কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতাটি আমার প্রিয় কবিতাগুলোর অন্যতম। এ কবিতাটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বহু আলোচক সমালোচক তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই কবিতাটির বিশ্লেষণ করেছেন।  

বহু বিদগ্ধজন, বহু কবিতাপ্রেমী বনলতা সেনকে নানাভাবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছেন।  কেউ বলেছেন বনলতা কবির স্ত্রী, কেউ বলেছেন তার প্রিয়সি, কেউবা বলেছেন তার মানষ প্রতিমা। কিন্তু আমাদের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন মাননীয় উপদেষ্টা জনাব ড. আকবর আলি খান বনলতা সেনকে একজন বেশ্যা হিসাবে চিত্রায়িত  করেছেন। টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে তাঁর এ আলোচনা শুনে আমার কৌতূহল বেড়ে যায়। আমি কৌতুহলী হয়ে বনলতাকে খোঁজার চেষ্টা করি। আমার বিশ্বাস আমার এই খোঁজা সার্থক  হয়েছে। আমি বনলতা সেনকে পেয়ে গেছি। প্রশ্ন হচ্ছে: কে এই বনলতা সেন? কোথায় থাকেন/ছিলেন/ আছেন তিনি?  কবির সাথে তাঁর কি সম্পর্ক? আমি জানি এসমস্ত নানা প্রশ্ন আপনাদের মাথায় উঁকি ঝুঁকি করছে। আমি চেষ্টা করব এগুলোর সৎ উত্তর দেয়ার জন্য।

আমরা সবাই জানি কবিতাটির তিনটি স্তবক। প্রথম স্তবকে দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য, ভবঘুরে, যাযাবর কবির সাথে বনলতা সেনের পরিচয় ঘটে। দ্বিতীয় স্তবকে কবি বনলতা সেনকে আবিস্কার করেন; অর্থাৎ তার রূপ বর্ণনা করেন। আর তৃতীয় অর্থাৎ শেষ স্তবকে কবির সাথে বনলতা সেনের চির মিলন ঘটে।

প্রথম স্তবকে বলা হয়েছে:

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে;
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

এখানে কবি বলেছেন, হাজার  বছর ধরে 'আমি' পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে। একজন 'আমি' কবি বা মানুষের পক্ষে হাজার বছর পথচলা সম্ভব নয়। কারণ অত দিন মানুষ  বাঁচেন না। তাহলে কি দাঁড়াল?  কবি এখানে একজন ব্যক্তি নন; তিনি এখানে পুরুষদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। যে পুরুষের সঙ্গী সাথী নেই; হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবী নানা পথে, নানা গলিতে অন্ধকারে হাঁটছেন।

কবি সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে ঘুরেছেন। সিংহল শ্রীলংকার প্রাচীন নাম। কিন্তু মালয় সাগর বলে প্রকৃতপক্ষে কোন সাগরের অস্তিত্ব পৃথিবীর ম্যাপে নাই।  তবে কবি এটা দিয়ে সারা দুনিয়াকে বোঝাতে চেয়েছেন।  

আবার কবে/কতদিন/কতকাল ঘুরছেন? সেটা বোঝানোর জন্য তিনি বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতের উপমা এনেছেন। বিম্বিসার ও অশোক দুজনে ভারতের রাজা ছিলেন এবং দুজনেই বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধে অশোক তার ৯৯ জন ভাইকে হারানোর ফলে তার মধ্যে এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়; এক হাহাকার দেখা দেয়; তিনি আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন। অবস্থাটাকে কবি ধূসর জগত হিসাবে চিত্রায়িত করেছেন। আবার এ আমলের চেয়েও আরো প্রাচীনকাল, অর্থাৎ পৌরাণিক কালের বিদর্ভ নগরীর উপমা নিয়ে এসেছেন কবি।  অর্থাৎ মানবজন্মের আদি থেকে আজ পর্যন্ত সকল সময়কেই কবি বুঝিয়েছেন।

