এখন ফাল্গুন-চৈত্র মাস। বৃষ্টির অভাবে মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির। মাঠের ফসল পুড়া উপক্রম।  নদী মাতৃক বাংলায় ছোট-বড় জালের মত অসংখ্য নদী ছড়িয়ে আছে। কিন্তু বড় নদী গুলোর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে। ফলে নদী গুলোর বহমান জলরাশি শুকিয়ে গেছে। সমতলের পানির স্তর খুব নীচে নেমে গেছে। উঁচু স্থানে বসবাসকারী লোকজন নলকূপ চেপে পর্যাপ্ত পানি পাই না। পুরো প্রকৃতি যেন খুব তৃর্ষ্ণাত।
ফাল্গুন মাস শেষ হল। এ মাসে বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা দেখা যায়নি। চৈত্র মাসের প্রথম দিন। শেষ বিকালের আকাশে কাল মেঘ জমেছে। দমকা বাতাসে সেই মেঘ ভেসে গেল। আকাশে এরকম মেঘ দেখা দিলেও বৃষ্টি হয় না। গ্রামের চাষীরা চিরাচরিত প্রথায় মানত করে। আধুনিক সমাজে গ্রামের এসব মানা জানা কুসংস্কার বলে। সাধারণত বৃষ্টির জন্য আঙিনায় ভর দুপুরে বালতি ভর্তি পানি ঢেলে গান করে ‘‘আল্লাহ মেঘ দে; পানি দে ছায়া দেরে তুই”। সনাতন ধর্মের লোকেরা দু’টো কুনো ব্যাঙ ধরে সিঁদুর পড়ায়ে রীতিমত বিয়ে দেন। আবার মুসলিম ধর্মাবলম্বী লোকজন খোলা মাঠে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে। এভাবে বৃষ্টির জন্য পাড়া মহল্লায় নানামুখী আয়োজন চোখে পড়ে। তবে বৃষ্টির জন্য খোলা মাঠে নামাজ পড়া কুসংস্কার পড়ে না। অন্য সব ইসলামের দৃষ্টিতে কুসংস্কার হিসেবে বিবেচ্য।    
এই গ্রামের বিধবা নারী আমিনা কুঁড়ে ঘর নিয়ে খুব চিন্তায় আছে। অর্থের অভাবে কুঁড়ে ঘরটি মেরামত করতে পারেনি। বিবাহের দু’বছরের মাথায় তার স্বামী সৎবাবু মস্তিস্কের রক্ত ক্ষরনে মারা গেছে। তখন শিশু আশিকের বয়স দশ মাস। তার স্বামীর ভিটেমাটি ছাড়া কোন জমা জমি নাই। সে বিয়ের প্রথমে স্বামীর মুখে শুনে ছিল; তার নানার বাড়ি বিত্তশালী। কিন্তু কিশোর বয়সে বাবা-মা হারায়ে খুব কষ্টে বড় হয়েছে। তবু মা’র সম্পত্তির ভাগ নিতে লোভ-লালসা করেনি।
সৎবাবু ছিল সংসারে একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। আমিনা ভাবছে কোলের শিশুকে নিয়ে কিভাবে সংসার চলবে। আশিকের নানা বেঁচে থাকলেও চলার পথে সহযোগিতা পেত। কিন্তু ভাই-ভাবীর অভাবী সংসারে কতদিন ঠাঁই নিবে..? তারাও একদিন বোঝা মনে করবে। তার মৃত্যুর পর যতসব দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বামীর মৃত্যুর পর আত্মী-স্বজন অনেকে নানাভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু মাস ছ’য়েক যেতে না যেতেই সবাই ভুলে গেছে। ইতোমধ্যে তার ঘরে যৎসামান্য পুঁজি ছিল  তাও শেষ হয়েছে। আশিক  ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। আমিনা মনে ঠিক করল স্বামী হারানো শোক ভুলে কিছু করতে হবে।
