রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন গুলোর বিরোধে বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছু বন্ধ ছিল। আজ রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসেছে। বন্ধুদের সংগে একে অপরে কুশল বিনিময় করছে। কেউ গাছের ছায়ায় বসে গল্প করছে। সুজন ও সুমি দু’জনে ঝাউ গাছটার নীচে বসল। সুজন বলল সুমি  ক্যাম্পাসে আসছে মেয়েটিকে নতুন দেখছি। তুমি তাকে চিন?
সুমি- ওর নাম সীমা; বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ফাস্ট ইয়ারে। প্রথম ক্লাসে এসেই আমার সাথে পরিচয় হয়েছে। সে খুব নম্র ও লাজুক স্বভাব। শুনেছি তার বাবা ইংল্যান্ডে থাকেন। মা মাইলস্টোন স্কুল-এন্ড কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। তার ছোট ভাইয়ের নাম সৌরভ। সে দশম শ্রেণিতে পড়ে। অল্প কয়েক দিনে সে ব›ধু-বান্ধবীদের সাথে বেশ মিশেছে।
সুজন-কই আমার সাথে তো সীমার বন্ধুত্ব হয়নি। সীমা ক্লাসে বই রেখে কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে চলে এলো আর সুমিকে বলল; আমি এখানে বসতে পারি। সুমি মুচকি হাসি দিয়ে বলল; মনে হয় আমি প্রেম করছি তুমি বসলে অসুবিধা হবে। সীমা তুমি কী বলছ ওসব। আর যদি প্রেম করো; তবে আমি এখানে বসলে যদি তোমার অসুবিধা সেই জন্যই বললাম। সুমি লেকচার বাদদে এখানে বসে পড়।  
সুমি-ওর নাম সুজন। আমাদের বিভাগে পড়ে। সুজন আর সীমার মধ্যে এই প্রথম কুশল বিনিময় হলো। ইতোমধ্যে সুজনের বন্ধু শিমুলও সেখানে চলে এলো। সুজন তাকে উদ্দেশ্য করে বলল মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। দোস শুন আমরা তোর কথাই বের করেছি। শিমুল বাংলা বিভাগে ফাস্ট ইয়ারে পড়ে।  
সুমি- সীমাকে বলল; শিমুল খুব সুন্দর কবিতা, ছোট গল্প, ছড়া ও কৌতুক বলতে পারে। তাছাড়া একজন ক্ষুদে প্রতিভাবান লেখক। মুচকি হেসে শিমুল বলল; তুমি ওর কথায় কান দিও না। আমার কথা এমনিতে একটু বাড়িয়ে বলল। সুজন তার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। শিমুল বাংলা বিভাগে স্যারকে যেতে দেখে উঠে দাঁড়াল আর বলল আজ আসি অন্যদিন কথা হবে। সুজন বলল কীরে দোস তুই লজ্জা পেলি। তাই চলে যাচ্ছিস। শিমুল দোস; তুই শুধু আমাকে ক্ষেপাস কেন? সুজন নারে তুই সব সময় উল্টা বুঝিস। তোরা ভাল থাকিস বলেই শিমুল বাংলা ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে গেলো।  
মাধ্যমিক স্কুল জীবন থেকেই সুমি আর সুজন একে অপরকে পছন্দ করে। তাদের দু’জনের বন্ধুত্বের কথা আগে কেউ জানত না। এখন ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধবীরা জেনে গেছে। সুজন কিছুক্ষনের জন্য ক্লাস রুমে গেল। যাবার সময় সুমিকে বলল তোমরা এখানে আমি এখনে আসছি।
