অনেক বছর হয় গেলো এই আসরের সাথে আছি । কত কবির কবিতা পড়লাম । নাহ , আমি কবি নই , মনে মনে ভাবছেন তো তাহলে এখানে কি করছি ? আমি আসি এখানে অনেক প্রবীণ , নবীন কবির কবিতা পড়তে , আবৃত্তি শুনতে আর আলোচনা সভায় তাঁদের মূল্যবান কিছু লেখা পড়তে । আমার ভালো লাগে এখানে ঘুরে বেড়াতে , আর এতো কবির সঙ্গ গুণে দু চার লাইন লিখে ফেলেই ভাবি মনে মনে , যাহ্ ! বড্ড ভুল হয়ে গেলো । তাই আবার চুপ করে থাকি , নিজের মনে পড়ি , শুনি । আবার ভাবি ভাগ্যিস আমার মতন দু চারজন এই রকম এলেবেলে মানুষ এতো গুণীজনের আড়ালে আছি বলেই তো আসর নিয়মে চলছে , সবাই লিখলে আর কে পড়বে ? সবাই আবৃত্তি করলে আর কে শুনবে ? সেই কাজটার জন্যই না হয় এক কোণে থাকি......
আজ যে জন্য এলাম তা না বলে কেমন উল্টো পাল্টা কথায় চলে গেলাম ... বয়সের দোষ , থামতে জানি না । যাক গে , আজ এক কবির একটি কবিতা আপনাদের জন্য উপহার দিই । আপনারা পড়ুন , দেখুন তো এই লেখাটিকে কি বলবেন ? কবিতা না কি গদ্য কবিতা না কি অণু গল্প না কি গদ্যকে কবিতা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ?
তবে আমার কিন্তু খুব প্রিয় এই কবি এবং তাঁর কবিতা...
------------------------------------------------------
ছুটি
-শুভ দাস গুপ্ত
কিছু একটা করেন স্যার আজ চারদিন হয়ে
গেল আমার ছোট্ট মেয়েটা ঐ নোংরা
বারান্দায় পড়ে আছে ।
জুতার দোকানের সামান্য মাইনের কর্মাচারী নিকুঞ্জ ।
তার আদরের মেয়ে মা মনির কঠিন অসুখ ।
ডায়ালিসিস করতে হবে । পাড়ার এম এল এ
দয়ালু হাতে চিঠি দিয়েছেন মন্ত্রীর সি এ কে ।
তিনি চিরকুট পাঠিয়েছেন আরেক আমলাকে ।
আমলা নোট পাঠিয়েছেন হাসপাতালের সুপারকে।
কিন্তু গত কদিনে নিকুঞ্জের সমস্ত উদ্বেগ আর উৎকন্ঠাকে তুচ্ছ করে
সে নোট পৌছায়নি হাসপাতালে। নোট গেলে বিনা খরচে
মা মনির ডায়ালিসিস করা হবে ।
গরিব নিকুঞ্জ সারাদিন দোকানে
মানুষের পায়ে জুতা পড়ায় ।
অন্য মনস্ক কাজে ভুল হয়ে যায় বারবার
মালিক ধমক লাগায় , এক একটা নধর পায়ে জুতা পরাতে পরাতে
নিকুঞ্জের ইচ্ছা হয় ,পয়সাওয়ালা খদ্দেরের পা দুটো চেপে ধরে বলেঃ
-স্যার,আমার একমাত্র মেয়ে পয়সার অভাবে
হাসপাতালের নোংরা বারান্দায় একা পড়ে রয়েছে ।
তার চিকিৎসা হচ্ছে না । দিন না স্যার কয়েক হাজার টাকা ।
আমি সারা জীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকবো।
দুটোর সময় ছুটি নিয়ে কলকাতার ডাকসাইটে জ্যাম ডিঙ্গিয়ে
অসংখ্য মানুষের ভীড় এড়িয়ে নিকুঞ্জ
রাইটার্সের পৌঁছায় হাঁফাতে হাফাঁতে ।
কেরানী বাবুর টেবিলের সামনে দাঁড়ায় চোরের মত
বাবুর্টি বললেন
-আজ আর হবে না দাদা,
- কেন ?