তার মনে হলো প্রতিবেশী চাচী নুড়িমা’র কথা। তাকে বলেছিল; বাড়ির কয়েক কাঠা ধান মুড়ি-চুড়া ভাজার জন্য নিয়ে আসলে কিছু টাকা রোজগার হবে। আর মুড়ি ও চালের খুঁদ সংসারে কাজে লাগবে।” সকালে ছেলেকে নিয়ে নুড়িমা’র বাড়িতে গেল। সে তাকে দেখে চা-নাস্তা খেতে দিল।  আমিনা বলল; চাচী মোক যে তোমরা মুড়ি-চুড়া ভাজার ধান দিবা চাহিসলেন। সেইলা নেগবা অইচ্ছু। আশিকের বাপ মরার পর ঘরত আছু।  এখন মোর চলার কষ্ট। আমিনার কথা শোনে নুড়িমা দশ কাঠা ধান বের করে দিল।  তাকে বলল পাঁচ কাঠা মুড়ি ভাজিস আর পাঁচ কাঠা চুড়া কুটে আনিস। ধান নেবার পর আমিনা দাঁড়িয়ে রইল। কারণ ঘরে বড় ডেইজকি, মুড়ি ভাজা কানতাই নাই। নুড়িমা বলল; বেটি আমিনা তোর কী সমস্যা। আমিনা নরম স্বরে বলল বড় ডেইজকি ও কানতাই নাই। মুই ধান কুনঠে ভিজাম। আর কিসত মুড়ি ভাজিম। এই কথা শুনে নুড়িমা ঘর থেকে পাঁচশ টাকা এনে দিল। আমিনা বলল চাচী তোমাক টাকা কোন দিন শোধ দিম। নুড়িমা তাকে ধমক দিয়ে বলল তোক দিবা হবে নাই। শুধু মুড়ি চুড়া ভাজার খরচ বাবদ কাটে দিস। আমিনা মুচকি হেসে ধানের পটলি নিয়ে বাড়িতে রওনা হল।
আমিনা’র পিঠে শিশু আশিক ঘুমায়ে গেছে। দুপুর বেলার খাবার খেয়ে কিছু ক্ষন বিশ্রাম নিল। বিকালে প্রতিবেশী জমির চাচার বাড়ি গেল।  তাকে টাকা দিয়ে বলল চাচা হাট থেকে মোক একখান বড় ডেইজকি আর কানতাই কিনে দেন। সন্ধ্যায় জমির তাকে জিনিস গুলো এনে দিল। আমিনা রাতে ধান ভিজায়ে দিল। সকালে ভিজা ধানের পানি ঝড়ায়ে দু’ভাগ করল। এবার মুড়ির ধানগুলো ভাফায়ে নিল। চুড়ার ধানগুলো রেখে দিল। আমিনা ভাবছে চুড়া কুটার জন্য কম পক্ষে দু’জন লোকের দরকার। আর তিনজন হলে ভাল হয়। সে পাশের বাড়ির সখিনাকে ডেকে নিল। সখিনার পরিবারও খুব কষ্টে চলে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে তার চুড়া কুটা হয়ে গেল। সকিনাকে খাবার জন্য কিছু চুড়া দিল। দু’দিন বাদে ধান শুকায়ে মুড়ি ভেজে নিল। এবার চুড়া ও মুড়ি নিয়ে নুড়িমার বাড়ি গেল। আমিনার হাতের তৈরি চুড়া-মুড়ি দেখে নুড়িমা খুব খুশি হল। সে কাঠা দিয়ে চুড়া-মুড়ি মেপে দিল। কিছু  মুড়ি ও চুড়া বেশি হল। নুড়িমা তাকে খড়ি আর লবণ কেনার একশ টাকা দিল। আমিনা বলল; চাচী মোক তো আগত পাঁচশ টাকা দিছেন। নুড়িমা এই টাকা একশও নে। বাড়ির অন্যান্য খরচাদি করিস। আর আশপাশে গ্রামের ফান্না-তুসকার বাড়িত মুড়ি ও চুড়া ধান চাহিস।
নুড়িমা’র কথা মত আমিনা আশপাশের গ্রামে গিয়ে ধান সংগ্রহ করে। এভাবে মুড়ি-চুড়া তৈরির বাড়তি আয় দিয়ে ছেলেকে নিয়ে জীবন যাপন করে। এই কাজের জন্য ছেলের ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারে না। এক রাতে আশিকের শরীরে খুব জ্বর। তার মাথায় জল পট্টি দিয়েছে। সকালে বাড়ির পাশের ভাটির গাছ (জংলি তিতাযুক্ত গাছ) কুচিপাতা থেঁথলে রস করল। এবার গুড় মিশায়ে ছেলেকে হাফ চামুস খাইয়ে দিল। সেদিনের মত শরীরের জ্বর সেরে গেল।
আমিনার কষ্টের সংসারে একমাত্র অবলম্বন আশিক। তার বয়স ছয় বছরে পৌঁছেছে। কিন্তু খানা-পিনা অনেক কমে গেছে। দিন দিন শরীরটা শুকায়ে যাচ্ছে। সে ছেলেকে নিয়ে খুব চিন্তিত। নুড়িমা’র বাড়ি দ্বিতীয় বার মুড়ি-চুড়ার ধান নিতে গেল। ছেলের চেহারা দেখে নুড়িমা বলল তোর বেটার কী হইছে। আমিনা বলল চাচী কয়েক দিন আগত জ্বর হইছে। আর জ্বর খান ছুটার পর খাবার রুচি নাই। নুড়িমা আশিকের কপালে হাত দিয়ে বলল শরীর হালকা জ্বর তো আছে। তুই ওকে ডাক্তার দেখাস।