সুমি- সীমাকে জানাল সুজনের বাসা শিমলী আদাবর। তার বাবা তেঁতুলিয়া টি কোম্পানিতে চাকুরি করে। তার মা গৃহিনী। ওর বড় বোনের নাম সুরভী; ক’মাস আগে বিয়ে হয়েছে। জামাই একজন বড় ব্যবসায়ী। তাদের বাড়ি থেকে সুমির বাড়ির দুরত্ব তেমন বেশী নয়। বাড়ির ছাদে উঠে সুজনের বাসা দেখা যায়। আমার বাবা একজন সুমি অটো রাইস ইন্ডাষ্ট্রিজের মালিক।  ইতোমধ্যে সুজন সেখানে চলে এলো। সুজন পা জড়ায়ে বসতে না বসতে ক্লাসের বেল বাজল। তারা ঝাউ গাছের নীচ থেকে উঠে ক্লাসে গেল।
সীমা-ক্লাস শেষে বাড়িতে ফিরে এলো। দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানা গড়াগড়ি করছে। ভাবছে সুমির চাল চলনে বড় লোকের মেয়ে মনে হয় না। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের মতো তার চলাফেরা করে। পরিবারে সুমির কোন ভাই-বোন নাই। তাই বাবা-মা সব সময় কাছে রাখে। স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ হয়েছে। তবুও দু’জনের বন্ধুত্বের বিন্দু মাত্র ফাটল ধরেনি। সুমির কাছে বন্ধুত্বের এই গল্প শুনে রাতভর চিন্তা করে। সত্যিই তাদের ভালবাসা কত মহৎ। এদিন এই ভাবনায় ঘুমিয়ে পড়ল।

সুমি-সুজনকে বলল; তোমার সেই কবি বন্ধুটি কই ? আর তো দেখিনা; তোর সাথে দেখা হয়েছে।
সুজন-বেশ কয়েকদিন হল তার মায়ের অসুস্থতা বেশি; খবর পেয়ে বাড়ি গেছে। সে যাবার সময় আমাকে বলেছে সম্ভবত দু’এক দিন দেড়ি হবে। সে ক্যাম্পাসে ফিরে আসলে বিস্তারিত জানা যাবে।
সুমি- প্রথম দর্শনে শিমুলকে দেখে সীমার বেশ ভাল লেগেছে। তাই শিমুলকে কী যেন বলতে চাই।
সুজন-শিমুল মেয়েদের  সাথে এমনিতে কম মিশে। তার বাবা বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করত। হঠাৎ স্টোক করে মারা গেছে। বাড়িতে জমি জমা নাই। বৃদ্ধা মাকে নিয়ে শিমুলের সংসার। বেশ কষ্টে তাকে লেখাপড়া করতে হয়। তাই ক্লাস সময় বাদে টিউশনী নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এছাড়া শহরের ম্যাসে থাকা খরচাদি তুমি তো জানই। শিমুল এই কষ্টের কথা কোন বন্ধু-বান্ধবীকে সহজে  বুঝতে দেয় না। তার বাবার মৃত্যুর পর মায়ের অবস্থা বেশি ভাল নাই। ক্লাস মিস করে মাঝে মাঝে গিয়ে বাড়িতে যায় এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খরচাদি দিয়ে আসে। সে এই জন্য প্রায় সময়ে দুঃচিন্তায় থাকে। সুমি চল ক্লাসে যাই। স্যার হয়তো এসে পড়বে।  

শিমুল- আজ রবিবার ম্যাসে এসেছে। মায়ের কথা চিন্তা করছে। সকাল বেলা টিউশনীগুলো তাড়াতাড়ি সেরে ভার্সিটিতে গেলো। ক্লাসে বই রেখে, মেইন গেটের ডান পার্শ্বে ঝাউ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছে।
সীমা- শিমুলকে দেখে কাছে গিয়ে মৃদু সুরে বলল আপনি কেমন আছেন...?  
