অবসর জীবন। কাটেনা সময়। তাই মাঝে মাঝে কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার লেখা কবিতা যে কবিতা হয়না সেটা আমিও বুঝি। তারপরও লিখে যাই অবলীলায়, অসময়ে। মানুষকে কষ্ট দেই, কবিতা পড়াতে বাধ্য করি। লেখালেখির এই ব্যর্থ চেষ্টা করতে যেয়ে আমার মনে কয়েকটি প্রশ্নের উদ্ভব ঘটেছে। যার উত্তর খোঁজার জন্যই আজ এই লেখার অবতারণা।
আমি প্রবীণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা পড়ে বড় হয়েছি। তাই এখনও তাদের কবিতাগুলোই আমার মনের মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে বারবার। আমার প্রশ্নগুলো নিম্নরূপ:
১) কবিতায় বক্তব্য:
কবিতার পিছনে একটি ঘটনা বা একটি বক্তব্য থাকবে। কবিতা পড়ে পাঠক একটা মেসেজ পাবেন কবির কাছ থেকে। এটা যে শুধু কবিতায় তা নয়। সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রেই একটা মেসেজ থাকা উচিৎ বলে আমার মনে হয়।
আধুনিক কোন কোন কবি বলছেন কবিতায় কোন মেসেজ বা বক্তব্য প্রধান নয়। কবিতাটা কতটা সুপাঠ্য হল সেটাই মুখ্য বিষয়। বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। যেমন নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের প্রতিটা কবিতায় সুস্পষ্ট একটা বক্তব্য প্রদান করেছেন। উদাহরণ হিসাবে রবি ঠাকুরের "যেতে নাহি দেবো", "সোনার তরী" অথবা নজরুলের "মানুষ", "বাতায়ন পাশে গুবাক তরুণ সারি" ইত্যাদ হাজারও কবিতার উল্লেখ করা যেতে পারে।
২) কবিতার সহজ অর্থ:
কবিতা পাঠকদের কাছে সব সময় সহজবদ্ধ হবে। যাতে সাধারণ পাঠক এর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেন।
এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার। যে ভাষা সাধারণের নাগালের বাইরে থাকে, অথবা যে ভাষায় মানুষ কথা বলে না; তা কালোত্তীর্ণ ভাষা হতে পারে না। যেমন সংস্কৃতি ভাষাটা যেহেতু সাধারনের জন্য ছিল না। তাই এ ভাষা বর্তমানে হারিয়ে গেছে। একইভাবে সাধু ভাষা যেহেতু আমাদের কথ্য ভাষা নয় তাই সাধু ভাষাও হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন আর কেউ সাধু ভাষায় কোন কবিতা বা সাহিত্য রচনা করেন না।
কিছু কিছু কবি কবিতার মধ্যে বিশেষ কিছু শব্দ জুড়ে দিয়ে তাকে কবিতা হিসেবে দাঁড় করে থাকেন। কিন্তু এগুলোর অর্থ খুঁজতে গেলে, যা দাঁড়ায় তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। হ্যাঁ আমি হয়তো বুঝি না, এটা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু যে পাঠকদের জন্য আমরা কবিতা লিখছি সে পাঠকরা এর অর্থ বোঝেন কি? দু একজন বলেন এ সমস্ত কবিতা অনেক উচ্চমার্গের কবিতা, যা সাধারনের বোঝার বিষয় নয়। এটা হলে অবশ্য আমার বলার কিছু নেই। কারণ এই কবিতা হয়তো আমাদের জন্য লেখা না। বিশেষ কোনো পাঠক শ্রেণীর জন্য দেখা লেখা
৩) কবিতায় ছন্দ:
কবিতায় ছন্দ অপরিহার্য। গদ্য কবিতাও প্রকৃত অর্থে গদ্য নয়। প্রতিটা কবিতায় একটা ছন্দ থাকবে যেটা গদ্য থেকে কবিতাকে পৃথক করে। প্রতিটা কবিতায় অন্তমিল থাকতেই হবে এমন না। তবে আমার মনে হয় কবিতায় ছন্দ অপরিহার্য। মাইকেল মধুসূদন তাঁর কবিতাগুলো লেখেছেন অমিত্রাক্ষর ছন্দে। এখানে অন্তমিল না থাকলেও কবিতায় ছন্দের কোন কমতি নেই। যেমন ধরার যাক মেঘনাথবধ কাব্য।
" এতক্ষণে”- অরিন্দম কহিলা বিষাদে-
“জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল
রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তােমার জননী,
সহােদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলিশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী!
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?"
এখানে অন্তমিল নেই ঠিকই। কিন্তু ছন্দের কোথাও কোনো কমতি নেই
৪) কবিতায় শব্দের ব্যবহার:
কবি নজরুল ইসলাম তার কবিতায় অনেক উর্দু, ফার্সি এবং বিদেশি শব্দ ব্যবহার করে গেছেন। বর্তমান কালের আধুনিক কবিতায়ও কবিরা নানা ধরনের বিদেশি শব্দ অবলীলায় ব্যবহার করছেন। এতে কবিতার মান ক্ষুন্ন হচ্ছে তা নয় বরং কোন ক্ষেত্রে কবিতার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিন্তু কোন কোন কবি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অনেক শব্দের ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করছেন। যেমন মোর, মম, তব, মোদের, হেথা, হোথা, সেথা, তথা, যেথা, ইত্যাদি।
এগুলো কেন ব্যবহার করা হবে না তার কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। বরং আমি মনে করি কবিতার প্রয়োজনে অশ্লীল না হলে সকল শব্দই ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে কারো কাছে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকলে আমাকে জানাবেন। আমি সত্যিই কৃতার্থ হব।
৫) কবিতায় সাধু চলিত মিশ্রণ:
ছন্দের প্রয়োজনে কবিতায় সাধারণত সাধু চলিত মিশ্রণ করা হয়ে থাকে। রবীন্দ্র নজরুলসহ সব বড় বড় কবিগণ তাদের কবিতায় সাধু ও চলতির মিশ্রণ করে গেছেন। সাম্প্রতিককালে কেউ কেউ বলছেন গদ্যের মতো কবিতাও সাধু চলতির মিশ্রণ দোষনীয়।
বিষয়গুলো যেহেতু আমার কাছে পরিষ্কার নয়। তাই আমি অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত। বিষয়গুলো নিয়ে আমি আমার বিদগ্ধ কবি বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কেউ যদি এ বিষয়ে আমাকে যথাযথ তথ্য উপাত্ত প্রদান করে সাহায্য করেন; তবে আমি তার/তাদের নিকট অতিশয় কৃতজ্ঞ থাকব। সবাই ভাল থাকবেন। সবার মঙ্গল কামনা করে আমার বক্তব্য শেষ করলাম।
তারিখ: ১২-০২-২০২৩ ইং;