নবাব একজন কাঠুরিয়া। বনের কাঠ কেটে পরিবারের ভরন পোষণ করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে গ্রামের বন জঙ্গল উজার হয়েছে। প্রতিনিয়ত পাহাড়ী অঞ্চলের গাছপালা ও প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে। এসবের কারণে এখন কাঠও পায় না। গ্রাম-গঞ্জে ডিজিটালের ছোঁয়া লেগেছে। দেশীয় খড়ির চাহিদাও কমেছে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারেও রান্নার জন্য গ্যাসের চুলা আছে। এক হাতের রোজগারে সংসার চালাতে নবাবের কষ্ট হয়।
কাঠুরিয়ার স্ত্রী সোহাগী একজন ধর্মভীরু নারী। নিজে তেমন লেখা পড়া করতে পারেনি। তবে সামাজিক কুসংস্কার সম্পর্কে বেশ সচেতন। একমাত্র সন্তানের পড়া লেখার বিষয়ে খুব চিন্তিত। পরিবারে স্বল্প আয় দ্বারা ভাল কোন পাঠশালায় সন্তানকে দিতে পারছে না। একজন মুসলিম হিসেবে শিশু সন্তানকে সবার আগে দ্বীনি ইলেম শিক্ষা দেয়া দরকার। ধর্মীয় এ শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর আচার আচরণ সমাজে প্রস্ফুটিত হয়। তাই স্বামীর সংগে সুপরামর্শ করে সন্তানকে মক্তবে দিল। প্রতিদিন সকালে নাস্তার পর কাঠুরে কুড়াল নিয়ে বনে যান। আর সোহাগী ছেলেকে মক্তবে দিয়ে আসেন। ছোট শিশু সুজন মক্তবে কায়দা (আরবি অক্ষর চিহ্নিত বই) পাঠ শেষ হয়েছে। মক্তবের হুজুরের কাছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন পড়েন। এক বছরে আল কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে ভাল জ্ঞান লাভ করল। বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যা অযু করে সুজন আল কুরআন তেলায়াত করে। মা সোহাগী ছেলের মুখে সহি শুদ্ধ পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত শুনে মুগ্ধ। তবে সে হুজুরের কাছে যা শিখেছিল তাতে অনেক উচ্চারণ কিছুটা আলাদা মনে হয়। তাই ছেলের তেলায়াত শুনে নিজের ভুল উচ্চারণ শুদ্ধ করেন। কারণ ছেলে ক্বারিয়ানা পদ্ধতিতে সহি শুদ্ধভাবে আল কুরআন পাঠ করেন। সুজনের মক্তবের পাঠ শেষ। এখন বড় হয়েছে। তাকে প্রাথমিক পাঠশালায় দিতে হবে।
গ্রাম থেকে পাঠশালা মাইল দু’য়েক দূরে। নবাব কাঠ বিক্রির টাকায় সংসার চলে। স্বল্প আয় দিয়ে ছেলের পড়া-লেখার খরচ বহনে আরও কষ্ট হবে। তবু ছেলেকে পড়াতে হবে। তাকে শুধু মানুষ নয়; একজন আদর্শ ভাল মানুষ হিসেবে গড়াতে হবে। স্বামীর পরামর্শে ছেলেকে পাঠশালায় ভর্তি করে দিল। সুজনের সহপাঠিরা দি-চক্রযান নিয়ে পাঠশালা যান। তাদের দেখে