শিমুল- সীমার মুখের দিকে না দেখে জবাব দিল; ভালো আছি। পরক্ষনে মুখ উঠিয়ে সীমাকে দেখে বলল; আপনি কেমন আছেন।
সীমা-আমাকে তুমি করে বলবেন।
শিমুল-কেন, সেদিন সুজন ও সুমির সাথেই প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছে। আজ দ্বিতীয় দিন দেখা। তাই তুমি বলি কী করে; তা হয় না। সীমা- আমাকে তুমি করেই বলবেন। আমি কিছু মনে করব না।
শিমুল- সীমার এমন কথায় অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।
সীমা-আবার মৃদু হেসে বলল; কী ব্যাপার আপনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন যে;
শিমুল- হাস্যচ্ছলে বলল,‘‘মে আগার সামনে; মে চুপ রহো তো, তুম কুচ কহো’’ কিছুক্ষন গল্প হলো। আমার মাথা ব্যথা করছে। আজ আসি অন্যদিন কথা হবে কেমন। সে ভার্সিটি ক্লাস শেষে ম্যাসে ফিরল। বই খাতাগুলো টেবিলে রেখে খাটে গাঁ শুয়ে কল্পনার জগতে চলে গেলো। ভাবছে সীমা বেশ বড় লোকের মেয়ে। আমাকে এত আপন করে নিতে চায় কেন..? না মেয়েটি ধোকাবাজ। আমাকে নষ্ট করার জন্য এমন সব শুরু করল। আমাকে তার কাছ থেকে দুরে থাকতে হবে। বর্তমানে ধনী লোকের মেয়েরা সরলতার বিশ্বাসে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছেলেদের ভালোবাসার গান শুনায়ে ভবিষ্যৎ জীবনকে ধ্বংস করে। এসব কল্পনার মাঝে চোখে ঘুম এসে গেল।
এমন সময় একজন ডাকবাহক ম্যাসের গেটে দি চক্রজানের বেল বাজাচ্ছে। জোরে ডাক দিল ম্যাসে কেউ আছেন.? সে ডাক শুনে ঘর থেকে বের হলো। ডাকবাহক তাকে জিঙ্গাস করল; এখানে শিমুল নামে কেউ থাকে.? হ্যাঁ আছে। ডাকবাহককে বলল; আমি শিমুল। ডাকবাহক পরিচয় পেয়ে শিমুলকে বলল; এই নিন আপনার চিঠি। সে চিঠিটা হাতে নিয়ে ডাকবাহককে ধন্যবাদ জানাল। দেখ মা’র পাঠানো চিঠি। চিঠিটা খুলে পড়ল।
এলাহী ভরসা
বাবা শিমুল,
পত্রে আমার ¯েœহ ও ভালবাসা নিও। আশা করি তুমি ভালই আছ। তুমি যাবার পর আমার প্রচন্ড জ্বর। আমার গাঁ যেন পুড়ে যাচ্ছে। তুমি ছাড়া আমার কেউ নাই। তোমাকে দেখার বড় ইচ্ছা করছে। তোমার দেওয়া ওষুধগুলো নিয়মিত খাচ্ছি। তবুও যেন জ্বর গাঁ থেকে ছাড়ছে না। তাই তোমায় একবার দেখতে চাই। আমি ছাড়া তোর কেউ নাই। বাবা আমার খুব ভয় হয়। তোমাকে নিয়ে। আমার মরণের পর; তুমি কার কাছে আসবে.? তুমি চিঠি পাওয়া মাত্রই চলে আস।
এমন স্বপ্নের মাঝে আছরের নামাজের আযান ধ্বনি কানে শুনতে পেল। সে সজাগ হলো আর ভাবতে লাগল একি দেখলাম.! আমি যা দেখলাম তা কী বাস্তব..? না এটা হতে পারে না। আমি পরশু দিন মাকে মোটামুটি রেখে এলাম। তবে প্রথম দিন মা’র জ্বর বেশি ছিল। তখন একটু আবল-তাবল বকছিল। আমাকে সব যেন উল্টাপাল্টা লাগছে। এবার চিন্তা বাদ দিয়ে ঘরের ওয়ালের দিকে ঘড়িতে তাকাল। দেখে বিকাল পাঁচটা বাজে। এখন দু’টি টিউশনি আছে। সে তাড়াতাড়ি অজু করে আছরের নামাজ আদায় করল। নামাজ শেষে টিউশনিতে চলে গেল।
সীমা-ভার্সিটি থেকে বাড়িতে গিয়ে দেখে আব্বা এসে গেছে। সরাসরি বাবার কাছে গিয়ে বলল; বাবা তুমি কেমন আছ।
বাবা-আমি ভাল আছি। তুিম কেমন আছ ?
সীমা- আব্বু ভাল আছি।
বাবা- তোমার লেখা-পড়া কেমন চলছে?
সীমা- বেশ ভাল। তবে সামনে সেকেন্ড ইয়ার প্রমোশন পরিক্ষা। বাবা তুমি কয়দিন থাকবে? নানী ও ফুফিদের বাসায় যাবে না? বাবা- অবশ্যই যাব। তোমার আম্মা সহ তুমিও যাবে কেমন।
বাবা- আমি পনের দিনের ছুটি পেয়েছি। এই কয়েকদিন বাড়িতে তোমাদের সাথে সময় দিব।
সীমা- বাবা তুমি বাড়িতে থাক না তাই কোথাও যাওয়া হয় না। তাছাড়া মা কলেজ নিয়েই ব্যস্ত। আমি ভার্সিটি থেকে ফিরে বেশি সময়ই একাকি থাকি। আর কাজের বুয়া তো বাড়ির কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এই কয়দিন তোমার সঙ্গে ঘুরব।
সুজন- সীমাকে বেশ কয়দিন কলেজে দেখেনি। সুমি তুমি জান সীমা আসছে না কেন?