কবি বারবার অন্ধকারের কথা বলেছেন। কেন?  মানুষের জীবন কল্পনা বিলাসী। প্রতিনিয়ত সে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে চলে। এ কল্পনার খূবে সামান্যই মানুষ প্রকাশ করতে পারে। মানুষের মনের এ অন্ধকার দিকটিই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। তা'ছাড়া একজন পুরুষ তার নারী সাথী না পাওয়া পর্যন্ত অন্ধকারে হাতরে ফিরতে থাকে, এটাই কবি এখানে তুলে ধরেছেন।

দ্বিতীয়তঃ অন্ধকারের আরেকটি অর্থ এখানে এসেছে নারীমনের গভীরতার পরিমাপ। কবিরা বারবার বলেছেন, নারীমনের তলা পাওয়া যায় না।  আরো বলেছেন, 'নারী তুমি অর্ধেক মানবী; অর্ধেক কল্পনা'। সাত জনমেও নারীর মনের খবর পাওয়া যায়না।  সবমিলিয়ে নারী মনটাকে কবি অন্ধকার হিসাবে চিত্রায়িত করেছেন।


আমরা জানি মানুষের পুরুষ সত্তা চঞ্চল, অস্থির ও যাযাবর প্রকৃতির। এই চঞ্চল পুরুষ সত্তা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজকে পর্যন্ত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, শ্রান্ত ও অবসন্ন হয়ে পরেন। সে প্রতিনিয়তই নানা স্বপ্ন দেখতে থাকে।  ধরা যাক রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে একটি সুন্দর মেয়েকে দেখে তার মনে এক ধরনের স্বপ্নের উদায় হল। আবার যখন মেয়েটি চলে যায়, তার স্বপ্নও সাগরের ঢেউয়ের বুদবুদের মত হারিয়ে যায়। সে ট্রেনে উঠে আর একজনকে দেখে নতুন স্বপ্ন বুনে। ট্রেন থেকে নামার সাথে সাথে একইভাবে  বুদবুদের মত তা' আবার হারিয়ে যায়। পুরুষ যে শুধু নারী নিয়ে এভাবে স্বপ্ন বোনে তা নয়; জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে নানা আশা/আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা পাওয়া/না-পাওয়া নিয়ে সে প্রতিনিয়তই স্বপ্নজাল বোনে। স্বপ্নজালগুলো আবার সময়ের আবর্তে সমুদ্র সফেনের (বুদবুদ) ন্যায় বিলিন হয়ে যায।

ড. আকবর আলী সাহেব দু'দণ্ড ও অন্ধকার শুনেই বলে দিলেন যে বনলতা সেন একজন বেশ্যা ছিলেন। আসলে এখানে বনলতা সেন কোন একক নারী ব্যক্তি নন; এখানে তিনি 'নারী সত্তার' প্রতিনিধিত্ব করেছেন। লক্ষ্য করুন, কবি এখানে বনলতার পরিবর্তে মাধবীলতা, স্বর্ণলতা, বা কলমিলতা নাম  দিতে পারতেন। কিন্তু তা না দিয়ে নাম দিয়েছেন বনলতা। ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা কোন লতাকে এখানে আনেননি। কারণ তিনি প্রাকৃতিকভাবে, অবহেলায়, অযত্নে বেড়ে ওঠা এক  নারীসত্তার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন বলেই 'বনলতা' নাম দিয়েছেন। অর্থাৎ বনলতা এখানে সহজ, সরল. প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা এক নারী সত্তার প্রতিনিধি। এ নারী শুধু প্রিয়সি নন; নন শুধু স্ত্রী; তিনি একাধারে মাতা, প্রিয়সি, স্ত্রী ও কন্যা; এবং সর্বশেষে তিনি প্রকৃতি; অর্থাৎ মৃত্তিকা।