সেও মা’র কাছে চক্রযান কিনে চায়। তার এই চাওয়ার কথা বাবাকে বলতে ভয় পান। ছেলের এই বাহনা রাতে কাঠুরিয়াকে জানাল। অভাব অনটনের সংসারে কাঠুরিয়ার মাথায় যেন বাঁজ পড়ল। একে তো বন জঙ্গল নাই। বাঁশ বাড়ি আর ঝোপ-ঝাঁড় থেকে প্রতিদিন কিছু কাঠ সংগ্রহের পর বাজারে বিক্রি করে কোন মতে সংসার চালান। এবার ছেলের একটি চক্রযান নেবার তাল-বাহনা। ছেলে চক্রযানের অভাবে পাঠশালা যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। অর্থের অভাবে সমস্যাটি সমাধান করতে পারছে না।
স্বামীর অসহায়ত্ব দেখে সোহাগী তার হাতের দু’টো রুপার গহনা বের করে হাতে দিল। বলল এগুলো বিক্রি ছেলের জন্য চক্রযান নিয়ে এসো। কাঠুরে একটি চক্রযান কিনে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল। সেদিন বনে কাঠ কাটার সুযোগ হয়নি। হাতে বাজারের ব্যাগ না দেখে স্ত্রী চুপচাপ। ঘরে এক বেলার চাউল আছে। কিন্তু রাতে খেলে দুপুরের হবে না। ঘরে ঢুকে রাতের রান্না বসাল।
কাঠুরে ছেলে সুজনকে বলল; আমি কোন পড়া শুনা করিনি। কোন মত নাম দস্তখত দিতে পারি। এতদিন তোমার মা আদর করে মক্তবে পৌঁছে দিত। তুমি এখন বড় হয়েছ। দি-চক্রযান নিয়ে একাকি পাঠশালা যেতে হবে। তুমি যেতে পারবে..? সুজন মাথা নাড়িয়ে বলল পারব। এবার কাঠুরে বলল শুনও বাবা তোমার দাদী বলে গেছে ‘‘চুরি করে মাংস ভাত খাবার চেয়ে ... ভিক্ষা করে খাওয়া অনেক ভাল। আর ভিক্ষাবৃত্তি করার চেয়ে নিজে উপার্জন করে খাওয়া আরও উত্তম।” তোমার দাদা আর দাদী আমাকে শিশু থেকে কিশোর পর্যন্ত সবর্দা সততা ও ন্যায় নিষ্ঠা পথে চলার কথা শেখায়েছেন। আমি কুড়াল নিয়ে সারাদিন বনে কাঠ কাটি। অনেকে লোভ লালসা দেখান। কিন্তু আমি বাবা-মায়ের শেখানে সততার বাণী ভুলিনি। সর্বদা চেষ্টা করি তাঁদের মান সম্মান অটুট রাখার। আমি গরীব হতে পারি; কিন্তু অসৎ কোন লোক নয়। এসব কথা তোমাকে বলছি; আমাদের পরিশ্রম যেন সার্থক হয়। তুমি লেখাপড়া শিখে বাবা-মায়ের আশা পুরণ করবে।
রাতের রান্না হয়ে গেছে। সবাই মিলে রাতের খাবার খেলো। পরের দিন সকালে ছেলে চক্রযান নিয়ে পাঠশালা গেল। সুজন চক্রযান পেয়ে মহাখুশি। কাঠুরের ছেলে নতুন চক্রযান নিয়ে পাঠশালা যান! কোন একদিন গ্রামের মাতব্বরের চোখে পড়ল। তার ছেলেদের মনে হিংসা হয়। গ্রামের সবাইকে শাসন ও শোষণ করে। তারা বিনা দোষে কাউকে শায়েস্তাও করে। তবু তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলে না। কাঠুরিয়ার এত বড় সাহস কোথায় পেল?