সুমি - আমাকে বলেছিল এ মাসের তার বাবা বাড়িতে আসবে। সম্ভবত তার বাবা বাড়িতে এসেছে। তাই সে ক্যাম্পাসে আসছে না।

পরের দিন ভার্সিটিতে পৌঁছে বাংলা বিভাগে ঢুকতে না ঢুকতেই দেখল সুজন দাড়িয়ে আছে। সুজন জিঙ্গেস করল কীরে দোস্ত তোর সাথে দেখা করার জন্য কয়েকদিন যাবৎ খুঁজে ফিরে যাচ্ছি। তাছাড়া ব্যস্ততার কারণে তোদের মেসে গিয়ে খোঁজ নিতে পারিনি। শিমুল খাতা বই টেবিলে রেখে দোস্ত মা’কে রেখে আসার পর সেদিন স্বপ্ন দেখে ধৈর্য্যহারা হযে মায়ের খোঁজ নেওযার জন্য কাউকে না বলে বাড়ী গেছিলাম। বাড়ীতে বেশ কয়েকটাদিন দেরি হল। সুজন খালা আম্মা বর্তমানে কেমন আছে। আমি তো শহরে ডাক্তার দেখিয়ে কিছুটা সুস্থ্য রেখে এসেছি। তবে মা,কে বাড়ীতে অসুস্থ রেখে এসে মনটা মাঝে মাঝে ছটপট করছে। কিছুই ভাল লাগে না। যাক এসব চিন্তা দুরে রাখ। বাকি কয়েকটা দিন ভালভাবে পড়াশোনা কর। তোকে তো পাস করতে হবে। আমি  ক্লাসে যাই স্যার যাচ্ছে। সুজন দোস্ত শিমুল তুই আমাদের এখানে আসিস অনেক কথা আছে।
সীমা তার বাবার সঙ্গে কয়েকদিন কাটাল। গতকাল বারোটার ফ্লাইটেই বাবা চলে গেছে। পরের দিন ভার্সিটিতে পৌঁছে ক্লাসে বসে কী যেন ভাবছে। স্যারের লেকচারের দিকে তার মনোযোগ নাই। সীমা কীরে তোকে আজ অন্য মনস্ক লাগছে। তোকে আর ঘাবড়াতে হবে না। তোর প্রিয়জন দু’দিন আগে মেসে উঠেছে। শুনেছি তাঁর মায়ের নাকি খুব অসুখ ছিল। সীমা তবুও আমাকে বলেনি। তাছাড়া তুই তো আমাকে চিঠি দিয়ে বলতে পারতি। সত্যি সুজন একটা বড় স্বার্থপর। সুমি রেগে গিয়ে বলল, এখানে তো সুজন নাই; যখন সামনে আসবে, তখন যা বলার  বলবি। তুই তো তোর প্রিয়জনকে একটা চিঠি দিয়েও জানতে পারতি তোর হবু শাশুড়ি কেমন আছে ? সীমা ঘরে পৌছে রাতে পড়ার টেবিলে বসে একটি পত্র লিখল।
এলাহী ভরসা
প্রিয় শিমুল,
পত্রে আমার সালাম ও ভালোবাসা নিও। আশা করি মহান আল্লাহর কৃপায় বেশ ভাল আছ। পরকথা-কযেক দিন ধরে তোমাকে ভার্সিটিতে দেখিনা। আজও খুব আশায় ছিলাম তোমার সাথে দেখা হবে। কিন্তু ক্লাস দেরিতে বসায় দেখা হয়নি। পরে সুমির কাছে জানলাম খালা আম্মার অসুখের কথা শুনে বাড়িতে গেছিলে। খালা আম্মার অসুখ মনে হয় সেরেছে.? আমি বিগত কয়েকদিন ভার্সিটিতে যেতে পারিনি। বাড়িতে আব্বু এসেছিল। আমার এই কয়েকটা দিন যেন কয়েকটা বৎসর মনে হয়েছে। খানিকটা সময় আব্বুর কাছে ঘুরে এসেও কোন শান্তি পায়নি। নিজেকে ভিষন খারাপ মনে হচ্ছিল। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে । তবুও আমার চোখে ঘুম আসে না। জানিনা মন কাকে যেন খুঁজছে ? আজ অনেকটা শান্তি বোধ করছি। আগামীকাল ভার্সিটির শহীদ মিনারের পিছনে দেখা করবে। অবশ্যই দেখা করবে। সাক্ষাতে সব কথা হবে।