নুড়িমার বাড়ি থেকে ফিরে এল। বিকালে ছেলেকে নিয়ে পল্লী ডাক্তার জয়নুলের কাছে গেল। ডাক্তার আশিকের শরীরে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখে ওষুধ দিল। আশিক ধীরে ধীরে সুস্থ হলো। দুরন্ত মনা আশিক মা’র অগোচরে আশপাশ খেলা ধুলা করে। একদিন খেলতে গিয়ে বাম পা ভেঙ্গে গেল। এ যেনো মরার উপর খরার ঘা। গ্রামের কবিরাজ ডেকে গাছ বেঁধে নিল। কবিরাজী চিকিৎসা করায় আশিকের পার বড় ধরনের ক্ষতি হল। কবিরাজী চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্মত যথোপযুক্ত না হওয়ায় ভাঙ্গা পায়ের পচন ধরেছে আমিনা মহা দুশ্চিন্তা পড়ল।
নুড়িমা’র পরামর্শে ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার আশিকের বাম পা কেটে ফেলে দিল। আমিনার কলিজ্বার টুকরা ছেলেটি চিতরে পঙ্গু হল। সে ভেবে ছিল তার কষ্ট হলেও ছেলে বড় হলে একদিন দুঃখ ঘুচাবে। কিন্তু ছেলের পঙ্গুত্ব বরণ তাকে ব্যথিত্ব করল। এখন তার দু’চোখ দিয়ে পানি গড়ার দাগ পড়েছে। তাকে সান্ত্বনা দেবার কেউ নাই। যৎ সামান্য সাহায্য সহযোগিতা প্রতিবেশী নুড়িমা’র কাছে পান। কিন্তু নুড়িমা’র বয়স হয়েছে। এখন আগের মত চলাফেরা করতে পারে না। বাড়িতে তার বউ মা সংসার দেখা শোনা করে। তার দুখের কথা খুব বেশি বোঝে না।
আমিনার কুঁড়ে ঘর খানি প্রতি বছর ঠিক করতে হয়। ছেলের অসুস্থার কারণে এবার ঠিক করতে পারেনি। আজ আকাশে মেঘ দেখে তার খুব চিন্তা হয়। যদি মধ্য রাতে বৃষ্টি আসে। তবে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে কী করবে? সেদিন মধ্যরাতে বৃষ্টি হয়নি। ভোর রাতে মুষুল ধারে বৃষ্টি এলো। আশিককে নিয়ে ঘরের কোনে বসে রাত কাটল। সকালে জমির চাচা বাড়িতে এল। সে ঘর থেকে ভেজা কাঁথা-বালিশ তুলে রোদে দিবে। এমন সময় জমির চাচার ডাক দাদু আশিক কেমন আছ..? আমিনা তা রেখে বসার জন্য খড়ের বিড়া এগিয়ে দিল। আশিকও বাহিরে বসে আছে।
জমির দেখল আমিনার দু’চোখ দিয়ে পানি ছলছল করছে। কিভাবে তাকে সান্ত্বনা দিবে। আশিক বলল দাদা আইজ রাতি হামরা মা’সহ পানিত ভিজে গেছি। সে ভিতরে গিয়ে দেখল কুঁড়ে ঘরটির চাল দিয়ে আকাশ দেখা যায়। আমিনাকে সান্তনা দিল। খোদা তোর কপালত এতই দুঃখ রাখিছে।  মা আমিনা তুই সহ্য কর। আগামী দেউবার মুই তোর ঘরটার চাল ঠিক করে দিম। তবে খর ও কুইসারের পাতা কিনার টাকা কী আছে..? চাচা মোর লগত দশ কুড়ি টাকা আছে। আমিনা হাফ ছারে বলল চাচা মোর ঘরটা ঠিক করে দিলে পঙ্গু ছোঁয়াডাক-লে রোভা পারিম।
জমির খর যোগাড় করে ঘর ঠিক করে দিল। আর বলল মা আমিনা তোর কপালের দুঃখ দেখে মোর কষ্ট হছে। কিন্তু মোর তো তেমন সম্পদ নাই; যা তোক দিম। তবে মুঁই যতদিন বেঁচে আছু; তোর দুখে যতটা পারিম সহযোগিতা করে যাম। জমিরের কাছে এমন সাহস পেয়ে আমিনার মুখের মলিনতা দূর হল। আশিক ততদিনে কিশোর বয়সে পৌছে গেছে। সেও দু’হাত দিয়ে মার গলা ধরে বলল; মা তোকে আর কষ্ট করতে হবে না। দাদুর সংগে মুই কাজ করিম। পঙ্গু ছেলের মুখে এই কথা শোনে  মায়ের মুখে  হাসি ফুটল। #