সুজন নিয়মিত পাঠশালা যাতায়াত করে। গুরুজনদের কথা মত পড়া শোনায় তার মনোযোগ আছে। কাঠুরিয়ার ছেলের কথা গুরুজনদের মুখে মুখে। কাঠুরিয়ার ছেলের প্রশংসা মাতব্বরের আর সহ্য হয় না। যে কোন ভাবে হোক কাঠুরিয়াকে গ্রাম ছাড়া করতে হবে। মাতব্বর হঠাৎ একদিন চুরির অপবাদে তার সাঙ্গপাঙ্গ দিয়ে কাঠুরিয়াকে ডেকে আনল। মাতব্বর চোখ রাঙ্গায়ে উল্টাপাল্টা কথায় কাঠুরিয়াকে শাসাল। এমাসে তাকে গ্রাম ছাড়াতে হবে; সাব জানিয়ে দিল। কাঠুরে নবাব বিনা দোষে মাতব্বরের এই অপমান কোন মত মেনে নিতে পারছে না।
সকালে কাঠুরে নবাবের মনটা খুব খারাপ। সুজন তা দেখে কাছে এসে গোলা জড়ায়ে ধরে বলল, তোমার কি হয়েছে বাবা..? আমাকে চক্রযান কিনে দিতে তোমার সব টাকা শেষ; তাই তোমার মন খারাপ। কাঠুরিয়া হেসে বলল; বাবা আমার কিছু হয়নি। তুমি স্কুলে যাও। তোমাকে পড়া লেখা শিখে আদর্শবান ভাল মানুষ হতে হবে। তুমি আদর্শ মানুষ না হলে; মুর্খ মাতব্বরের রক্ত চোখে পদদলিত হবে। তার লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে বিনা দোষে নির্যাতনের শিকার হবে।
কাঠুরিয়া সেদিন কিছুটা দেরিতে কুড়াল নিয়ে বেরিয়ে গেল। সেদিন মাতব্বরের এলাকা ছেড়ে গারো পাহাড় জঙ্গলে গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হলো। তবু কাঠুরিয়া বাড়িতে ফিরে না। স্ত্রী সোহাগী এ নিয়ে খুব চিন্তিত। বাড়িতে কোন চাল-ডাল নাই। বাজার আনার পর চুলায় রান্না উঠবে। কিন্তু কাঠুরিয়া গভীর রাতেও বাড়ি ফিরল না। সোহাগী নির্ঘুম রাত কাটল। খুব সকালে ছেলেকে নিয়ে স্বামীর সন্ধানে বের হলো। আশপাশে কয়েক গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু কাঠুরিয়ার কোন খোঁজ-খবর পাইল না। পরিচয় গোপন রেখে কাঠুরিয়াকে চিনত এক ব্যক্তি মাতব্বরের নির্যাতনের কথা সোহাগীকে জানাল। এবার সোহাগীর ধারণা নিশ্চয় গ্রামের মাতব্বর তার স্বামীকে মেরে পুঁতে ফেলেছে।
একমাত্র উপার্জন শীল ব্যক্তি নিরুদ্দেশ হওযায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ল। কিন্তু ছেলের ভবিষ্যৎ কথা ভেবে নিজেকে সামলে নিল। এবার সুজনকে নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে ছুটে চলল। ময়মনসিংহের শহরে গিয়ে এক মামার বাড়িতে উঠল। মামা গার্মেন্টসে চাকুরি করেন। সোহাগী মামাকে সব কথা শুনাল। মামা তাকে বলল তুমি চিন্তা কর না। ম্যানেজারের সংগে কথা বলে তোমার জন্য একটা চাকুরি ঠিক করব। সোহাগী মামার মাধ্যমে গামের্ন্টসে চাকুরি পেয়ে গেল। কিছু দিনের মধ্যে ছেলে স্থানীয় পাঠশালায় ভর্তি করে দিল। সুজন বার্ষিক পরীক্ষায় পাঠশালায় সেরা ফলাফল অর্জন করল। পাঠশালার গুরুজনেরা তাকে বেশ স্নেহ করে। অভিভাবকদের পাঠশালায় ডেকেছে। ভাল ফলাফল অর্জনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের সংবর্ধনা দিবে। কিন্তু সুজনের মা’র হাতে কোন ছুটি নাই। বিনা ছুটিতে অনুপস্থিত থাকলে চাকুরি হারাবে। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা পাঠশালায় উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু বিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র সুজনের কোন অভিভাবক আসেনি। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ সুজনের হাতে পুরস্কার তুলে দিল। পরের দিন দেশের একাধিক জাতীয় দৈনিকে তার ছবি সম্বলতি খবর প্রকাশিত হলো। এখবর পড়ে ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল সুজনের পড়া-লেখার দায়িত্ব নিল। একই সংগে পরিচালনা পর্ষদের সংগে আলোচনা করে তার মাকে প্রতিষ্ঠানে চাকুরি দিল।#