পরিবারে পুত্র সন্তান নারীর জন্য অনেক পাওয়া। আর প্রথম সন্তান কন্যা হলে কোন রক্ষণশীল পরিবারে ওই নারীকে সইতে হয় নানান যন্ত্রণা। আমরা জানি জাহেলিয়াতের যুগে গোটা আরব সমাজ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। তখন আরবে কোন গোত্রে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাকে জ্যান্ত কবর দিত কিংবা আগুনে পুড়ে মারত। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর আগমনের পর গোটা আরব সমাজে সেই যুগের অবসান হয়। নারীরা ফিরে পাই আত্ম-সম্মান আর দাস-দাসী প্রভুর কাছ থেকে মুক্তি লাভ করে। সমাজে নারীদের কেনা-বেচা বন্ধ হয়। আরবে ফিরে আসে সোনালী যুগ। জাহেলিয়াতের পরবর্তী মধ্যযুগী নির্যাতন সমাজে বিস্তার লাভ করে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের নানামুখী বাঁধা বিঘ্ন ও কুসংস্কার নির্যাতন সহ্য করতে হয়। পরবর্তীতে আধুনিক যুগে বাঙ্গালি নারীরা প্রবেশ করে সমাজে নানামুখী অবদান রাখে। ইদানীং খবরের  কাগজে প্রায়শই নারী নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়। এখনো কন্যা সন্তানকে পাষণ্ড পিতা গলা টিপে মারে। এখনো নারী নির্যাতন নারী নিপীড়ন কমেনি।  
গ্রামের অল্প শিক্ষিত নারী শেফালি। পরিবারে সাত ভাই চম্পা। শৈশব কেটেছে বাবা-মা ও ভাইদের আদরে। সে  নাবালিকা থেকে সাবালিকায় পৌছে। লেখা-পড়ার দিকে তাকে আর অগ্রসর করার জন্য পরিবারের কোন চিন্তা নাই। এখন ভাল সমন্ধ এলে তাকে পাত্রস্থ করবে। পরিবারের সবার মাথায় শেফালি বিবাহ চিন্তা। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে শেফালির জন্য সমন্ধ আসতে থাকে। আর সমন্ধ নিয়ে লোকজন বাড়িতে এলে তাকে সাঁজিয়ে গুজিয়ে পানের ডালা দিয়ে মেহমানদের সামনে পাঠান। তখনো বুঝেনি তাকে পরিবারের মায়া ত্যাগ করে অন্য ঘরে যেতে হবে। যে কারণে তাকে এত সাজু-গুজু করতে হয়। এবার  গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারে তার বিবাহ ঠিক হলো।
বিবাহের পর শেফালি শ্বশুর বাড়িতে গেল। ধীরে ধীরে শ্বশুর বাড়ির লোকদের চিনতে লাগল। সবলা-সরলা শেফালির পরিবারের সংগে অনেক কাজ কর্মের এখানে মিলছে না। সে অল্প শিক্ষিত হলেও কুসংস্কার গুলো খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারত। কিন্তু সনাতনী বংশে রক্ষণশীল শ্বশুর-শাশুড়ী তাকে নানা ভাবে কটু কথায় অপমান করত। কিন্তু সোয়ামী দুলালকে বলেও কোন লাভ হয় না। দুলাল কোন মতে নাম সহি জানত। তাই দুলাল বাবা-মায়ের কথা সার্বক্ষণিক মেনে নিত।
এবার দুলালের পরিবারে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। প্রথম কন্যা সন্তান দেয়া শেফালির জন্য আরও কাল হলো। শ্বশুর-শাশুড়ী রীতিমত বলতে শুরু করল।  বংশে বাতি দেবার পুত্র সন্তানের বদলে কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে পরিবারকে ডুবাল। এজন্য রক্ষণশীল পরিবারে অলক্ষ্মী বউ। আশ-পাশের প্রতিবেশি লোকজনও শ্বশুর বাড়িতে এসে নানান কটু কথা বলে। কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না যে; কন্যা ও পুত্র সন্তান জন্ম  দেবার মালিক একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। নারী এককভাবে কন্যা সন্তান জন্ম দিতে পারে না। বরং পুরুষের সংক্রানুর মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। এক্ষেত্রে নারীর কোন দায় নেই। কিন্তু রক্ষণশীল পরিবার বিজ্ঞানের কোন সূত্র বিশ্বাস করে না।