এবার আমরা আসছি দু-দন্ডের ব্যাখ্যায়। একটি ছোট শিশু যে শুধু হামাগুড়ি দিতে পারে। তার পৃথিবী শোয়ার ঘর থেকে বসার ঘর। এখানে ঘুরে ঘুরে যখন সে ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে, সে তার মায়ের কাছে আসে দু'দণ্ড আশ্রয়ের জন্য। মা গভীর স্নেহে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আশ্রয়, খাদ্য ও নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন। একইভাবে একজন পুরুষ যখন চলার পথে ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে তখন তিনি ক্ষণিকের জন্য আশ্রয় খোঁজেন একজন নারীর কাছে। এ নারী হতে পারে তার মা, ভগিনী, প্রিয়সি বা স্ত্রী। কর্মক্লান্ত পুরুষ ক্ষণিক বিশ্রামের পর তো আবার বেড়িয়ে যায় কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্য। এ ভাবে প্রতিটা পুরুষ মানুষ কর্ম ক্লান্ত হয়ে দিনের শেষে ঘরে ফিরে আসে কোননা কোন নারীর কাছে আশ্রয়ের খোঁজে, খাদ্যের খোঁজে, শান্তির অন্বেষণে।

এবার আসা যাক দ্বিতীয় স্তবকে। এখানে বলা হয়েছে:

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের 'পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা;
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

পূর্বেই বলা হয়েছে, দ্বিতীয় স্তবকে কবি নারীর সত্তার বিবরণ দিয়েছেন। অর্থাৎ তাকে সুন্দর ভাবে চিত্রায়িত করেছেন। তিনি তাঁর রূপের বর্ণনায় কোন খাত রাখতে চাননি। তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব তিনি ঢেলে দিয়েছেন তাঁর বর্ণনায়। প্রথমেই চুলের বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা জানি আমাদের দেশে কালো চুলের প্রাধান্য। যদিও ইদানীংকালে মেয়েরা সোনালি চুলের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে কৃত্রিম রঙ মেখে। কিন্তু আমাদের কবি সাহিত্যিকরা যুগ যুগ ধরে কালোচুলের কদর করে আসছেন।

এই কালো চুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে এখানে কবি বলেছেন, চুল এমনি নিকষ কাল যে, তা' অন্ধকার রাত্রির সাথে তুলনীয় এবং এমন অন্ধকার যে রাতে কিছুই দেখা যায় না; যে অন্ধকারে মানুষ বিদিশা হয়ে যায়; মানে দিক হারিয়ে ফেলে।

মুখের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি পৌরাণিক শ্রাবস্তী শহরের কথা বলেছেন। শ্রাবস্তীতে যে ছবি আঁকা হতো সেখানে কোনো খুঁত; অর্থাৎ কোন দাগ বা কোন উঁচু নিচু চিহ্ন থাকত না। এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার একজন পুরুষ যখন কোনো নারীকে ভালোবাসে; তখন সে ওই নারীকে সর্বোচ্চ সুন্দর হিসেবে বিবেচনা করেই ভালোবাসে। যেমন ধরা যাক একটি শিশুর সামনে যদি এক ডজন উর্বশী. এক ডজন মোনালিসা, এক ডজন হেলেন বা এক ডজন ক্লিওপেট্রা এনে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়, তারপরও শিশু বেছে নেবে তার মাকেই। অর্থাৎ শিশুর কাছে এই মায়েই সর্বোচ্চ সুন্দর। একইভাবে একটা পুরুষ যখন কোন নারীকে ভালোবাসে তখন তার কাছে সেই পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরী। সেই সৌন্দর্য বাহ্যিক হতে পারে; মনের হতে পারে; সুন্দর চোখের হতে পারে; সুন্দর মুখের হতে পারে; সুন্দর চুলের হতে পারে। এটা বলা মুশকিল ঐ নারীর সৌন্দর্য  কোথায় লুকিয়ে আছে তার প্রেমিকের কাছে? প্রকৃত পক্ষে সৌন্দর্য প্রেমিকের মনের মাঝে লুকিয়ে থাকে।

নারীসঙ্গ ছাড়া একজন পুরুষ মানুষ পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত, দিকভ্রান্ত থাকেন। কবি পুরুষ সত্তার এ অবস্থাকে গভীর সমুদ্রে হাল ভেঙ্গে দিশা হারানো একজন নাবিকের সাথে তুলনা করেছেন। দিশা হারানো নাবিক যখন সবুজ ঘাসের দ্বীপ দেখে, তখন তারমধ্যে যে আনন্দ উৎসারিত হয়;  তেমনই আনন্দ উৎসারিত হয় যখন একজন পুরুষ পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত, দিকভ্রান্ত  অবস্থায় তার প্রিয়সীর দেখা পায়। পুরুষটি যখন তাঁর কাঙ্খিত নারীর দেখা পায়; তখনও সে সহসা তাঁর মনের খবর পায় না। তাই এখানে বলা হয়েছে অন্ধকারে তাঁরে দেখছি।

এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, কবি জীবনানন্দ দাশ বারবার চাকরি ছেড়ে অসহায় ও অন্ধকার অবস্থার মধ্যে পড়ে দিকভ্রান্ত হয়েছেন। কবি এ অবস্থায় যখন তাঁর  স্ত্রীর কাছে এসেছেন, তখনকার অবস্থার বর্ণনাও এটা হতে পারে।

সর্বশেষে 'পাখির বাসার মত চোখ' শব্দটি দিয়ে কবি বুঝিয়েছেন একটি নিরাপদ ও শান্তির আশ্রয়। একটা পাখি যেমন সারাদিন খাদ্যের সন্ধানে বন বনানী, গাছগাছালী, ফসলের মাঠ, বিল ঝিল ও আকাশে বিচরণ করে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে নিরাপদ আশ্রায়ের জন্য নীড়ে ফিরে আসে;  তেমনি ক্লান্ত পুরুষটিও সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ফিরে এসে নারীর কাছে একটি নিরাপদ আশ্রায়ের খোঁজে।

এখানে বনলতা বলেছেন, 'এতদিন কোথায় ছিলেন'? এটা প্রতিটি নারী হৃদয়ের আকুতি। যখন একটা ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়; তখন মেয়েটির মনে যে ভাবের উদায় হয়, তা' হল 'এতদিন কোথায় ছিলে'? অর্থাৎ কেন আরো আগে এলে না? এটা দিয়ে কোন ভাবেই দ্বিতীয়বার যোগাযোগ বুঝায় না।


এবার আসা যায় তৃতীয় তথা শেষ স্তবকে। এখানে বলা হয়েছে:

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল,
পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

শেষ স্তবকটি মিলনের চূড়ান্ত পরিণতি নির্দেশ করছে। এখানকার প্রতিটা কথা একই অর্থ নির্দেশ করছে। যেমন 'শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে' মানে নিঃশব্দে জীবন সায়হ্ন ঘনিয়ে আসে। 'ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল'- মানে এ চিল আর কোনদিন রৌদ্র উজ্জ্বল আকাশে উড়বে না। 'পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল'। এখানে কোন লেখিতে পান্ডুলিপির কথা বলা হয়নি। জীবন সায়াহ্নে এসে মানুষ তাঁর সকল সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে মেলে ধরে মনের খেরোখাতা। তখন জীবনের নান ঘটনা জোনাকির মতো ঝিলমিল করে মনের পর্দায় একের পর এক এসে আলো ছড়ায়। এটাই  এখানে কবির উপলব্ধি। 'সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন'- এটাও জীবনের শেষে পরিনতি নির্দেশ করছে।

জীবনের শেষ পরিণতি পর আর কি থাকে? শেষ পরিনতি পর মানুষ প্রকৃতির সাথে মিশে যায়; হারিয়ে যায় মৃত্তিকার মাঝে। এখানে বনলতা  হলো প্রকৃতি তথা মৃত্তিকা।

রবি ঠাকুরের সোনার তরী যেমন শুধু একটি নৌকা নয়; এটা মানুষের জীবন তরী।  তেমনি জীবনানন্দ দাশের বনলতাও শুধু একজন নারী নন; বনলতা হল প্রকৃতির মাঝে অবহেলায়, অযত্নে বেড়ে ওঠা এক নারী সত্তা- যিনি একাধারে মমতাময়ী মাতা; প্রেমময়ী প্রিয়সি; নিরাপদ আশ্রয়দাত্রী সহধর্মিনী; বৃদ্ধ বয়সে সস্নেহে সযত্নে মাথায় হাত বুলানো স্নেহময়ী কন্যা। সর্বোপরি তিনি প্রকৃতি তথা মৃত্তিকা; যেখানে মানুষ বিলীন হয়ে যায়; হারিয়ে যায়; থেমে যায় সকল কথা।
                   -------ঃঃ-------