কুহেলী  উত্তরি তলে মাঘের সন্ন্যাসি গিয়াছে চলিয়া ধীরে,
পুস্প শুন্য দিগন্তের পথে; রিক্ত হস্তে-তাহারি পরে মনে
ভুলিতে পারিনা কোন মতে।
পরিশেষে তোমার মুল্যবান সময় নষ্ট করলাম এজন্য ক্ষমা করিও। তোমার সু-স্বাস্থ্য  কামনা  করি-ইতি
তেমারই
                                                                                                                   সীমা
শিমুল জোহরের নামাজ আদায় শেষে দুপুরের খাবার খেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফুটন্ত গোলাপ বইটি পড়ছে। এমন সময় গেটে কলিং বেল বাজল। এসে দেখে সুমি ও তার সাথে একজন মেয়ে। কীরে সুমি হঠাৎ এভাবে না বলে চলে এলে! আয় ভিতরে বস। সুমি এখন বসব না অন্যদিন আসব। এই তোর বান্ধবী চিঠি। শিমুল বান্ধবী মানে? সুমি কেন তোর মনের মানুষ। পড়লে সব জানতে পারবে। আমি আসি কাল ভার্সিটিতে দেখা হবে।
সুমি একজন মেহমানকে নিয়ে এসে এভাবে চলে যাবে তা কী করে হয়। শিমুল আজ সময় নাই অন্যদিন না হয় এসে খেয়ে যাব। শিমুল পত্রটি পড়ল। পত্র পড়ে যেমন আনন্দিত; তেমনি নারভাস হল। কারণ সে গরীব ঘরের সন্তান। পত্রটি পরে মাথা নিচে রেখে দিল। আবারও গল্পের বই পড়তে লাগল। বইয়ে মন বসে না। ভাবছে এখন কী করবে। তার পরও দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। ঘড়ি দেখল এখন বিকাল গড়িয়ে গেছে। টিউশনি সময় প্রায় শেষ। আবিদের মা বলল; ভাবছি আপনি আসবেন না। শিমুল আজ শরীরটা ভাল নাই। তাই দেরি হয়ে গেল। মেসে ফিরে এশার নামাজ আদায় করে পড়তে বসল।
ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে জেগে শিমুল অজু করে ফজরের নামাজ আদায় করে পড়তে বসল। আজ কেমন যেন তাকে বেশ ফুর্তি লাগছে। সকালে টিউশনীটা সেরে গোসল করে কাপড় পরে ভার্সিটির দিকে রওনা হলো। পথিমধ্যে একটি মাঝ বয়সের ছেলে বকুল ফুলের মালা বিক্রি করছে। শিমুলের মালা গুলির ওপর বড্ড লোভ হলো। তাই সে পাঁচ টাকা দিয়ে তার বান্ধবীর জন্য একটি মালা কিনে পকেটে রাখল। আর চলতে-চলতে ভাবতে লাগল কিভাবে তাকে পড়িয়ে দেবে। কখনো ভাবে; না সে যদি কিছু বলে। এই কথা ভাবতে না ভাবতেই ভার্সিটিতে পৌঁছে গেল। বিজ্ঞান বিভাগের দিকে তাকিয়ে দেখল সুমি ও সীমা বেশ আনন্দে গল্প করছে। বাংলা বিভাগে বই তাদের দিকে অগ্রসর  হতে দেখে সুজন এগিয়ে আসছে। সুজন একটু দুরে থাকতেই বলল কীরে তোর এত দেরী হল; নাকি অন্য কেউ আবার তোকে প্রেম নিবেদন করতে চাচ্ছে। দেখি