-জানেন না ? নাগাল্যন্ডের পশুমন্ত্রীর মৃত্যুতে
আজ আমাদের হাফ ছুটি ঘোষনা করা হয়েছে ।
-ও তাহলে কাল ?
-কালও হবে না । কাগজ পড়েন না নাকি ?
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে কাল পুর্ন দিবস ছুটি ।
- তাহলে পরশু ? নিকুঞ্জ ব্যস্ত হয়ে উঠে ।
- পরশু শনিবার, তারপর রবিবার ,আপনি একবারে সোমবার আসুন ।
সোমবার মানে আরও চারটি দিন বাকি ?
তলিয়ে যেতে থাকে নিকুঞ্জ ।
যেতে যেতে তার কানে বারবার ভেসে আছে মা মনির কন্ঠস্বরঃ
বাবা আমার কবে ছুটি হবে ?
আমি কবে বাড়ি যাবো বাবা ?
হঠাৎ নিকুঞ্জর মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠে,
দুর্বল অভুক্ত শীর্ন শরীরে হঠাৎই যেন জ্বলে উঠে ভয়ংকর তেজ ।
রাইটার্সের বারান্দা দিয়ে ছুটতে থাকে নিকুঞ্জ ।
আর ছুটতে ছুটতে সোজা গিয়ে নিকুঞ্জ ডুকে
ডালহাউসী পাড়ার প্রাচীন এক বন্দুকের দোকানে ।
আগুন জ্বলছে তখন নিকুঞ্জুর মাথায় । ধুমকেতুর মত
নিকুঞ্জ চিৎকার করে বলতে থাকে
-আমাকে একটা বন্দুক দিন,আমাকে একটা বন্দুক দিন ,
যা থেকে হাজার হাজার গুলি বের হবে ।
আমি সমস্ত নেতা,প্রাক্তন মন্ত্রী, কর্তাদের গুলি করে মেরে ফেলব
তারপর, সারাদেশে একদিনই রাষ্ট্রীয় শোক,একদিনই ছুটি ।
আর তারপর আমার মা-মনির ডায়ালিসিস।
দোকানের দারোয়ান ঘাড় ধরে নিকুঞ্জকে বের করে দেয়।
নিকুঞ্জ ছুটতে ছুটতে হাফাঁতে হাফাঁতে হাসপাতাল ।
হঠাৎ ঝপ করে লোডশেডিং এর মত নিকুঞ্জ’র চোখের সামনে
সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায় ।মা-মনির বিছানাটা খালি ।
মা- মনি কোথায় ? কোথায় আমার মা-মনি ?
অনেক রাতে….
ভাড়া করা ম্যাটাডোরে একটা খাটিয়ায় মা-মনি কে শুইয়ে
দূর মফস্বলের বাড়ীর পথ ধরে নিকুঞ্জ ।
সারাটা রাস্তা পুর্নিমার চাঁদ আলো ধরলো মা-মনির মুখে ।
এক আকাশ নক্ষত্র আর তারা আলো বিছিয়ে রাখলো
মা-মনির ঘরে ফেরার পথে ।
আর নিকুঞ্জ শুনতে পেল নক্ষত্র চাঁদ তারা সবাই বলছে
আমাদের ছুটি নেই নিকুঞ্জ,আমরা আলো জ্বেলে রেখেছি
তোমার মা-মনির জন্য আমরা আলো জ্বেলে রেখেছি ।
ভোরের আলো তখন সবে ফুটছে ।
ম্যাটাডোর ভ্যান এসে থামলো নিকুঞ্জ’র
ভাঙ্গা বাড়ীর দরজায় । নিকুঞ্জ’র বউ পাগলের মত ছুটে এল
-এনেছো ? আমার মেয়েকে এনেছো ?
পাথর হয়ে যাওয়া নিকুঞ্জ তুমুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে
আর বার বার বলতে লাগল
-”তোমার মা-মনির ছুটি হয়ে গেছে “
“তোমার মা-মনির ছুটি হয়ে গেছে