে মুখে আটকে যায়- যেমন “অক”, “খর” “উচ”। আবার কোনো অক্ষর যতক্ষণ খুশি দম শেষ না হওয়া পর্যন্ত উচ্চারণ করা যায়, যেমন-“চা”। এরূপ উচ্চারণের তারতম্যের কারণে যে অক্ষর মুখে আটকে যায় তাকে বলা হয় বদ্ধাক্ষর। আর যে অক্ষর দম শেষ না হওয়া পর্যন্ত উচ্চারণ করা যায় তাকে বলা হয় মুক্তাক্ষর। এই অক্ষর উচ্চারণের সময়কালকে বলা হয় মাত্রা।
মাত্রা গণনা:
শব্দের মধ্যে অক্ষরের ওপর (বর্ণ নয়) ভিত্তি করে মাত্রা গণনা করতে হয়। ছন্দের প্রকারের ওপর অক্ষরের মাত্রা সংখ্যা নির্ভর করে। আমরা জেনেছি অক্ষর ২ প্রকার। বদ্ধাক্ষর ও মুক্তাক্ষর। স্বরবৃত্ত ছন্দে ২ প্রকার অক্ষরকেই ১ মাত্রা গণনা করা হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বদ্ধাক্ষর যেখানেই থাকুক ২ মাত্রা এবং মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা গণনা করা হয়। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের শুরুতে এবং মাঝে বদ্ধাক্ষর থাকলে ১ মাত্রা এবং শেষে থাকলে ২ মাত্রা গণনা করা হয়। অক্ষরবৃত্তে স্বাধীন বদ্ধাক্ষর সকল অবস্থানে ২ মাত্রা গণনা করা হয়। যেমন- আর নয় হতাশা। এখানে “আর” এবং “নয়” দুটি স্বাধীন বদ্ধাক্ষর। এ জন্য এমন বদ্ধাক্ষরকে অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা গণনা করা হয়।
এটি হলো মাত্রা গণনার সাধারণ নিয়ম। তবে ছন্দ ভেদে এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন প্রকার ছন্দ নিয়ে আলোচনা করার সময় ব্যতিক্রমগুলোও আলোচনা করব। তার আগে শব্দের অক্ষর বের করা শিখে নিই।
শব্দের অক্ষর বের করা:
আগেই বলেছি একটি শব্দের যতটুকু অংশ এক চাপে উচ্চারণ করা যায় তাই হলো অক্ষর। ইংরেজি sylable- এর মতো। যেমন-আমার সোনার বাংলা, এ বাক্যাংশটিতে শব্দ আছে ৩টি। আমার, সোনার এবং বাংলা। এই তিনটি শব্দের প্রতিটিতে উচ্চারণ অনুসারে দেখা যাক কয়টি অক্ষর পাওয়া যায়। অক্ষর বের করতে পারলে ছন্দ ভেদে মাত্রা সংখ্যাও বলতে পারব।
আমার শব্দটিকে উচ্চারণ করতে-আ এবং মার এ দুটি চাপে উচ্চারণ করতে হয়। এজন্য এখানে ২টি অক্ষর আছে। ১মটি মুক্তাক্ষর, ২য়টি বদ্ধাক্ষর (মুক্তাক্ষর এবং বদ্ধাক্ষর কী তা পূর্বেই আলোচনা করা হযেছে)। সোনার শব্দটি উচ্চারণ করতে তদ্রুপ সো এবং নার এ দুটি চাপে উচ্চারণ করতে হয়। আবার বাংলা শব্দটি উচ্চারণ করতেও বাং এবং লা এ দুটি চাপে উচ্চারণ করতে হয় বলে দুটি শব্দেই ২টি করে অক্ষর পাই। এভাবে “অকালপক্ক” শব্দটি উচ্চারণ করতে অ+কাল+পক+ক এ চারটি চাপে উচ্চারণ করতে হয় বলে এখানে ৪টি অক্ষর পাই; ১ম এবং শেষেরটি মুক্তাক্ষর, মাঝের ২টি বদ্ধাক্ষর।
প্রখ্যাত কবি আবিদ আনোয়ার থুতনি ধরে অক্ষর গণনার সহজ পদ্ধতির কথা বলেছেন। আপনি চিন্তারত স্টাইলে থুতনির নিচে হাত রেখে উচ্চারণ করুন “অক্ষর”। যতবার থুতনির চাপ হাতে লাগবে ততটি অক্ষর পাবেন। এ ক্ষেত্রে ২ বার চাপ পড়বে। তাই “অক্ষর” শব্দে ২টি অক্ষর পাবেন। “মাদ্রাসা” শব্দটি উচ্চারণ করুন। ৩ বার চাপ লাগবে, তাই এটিতে ৩টি অক্ষর। এভাবে আপনি সহজেই শব্দের অক্ষর বের করে ছন্দ অনুসারে মাত্রা্ গণনা করতে পারবেন।
উল্লেখ্য যে, কিছু অক্ষর একাধিক বর্ণ মিলে হলেও কিন্তু বদ্ধাক্ষর নয়। যেমন-স্ত্রী=স+ত+র বর্ণ মিলে যুক্তাক্ষর কিন্তু বদ্ধাক্ষর নয়। এরূপ কিছু ইংরেজি শব্দ যেমন-স্টার, প্লে, ক্লিক ইত্যাদি।
তাহলে আসুন আমরা শব্দের অক্ষর বের করা শিখি। তার পরে বিভিন্ন প্রকার ছন্দের বৈশিষ্ট্য ও মাত্রা গণনা শিখব। আজ এ পর্যন্তই। ধন্যবাদ সবাইকে।
১৪-১-২০১৯
কৃতজ্ঞতা: কবি আবিদ আনোয়ার, গ্রন্থ: ছন্দের সহজ পাঠ ও
কবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, গ্রন্থ: বাংলা গান রচনাকৌশল ও শুদ্ধতা।