একদা স্টেশনে বসে আছি,
ট্রেনের অপেক্ষায় থেকে থেকে একের পর এক চুরুট পুড়ছি।
এদের ধোঁয়া ফুসফুসে গিয়ে পৌঁছোতেই
যকৃতের পীড়ার মতন কেমন যেন চিন্তার উদ্রেক করছে!

বোধ করি ঘরে ফেরার ইচ্ছেটি আমার
অচিরেই মরে যাচ্ছে, মরবে না কেনইবা?
ঋণ যখন চক্রবৃদ্ধি সুদের হারে দ্বিগুণ,
মরণের চেয়ে এই বেঁচে থাকার যন্ত্রণা হয়ে উঠে করুণ।  
এমন অবস্থায় ফাঁকা পকেটে বাড়ি যাবো?
প্রত্যহ দুয়ার খুলেই কুসীদজীবীদের জল্লাদের মতো মুখ দেখার সাহস পাচ্ছি না।

এসব উৎকণ্ঠা মগজ গলিয়ে আনছে,
অর্থ প্রাপ্তির দু:শ্চিন্তা বড় উদ্ববিগ্ন করে তুলছে।
তবু যেতে হবে, সকলের-ই যেতে হয়;
কে হায় পরবাসীর মতো দূর-শহরে কর্মস্থলে থেকে থেকে শরীর করিতে চায় ক্ষয়?
সবারি কর্ম, পূজা, অনিদ্রা ও পাপপুণ্যের আয়াসী জীবন থেকে ছুটি চায়, চায় সব ভুলে একদিন প্রেমিকার কোলে ঘুমোবার মতো দুদণ্ড অবসর।

একে অধিকার করো হে বঞ্চিত, দ্বিধার পদ-দুটি  সমুখে বাড়াও।
এসো হাত ধরো পলাতক, জীবন লজ্জাজনক
তুমি উদগ্র উন্মাদ- বেহায়া হতে দোষ কি আর?
এসো হাত ধরো গৃহবিমুখ, চলো বাড়ি যাই।
প্রাক্তন স্বদেশ চেয়ে আছে, দ্বিধায় ভুলনা পথ।
ওহে পলাতক, বাহনের বিলম্ব ঢের
তবু যে আসবার সে আসবেই, প্রতীক্ষা যদিও ক্লান্তিকর;
তবু প্রত্যাখ্যানের চেয়ে প্রত্যাশা বেশ প্রশান্তিকর।

ভেতরের আমিটিকে এমনতর তাড়া দিতে দিতে
ভাবছি সব দোষ ট্রেনের, ট্রেনটা অন্তত
সময়মতো এলে এত্তসব দুঃশ্চিতার অবকাশ হতো না।
রাত্রি পনেবারোটার বাহন, এখন বাজে সোয়া তিনটে;
বিলম্ব পেরিয়ে বিরাট বিলম্বে ঝুলছি, ট্রেন আসছে না।
এবার চায়ের পেয়ালায় প্রেমিকার ঠোঁটের মতো আলতো করে চুমু খেয়ে,
অপেক্ষাতুর যাত্রীর মতন চুপচাপ বসে আছি।

হঠাৎই কানে আসল- 'সেদ্ধডিম সেদ্ধডিম, এক-
জটিল চেহারার মধ্যবয়সী মহিলার মর্মছেঁড়া ডাক;
জীবন বিবর্তনের সহজাত যন্ত্রণা মিশে আছে তার স্বরে, চোখে যেন কত কালের ব্যথা আহা উঠছে টলমল করে।
তবু কি প্রোজ্জ্বল হাস্যমুখে এস্ত এসে ফু দেয়
গরম ডিমের উচ্ছিষ্ট পতিত কঙ্কালে!
যেন জীবনের কাছে কোন অভিযোগ নেই তাদের,
বরং খেটেখুটে খেয়ে-পরে বাঁচার প্রেরণা রয়েছে ঢের।

ভাবতে-ভাবতেই চোখদুটি কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো।
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ নিহত হয়ে থাকতে চাইলাম,
সেই মুহুর্তে এক বিদঘুটে চেহারার বালক চা-চা করে চেচিয়ে
আস্ত একটা মৃত্যু ভেঙে দিয়ে কানের পাশ দিয়ে চলে গেলো।
বেটাকে নজর-সেলামি দেওয়ার জন্য তৎক্ষণাৎ মুণ্ডু ঘোরাতেই দেখি;

অদূরে ল্যাম্প লাইটের আলোতে নৈশভোজ সেরে,
একদল নাম-পরিচয়হীন শিশুরা যে যার মতো করে
ঘুমের তাড়না নিয়ে শুয়ে পড়ছে এককোণে।
তবু কি ঘুম তাদের আসবে, কানের কাছে মশাদের গানে?
হয়তো আসতেও পারে হয়তোবা আসবে না তবুও প্রতিদিনের অভ্যস্ততায়,
কুয়াশায় কেঁপে কেঁপে সারারাত বেহুশের মতো পড়ে রবে- অন্ধকার নির্জনতায়;
যেমন ভিখারিনীর কোলে তার অনাহারী শিশুটি ঘুমায়,
শুশ্রূষার কেউ নেই; দাতারা দেখেও ঈশ্বরের মতো নির্লজ্জতায় ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে যায়।