গ্রামের ছেলে রবিন। তার শৈশব জীবন গড়ে উঠে গ্রামে। তার বাবা-মায়ের অভাব অনটনের পরিবার। সে জীবনের লক্ষে পোঁছার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। বাবা-মায়ের সংসারে ভবিষ্যতের একমাত্র অবলম্বন। খুব কষ্টে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন করে। সে কিশোর কাল থেকে মানব সেবায় ব্রত। নিজের সাধ্য অনুযায়ী বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। পুঁজিবাদী সমাজে গরীব-দুখী লোকজন নানাভাবে প্রতারণার শিকার হয়। ভুক্তভোগী লোকেরা একটু উপকারের আশায় তার কাছে ছুটে আসে। নির্যাতিত লোকজনের কষ্টের কথা শোনে তার মনকে ব্যথিত করে। এসব নিপীড়িত মানুষকে সঠিক পরামর্শ দেয়া তার নিত্য দিনের কাজ। সে কোথাও কোন অন্যায় দেখলে শক্ত হাতে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে। সে যেন দুখী মানুষের বন্ধু।
রবিন সমাজের মানুষ ও দেশকে নিয়ে ভাবেন। সমাজের কিছু মানুষ অন্যের প্রতি নানাভাবে অবিচার করেন। সে কখনো তাদের বিষ দাঁত ভেঙ্গে দিতে চাই। কিন্তু মুখোশধারীরা সমাজের কিছু ব্যক্তি নানা ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সমাজের দায়িত্বশীল ন্যায়-নীতিবানরা তাদের কাছে জিম্মি? এসব চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রতিবেশী নওশের সন্ধ্যায় গলা কাঁশি দিয়ে ডাকল; ভাইজতা রবিন ঘরত আছিস। সে ডাক শোনে টেবিলে বই বন্দ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। চাচা ঘরে এসে বসেন। কেমন আছেন? আপনাকে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মনে হচ্ছে। কারও কিছু হয়েছে নাকি?
নওশের-তেমন কোন হয়নি বাবা। মোর বাড়িত রোগ বালাই লেগে আছে। এই লা চিন্তায় কনোঠে ভাল লাগে না। তুই ছাড়া মোর কে আছে। তোরঠে ভাল পরামর্শ পাম এজন্য ওইচ্ছু। আর বাড়ির পাশত যারা আছে; সুযোগ পাইলে মোর ভিটেমাটি খান দখলত লিবে। ওই ভুঁইফোঁড় লোকনার লগত যাবা মনায় না। এইলার তানে তোর লগত বুঝিবা ওইচ্ছু। ভাইজতা তুই তো জানিস, মোর বাপের দেওয়া ভিটেমাটি খান বাদে আর কোন জমি নাই। ওই মাটি খানেরতি সবার লোভ। গ্রামের ফান্না-তুসকা মোক কহচে জমি খান বেচাবো নাকি? রাস্তার ধারের মাটিখান বেচালে হামাক কহিস। তোর বাপ জানলেহে মোর ওপর এলাকার ভুঁইফোঁড় কত নির্যাতন কইছে। ভাই মরে গেইছে! খোদা তাক বেহেশতবাসী করুক। তার চোখের পানি ছলছল করে গড়িয়ে পড়ছে।
রবিন- আমি তো আছি চাচা। কোন চিন্তা করেন না। নওশের ঘাড়ের গামছা দিয়ে চোখের পানি মুছে নিল। ভেঁজা গলায় বলল বেটা শাকিলের স্বাস্থ্য খুব খারাপ। ছোয়াডা কিছু খাবা চাহে না। একটুতে হাফাই যাচ্ছে। তোর চাচির শরীরটাও খারাপ। ছোয়াডাগ হাট থেকে দাবা কিনে খাওয়াছু কোন তে কমে না। দিনাজপুর হাট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল লেগা দেখানু। ডাক্তার কহিছে হার্টের