দুলালের কন্যা সন্তানের নাম রাখল দুলালী। এই নামটি শেফালির দেয়া। পরিবারে দুলালী বড় হতে লাগল। ছয় বছর বয়সে দুলালিকে মকতবে পাঠাতে শুরু হলো। দুলালি খুব তাড়াতাড়ি দ্বীনি শিক্ষা শেষ হলো। মা শেফালি এবার তাকে আধুনিক শিক্ষার জন্য পাঠ শালাতে ভর্তি করে দিল।
কিন্তু শেফালির উপর পুত্র সন্তানের আশায় দ্বিতীয়বারে সন্তান ধারণ করল। শ্বশুর-শাশুড়ী নানা ভাবে মানা জানা করল। খুশিতে ফকির-কবিরাজ ডেকে খাওয়াল। শেফালির শরীরে তাবিজ কব্জ বেঁধে দিল। তার শরীরে নানান সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বরং তার শরীর দিন দিন খারাপ হতে লাগল। কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ীর কথামত তার স্বামী পানি পড়া, ঝাঁর-ফুক ও তাবিজ কব্জে বিশ্বাসী। যে কারণে কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই না।  তাবিজ-কব্জে যে কোন লাভ নেই। শেফালি এবার  স্বামী দুলালকে জানাল শহরের একজন ভাল কবিরাজ ডাক্তার আছে। স্বামী তার কথায় রাজি হলো। পরের দিন শুক্রবার স্বামীকে সংগে নিয়ে জনপ্রিয় ডাক্তার পীতাম্বর বাবুকে দেখাল। ডাক্তার বাবু তার শরীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা পরামর্শপত্র দিল। এবারও শেফালি কন্যা সন্তানের মা হলো। স্বামী দুলাল রেগে-মেগে বলল তুমি বললে শহরে ডাক্তার দেখালাম পুত্র সন্তানের আশায়। তারপরও তুমি কন্যা সন্তান জন্ম দিলে! এই কী তোমার বিজ্ঞান আর আধুনিক চিকিৎসার ফল। আমার বাবা-মা তাবিজ কব্জ করে দিত তাই তো ভাল ছিল। স্বামীর এতসব কথা শোনে শেফালি নির্বাক । স্বামীর সব কথা মুখ বুঝে সহ্য করতে লাগল। বড় মেয়ে দুলালীর নামের সংগে মিল রেখে দ্বিতীয় কন্যার নাম রাখল রূপালি। পরিবারে দুলালি ও রূপালি এক সংগে পাঠশালা যাওয়া আসা করে। মা শেফালি তাদের নিজেই পাঠ শালা পর্যন্ত পৌছে দেন। স্বামী দুলাল কন্যা সন্তানের লেখা-পড়ায় তেমন আগ্রহী নন।
দুলালকে দ্বিতীয় বিবাহ দেবার জন্য শ্বশুর-শাশুড়ী ঘটক পাখিকে খবর দিল। সবাই যখন রাতে ঘুমায়ে পড়ে। তখন শেফালি জায়নামাজ বিছায়ে নফল নামাজ পড়ে খোদার কাছে পুত্র সন্তানের আশায় দুআ করে। কিছু দিনের মধ্যে তৃতীয় সন্তান পেটে ধারণ করল। কিন্তু বয়স বেড়ে গেছে। এখন সন্তান জন্ম দেয়া জীবনের জন্য বেশ ঝুঁকি আছে। তাই ডাক্তার বাবুর স্বরনাপণ্য হতে হবে। প্রতি মাসে চেক আপে থাকতে হবে। কিন্তু স্বামী দুলাল তাকে কোন ভাবে ডাক্তার কাছে নিবে না। তবু ভয়ে ভয়ে দুলালকে বলল ওগো চল না কাল ডাক্তার বাবুর কাছে যাই।
স্বামী দুলাল তা মুখে এই কথা শোনে মুখ বাঁকিয়ে বলল; যখন রূপালি পেটে আসে তখনো তুমি ডাক্তার পীতাম্বর বাবুকে দেখার পরও পুত্র সন্তান হয়নি। আরও ডাক্তার দেখাবে। আমি যেতে পারব না। স্বামীর মুখে এই কথা শোনে শেফালি একাকি ডাক্তার বাবুর কাছে গেল। পুত্র সন্তান জন্ম না হওয়ায় তার কষ্টের কথাগুলো ডাক্তার বাবুকে জানাল। এবার ডাক্তার বাবু তাকে বলল; তোমার স্বামীকে একবার নিয়ে আস; আমি সব বুঝাইবে দিব। দেখবি ঠিক ঠিক তোমার উপর সব রাগ ও নির্যাতন কমে যাবে।
একমাস পরে শেফালি দুলালকে নিয়ে ডাক্তার পীতাম্বর বাবুর কাছে এলো। এবার ডাক্তার বাবু তাকে বুঝায়ে দিল। তোমাদের মাঝে যে সন্তান হবে তা পুত্র সন্তান হবে। যা হবে তোমাদের বংশের বাতি। কিন্তু শেফালির চিকিৎসা করাতে হবে। তাকে গাল মন্দ করা যাবে না। আর আগের কন্যা সন্তান দু’টিকে পড়া লেখা করাবে। কারণ ছেলে-মেয়ে সন্তান হবার বিষয়টি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ভাল জানেন। #