তুই তো বেশ রিলাক্সে আছিস। দোস্ত আমি ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছি। সে জন্য ক্লাসের পড়া করতে বেশ দেরী হল। দোস্ত আমি বইগুলো ক্লাসে রাখি। ঝাউ গাছের নিচে যাব। কথার মুহুর্তেই বইগুলো রেখে এল। দুই বন্ধু মিলে গল্পের তালে তালে সেই দিকে অগ্রসর হতে লাগল। দুই বন্ধুকে দেখে সুমি ও সীমা একটু আড়াল হল। তারা ঝাউ গাছের নিচে পূর্ব দিকে মুখ করে বসল। দুই বন্ধু কোন আজগবী গল্প নিয়ে মেতে উঠেছে। এমন সময় সুমি পিছন থেকে এসে সুজনের চোখ বন্ধ করে ধরল। খানিক পরে সীমাও এসে পার্শ্বে বসল। এরমাঝে সীমা বলল তোরা বস। আমরা একটু আসছি। সীমা মুছকি হেসে বলল দেরি করিস না। সুমি কেন ? তোকে কেউ নিয়ে পলাবে..? এই তোর ... জন পার্শ্বে আছে। শিমুল কথাটা লাজুক বোধ করে হাসল। এবার সীমা বলল; বেশ কয়েকদিন তো দেখেনি শুনেছি খালা আম্মার অসুখ ছিল। শিমুল জি। সীমার দিকে তাকিয়ে বলল; হঠাৎ এত আপন করে কারণ? সীমা মানুষ তো সবাই সমান। তাছাড়া গরীবদের আছে একটা মহৎ মন। আপনি কেমন আছেন। আপনি কোন চিঠি পায়ছেন? শিমুল পাইছি; কেন ডাকছেন। খালা আম্মার অসুখ কেমন। শিমুল আমি তো সুস্থ দেখে এসেছি। তবে রেখে আসার পর আর কোন সংবাদ পাইনি। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে...আহ!. বান্ধবীকে আবার লাগে, শুনছি আমাকে ....লেগেছে। ভাল লাগলে কী সব সম্ভব। তোমার বাবা বিদেশে বড় কোম্পানিতে আছে। তাছাড়া মাষ্টার্সের পর পি,এইচ,ডি করতে বিদেশে যাবে। সীমা.. না..না  আমি যাবনা। মায়াবি ছলনায় আবদ্ধ হয়ে রাজি হল। আজ থেকে দুজন একান্ত আপনজন। এবার শিমুল বলল; তোমার জন্য ছোট একখানা উপহার। অনুমতি দিলে গলায় পড়ায়।  সীমা হাসি মুখে তার উপহারটি গ্রহণ করল। আর বলল; তুমি সত্যিই আমার। একটু পরেই সুজন ও সুমি কাছে আসতেই সুজন বলল; আজ তোমাকে বেশ মনে হচ্ছে। দোস্ত সব হয়েছে তো। শিমুল সব মানে....সুমি করতালি দিয়ে বাহ! বাহ! মাছ মেরে শরীরে কাঁদা লাগাতে ভয় পায়। ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। আমরা সব দেখেছি। চল এখন ক্লাসে যাই।
সেই দিনের পর একজন ক্লাসে না আসলে; অপরজন খোঁজ খবর নেয়। এভাবে তাদের ভালোবাসা গভীরে পৌঁছে। শেষ হয়ে আসে তাদের ভার্সিটি জীবন। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে সবাই মহাব্যস্ত। কিন্তু শিমুলের মনে কী যেন, হানা দিবে। তখন তার কী হবে..? পরীক্ষার মাত্র কয়েকদিন বাকী। আজ সকালেই একখান টেলিগ্রাম- Shimul, Your Mother Sriously, So You Will Come Tommorow - Yours - Mational Uncle.