রোগ হইছে। তাড়াতাড়ি অপারেশন কোর বা হবে। ছোয়াডার অসুখের কথা শুনে তোর চাচী আর মুই খুব চিন্তাত আছু। তুই এলা কি করবা কহছিস। এই লার তানে তোরঠে ওইচ্ছু। চাচা যত মুশকিল; তত আশানও আছে। শাকিলকে একবার ঢাকা হৃদরোগ ইনস্টিটিউট নিয়ে যান। আমাকে ঢাকা যাবার আগের দিন জানাবেন। আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব আছে। ফোনে তাদের বলে দিব। আপনাকে সহযোগিতা করবে।
ভাইজতা তুই মোক ভাল পরামর্শ দিলো। মুই যে ছোয়াডাগ ঢাকা লেগাম। কিন্তু মোরঠে বেশি টাকা তো নাই। রবিন আগে সব টাকা লাগবে না চাচা। আপনার কাছে কি তিন/চার হাজার টাকা নাই। আমার কাছে কিছু টাকা নিবেন। সেখানে ডাক্তার দেখে কী পরামর্শ দেয়। পরে সঠিক চিকিৎসা শুরু করা যাবে।
নওশের ঠিক আছে ভাইজতা। মুই শনিবার শালবাহান হাটত গাই গরুডা বেঁচে দিম। গরুডা বেঁচা হলে এসপ্তাহে ঢাকা লেগাম। ভাইজতা তুই ওইঠে কহে রাখিস। ঠিক আছে চাচা। ভাইজতা ভেলেখান রাইত হইছে। মুই আইজ বাড়িত গেনু। চাচা আপনার কাছে টোচ লাইট নাই। আমি বাড়িতে পৌছে দেই। নারে ভাইজতা মোক আগা দিবা লাগবেনি। মুই যাবা পারিম।
রবিন-আজ রাতে পড়াশোনা না করে শুইয়ে পড়ল। বিছানাই এপাশ-ওপাশ ওলট-পালট করছে। কোন ভাবে চোখে ঘুম আসছে না। শুধু ভাবনা নওশের চাচাকে কিভাবে সহযোগিতা করবে। গভীর রাতে ঘুমায়ে পড়ল। ভোরে ফজরের আযান শোনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করল। মসজিদ থেকে বেরিয়ে ভাবতে লাগল। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা দালাল বাট পার দিয়ে ভরা। টাকা থাকলেও দেশে ভাল চিকিৎসা পাওয়া যায় না। একশ্রেণির ডাক্তার নামক কসাই কিছু দালাল পোষেন। মানুষরুপী দালালদের খপ্পরে অনেকে সর্ব শান্ত হন। শেষে চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। বিভাগীয় শহরে ভাল ডাক্তারের কাছে পৌঁছা খুব কঠিন। এখন ডাক্তারের পিয়নরাই সাইনবোর্ড ঝুলায়ে জনসাধারণের সংগে প্রতারণা করেন। এরকম রেকর্ড দেশের সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যায়। ঢাকা পাঠালে নওশের চাচা কী সঠিক জায়গায় পৌছাবে। সে বিকেলে বন্ধুদের সংগে ফোনে যোগাযোগ করল। ঢাকার বন্ধুরা তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিল। এবার তার মনের দুশ্চিতা কিছুটা দূর হলো।
নওশের- রবিবার সকালে বাড়িতে এলো। ভাইজতা আজ রাতিত হানিফ গাড়িত ঢাকা যাবা চাহাচু। মোক আগের দিন অসপা কহিসলো। চাচা কত টাকা যোগাড় হয়েছে.? গাই গরুটা দশ হাজার টাকা বেচে দিছু। আপাতত এই টাকা সংগে লেগাম। আর কোনটে ঠেকে গেলে মুই তোক ফোন করিম। তোর ফোন নম্বরটা মোক একখান কাগজত লেখে দে। চাচা গাড়ীর টিকিট করেছেন.? ভাইজতা মুই তোরটে আগত ওসিনু। চাচা আপনার সাথে আর কে যাবে? তোর চাচীর ছোট ভাই।