টেলীগ্রাম পাওয়ার পরে শিমুলের সবকিছু যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। যা এরই ফাঁকে ছোট এক টুকরা কাগজে লিখে-সুজনের হাতে দিলে বলল সীমাকে দিস। আমি চলে গেলাম।
প্রিয় সীমা,
পত্রে আমার ভালবাসা নিও। আমি বাড়ি যাচ্ছি। আজ মায়ের অসুস্থতার টেলিগ্রাফ পেয়েছি। শুনলাম মা আমাকে খুঁজছে। জানিনা আমার ভাগ্যে কী ঘটেছে। মায়ের দেখা পাব কি না?  তাই তোমাকে না জানিয়ে গেলাম। মায়ের ভালো মন্দ দেখে পরে ফিরব। তোমার পরীক্ষা ভাল হোক- এই কামনা করি। সাক্ষাতে কথা হবে।
তোমার জন্য শুভ কামনা  
ইতি-শিমুল
সুজন পরের দিন সীমার কাছে পত্রটি পৌঁছে দিল। সীমা পত্র পড়ে ভিষন টেনশন বোধ করছে।  শিমুল বাড়ি হতে ফিরলে সব জানা যাবে। এখন বিজ্ঞান স্যারের ক্লাস। সীমা আনমনা ভাবে বাইরে ঘুরছে। স্যার ক্লাসে ঢুকবে দেখে সীমাও সীটে গিয়ে বসল। কিন্তু স্যারের লেকচারের প্রতি তার মনোযোগ নাই। কী যেন ভাবছে। হরিণের মত তীক্ষè চোখ দিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। তার মন থেকে কী যেন হারিয়ে গেছে। ক্লাস শেষে সরাসরি একটি রিক্সাপুলার ডেকে বলল; গুলিস্তান মোড়ে চলো। বাসায় ঢুকে বইগুলো রেখে বিছায় শুয়ে পড়ল। কাজের ঝিয়ে আপা আপনার কী হইছে। আজ কেমন যেন লাগছে ? মুখের ঠোট শুকায়ে গেছে। আপা, আমি না হয় খালা আম্মারে টেলিফোন করি। একটু হেসে কই না তো কিছু হয়নি। যা তুই তোর কাজ কর। সীমা প্রতি দিবসে তাদের ছাদের উপর থেকে মায়ের কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে চেয়ে থাকে। আর যখন মা গেটে আসে, তখনই সাইট ব্যাগটা নিয়ে মা’কে বলে তেমার কলেজ কখন ছুটি হয়েছে।  আর একটু দেরি হলেই বলত, মা আজ এত দেরি কেন? কিন্তু আজ তার মা ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখে সীমা নাই। ভিতরে ঢুকেই কাজের বুয়াকে বলল সীমা বাড়িতে আসেনি। ঝীয়ে আসছে খালা; তো আপার মনটা কেমন যানি। অধ্যাপিকা সাহেব ঘরে ঢুকে দেখে সীমা একটা বই বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। আজ যেন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। কিন্তু তাকে কিছু বলতে যেন দ্বিধা হচ্ছে। কারণ মেয়ে এখন সাবালিকা। তাছাড়া সে অনার্স পরীক্ষা দিবে। তারপরও কাপড় পাল্টিয়ে সীমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জিঙ্গাসা করল। আজ তোমাকে ছাদে না দেখে ঘুমাতে দেখছি। কারন কি মা। তোর কি হয়েছে। মুছকি হেসে কই নাতো আমার কিছুই হয়নি। মা তাকে পাশে নিয়ে বলল; শোন তোমার আব্বা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে তোর পরীক্ষার ফলাফল ভাল হলে; তোকে বিদেশে সাথে নিয়ে যাবে। বিদেশে পি,এইচ,ডি, করাবে। প্রয়োজনে আমাদের সবাইকে সিফট করবে। সীমার টেনশন আরও বেড়ে গেল। সে শিমুলকে ফেলে কীভাবে বিদেশে গিয়ে পি,এইচ,ডি করি। তার পরও বলল, আছে মা, আমার পরীক্ষার ফলাফল ভাল হোক। তার পর না হয় সিদ্ধান্ত নিব। শোন মা আমাদের দেশের ভার্সিটিগুলোর মান তেমন ভাল না। সেই দিন থেকে সীমা নিশ্চিত। সে ভাবে শিমুলের কথা ভেবে বাবা-মায়ের স্বপ্নকে নিরাশ করা যাবে না। মনে মনে ভাবে যদি রেজাল্টের পর আব্বা বিদেশে নিলে চলে যাব।
শিমুল বাড়িতে পৌঁছে দেখে মা শয্যাশাহী। মাথার পাশে ছোট মেয়ে স্বপ্না আর গ্রামের এক চাচা চেয়ারে বসে আছে। তোমার মাকে আর ফেরাতে পারবনা শিমুুল। চল অজু করে দোয়া করি। শিমুল কান্না কণ্ঠে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল; মা তুমি আর আমাকে শিমুল বাবা বলে ডাকবে না; ওমা ডাকবে না। আমি এসে গেছি। চাচা আমার এ কী দূর্ভাগ্য আমার মায়ের বাক শক্তি হারিয়ে গেছে। মা শুধু চোখ মেলে শিমুলের দিকে তাকায়। শিমুল দেখে মায়ের চোখে পানির বন্যা বইছে। চাচা এসে তাকে মায়ের কাছ থেকে সরায়ে নিল। আর বলল, বাবা শোন দুনিয়াতে আমরা কেহই চিরদিন থাকব না। চল এখন দোয়া কবুলের সময়। ততক্ষন স্বপ্না ও তোমার চাচী বসে থাকবে।

বাড়ির পাশের মসজিদ থেকে এসে দেখে মায়ের চোখ থেকে এখনো অশ্রু ঝরছে। সে এবার কাঁদতে শুরু করল। একটু পরেই মা হাফ ছেড়ে চিরতরে দুনিয়া থেকে বিদায় নিল। এই দুনিয়ায় আর আপন কেউ নাই বলে শিমুল জ্ঞান হারাল। মাঝে মাঝে মা, মা বলে চিৎকার করে।
শিমুল এখন নিঃসঙ্গ। কেমন করে চলে ফেরা করে।  মনে হয় খাওয়া নেওয়ার প্রতি তার কোন খেয়াল নাই। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে মায়ের কবর জিয়ারত করে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে গোরস্থানে যায়। প্রতিবেশী লোকেরা দেখে ভাবে ছেলেটি যেন মা মরার শোকে পাগল হয়েছে। কাউকে দেখলে বলে, আমি ভুল করেছি।  তাই মা, আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এভাবে কয়েক মাস যাবার পর একদিন রাতে মা স্বপ্নে বলল বাবা তোমার প্রতি রাগ করিনি। দুনিয়া ক্ষনস্থায়ী। দুনিয়ায় কেউ চিরদিন বেঁচে থাকবে না। বাবা তুমি একদিনের মধ্যে মেসে ফিরে যাবে। তুমি ভালো ভাবে লেখা-পড়া কর। আমার আত্ম তাতে শান্তি পাবে। হঠাৎ করে শিমুল ঘুম থেকে জেগে অনেকটা বদলে গেল। আর ভাবল সে যা দেখল তা কী বাস্তব। তাই সে মনোস্থ করল মায়ের আদেশ তাকে পালন করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিল মেসে যাবে। পরের দিন চাচার সাথে দেখা করে মেসে চলে গেলো। সে রওয়ানা হয়ে ভাবে মেসে ফিরার দিন গাড়িতে তুলে দিত। পথ চেয়ে থাকত, আর বলত বাবা তুমি ভাল ভাবে পড়াশোনা করবে। কারো সাথে কোন বিশৃঙ্খলা করবে না। এই কল্পনার মধ্যেই গাড়ি মেসের সামনে পৌছাল। শিমুল তার মেসে রুমের গেট খোলার পর দরজার পাশে একখানা চিঠির খাম দেখল। হাতে তুলে দেখল প্রেরক সীমা।

শিমুল,
পত্রে আমার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা নিও। আশা করি তুমি বাড়িতেই তোমার মা কে নিয়ে ভাল আছ। শীত ঋতুতে ফুটন্ত যত ফুল, সমস্ত ফুলের একগুচ্ছ পাপড়ি দিয়ে তোমাকে জানাই ভালোবাসার শুভেচ্ছা। শিমুল, আব্বার একখানা পত্র পেয়েছে মা। আব্বা আদের বিদেশে নিয়ে যাবে। সেখানে আমাকে ভার্সিটিতে পড়াবে। তো যাই হোক তোমার সাথে ভার্সিটিতে দেখা হলো না। এটাই বিদায় শুভেচ্ছা। প্রতি মাসে চিঠি লিখবে। তুমি ভাল থেকো এই কামনা করি। ইতি- সীমা

চিঠি পড়ে নির্বাগ হয়ে গেল।  একদিকে মায়ের যন্ত্রনা ভুলতে না; ভুলতেই পরম পরশ পাওয়া বান্ধবীও ছেড়ে চলে গেলো। এ যেন কোন পুতুল খেলার ছলনা। খনিকে সব চুরমার করে ভেঙ্গে গেল কাঙ্খিত জীবনের স্বপ্নগুলো। #  (একুশে বইমেলা ২০২০ আমার প্রকাশিত ‘‘ স্বপ্নঘেরা’’)