রবিন-হানিফ গাড়ীতে তাদের জন্য টিকিট বুকিং দিল। বন্ধু মহসিনকে ঢাকায় ফোনে জানিয়ে দিল। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার কথা বলল। সে বলল দোস্ত তুমি কোন চিন্তা কর না। আমার ফোন নম্বর নওশের চাচাকে দিও। নওশের চাচা সকালে টেকনিক্যাল কলেজ গেটে নামল। সেখান থেকে মহসিনকে ফোন দিল। সে সিএনজি নিয়ে এসে তাদের ম্যাসে নিয়ে গেলো। চাচা রবিন রাতে আমাকে আপনাদের কথা বলে দিয়েছে। আমার এখানে আসতে একটু দেরি হয়েছে ক্ষমা করবেন। আপনারা রুমে বসে বিশ্রাম নেন। ম্যাসের বুয়া আসুক হালকা নাস্তা খেয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। সে রবিনকে তাদের পৌছার সংবাদ জানাল।
দোস্ত কষ্ট করে তাদের ডাক্তার দেখার ব্যবস্থা করিস। মহসীন তারা যখন এসেছে পৌঁছে গেছে। তুমি কোন চিন্তা কর না। আমি তাদের সংগে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। সকাল সাড়ে দশটায় তাদের ঢাকা হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে গেল। হৃদরোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শাকিলের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার করল। এবার পরামর্শ দিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অস্ত্রপাচার করার। এই চিকিৎসার জন্য কমপক্ষে তিন লাখ টাকার প্রয়োজন। সে ডাক্তারের পরামর্শপত্র অনুযায়ী অপারেশনের কথাটি রবিনকে জানাল। সে বলল ধন্যবাদ দোস্ত। তাদের রাতের গাড়ীতে তুলে দিস। আর আর্থিকভাবে সহযোগিতার বিষয়টা মাথায় রাখিস।
নওশের ঢাকা থেকে ফিরে এলো। ছেলের চিকিৎসার জন্য এত টাকা কোথায় পাবে। এই চিন্তুা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রবিনের কাছে সকালে ছুটে গেল। সব কাগজপত্র তাকে দেখাল। চাচা আপনি ঢাকা থেকে এসেছেন। এখন বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নেন। আমি রাতে আপনাদের বাড়িতে যাব। তখন একটা উপায় বের হবে। এমন সাহস পেয়ে নওশের বাড়িতে গেল। আর বলল; ভাইজতা তুই মোর মেলা উপকার করছিস। এইডা উপকারও করিস।
রবিন রাতে বাড়িতে গেল। তারা চেরাক বাতি জ্বালিয়ে বারান্দায় বসে আছে। তাকে দেখে সবার মনে সাহস হলো। সে শাকিলের চৌকির পাশে বসল। ভাইজতা কহ দেখি; এত টাকা কোনঠে পাম। মোর ভিটে মাটি দশ কাঠা জমি ছাড়া আর কোন সম্পত্তি নাই। পাঁচ কাঠা ভিটেমাটি বেচাবা হবে। জমির কোন গারহাক দেখে দে মোক। চাচা আপনি চিন্তা করবেন না। আমি যেহেতু আছি একটা ব্যবস্থা হবে।
নওশের চাচা দুই লাখ টাকায় জমি বেচে দিল। আরও এক লাখ টাকার প্রয়োজন। তাকে সংগে নিয়ে হাট-বাজারে চাঁদা তুলে দিল। স্থানীয় ব্যবসায়ী লোকজন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। শাকিলের চিকিৎসার বাকী টাকাও যোগাড় হলো। নওশের তাকে বলল ভাইজতা ঢাকার গাড়ির টিকিট কাটে দিস। মুই তোর উপকারের কথা ভুলবা পারিম নাই। তোর মত ভাল ছোঁয়া এই দুনিয়াত কজন আছে..? দোয়া করিস; শাকিলের অপারেশন যেনো ভাল হয়।#