দুঃস্বপ্নের ঘোর
হঠাৎ একবার মনে হলো
প্রশ্নটা পৃথিবীকে করি;
কেমন আছো?
যদিও এ মুহূর্তে এমন প্রশ্ন করা বাতুলতা।
তারপরও শত দ্বিধা সংকোচ ভেঙে
জিজ্ঞেস করলাম পৃথিবীকে, কেমন আছো?
প্রথমত সে সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশে
রক্তিম দিগন্ত রেখায়
বাঁকা ঠোঁটে
ক্রুড় হেসে থেমে রইলেন কিছুক্ষণ!
আমি কিছুটা অবাক হলাম তাতে।
পুনর্বার জিজ্ঞেস করলে বললেন,
ভালো আছি বটে।
আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম
ধরিত্রি মাতা পৃথিবীর দিকে
বললাম, তুমি না মা!
তুমি ভালো আছো?
পৃথিবী আবার হাসলেন
বললেন, ভালো আছি বটে।
অশ্রুতে সিক্ত নয়নে কপোলে
আরেকবার তাকালাম
পৃথিবীর দিকে
কি বলছো পৃথিবী?
তুমি কি সত্যিই ভালো আছো? ধরিত্রী মাতা?
পৃথিবী আবারো বললেন, কেনো নয় বৎসে?
তোমার সন্তানরা আজ কর্মহীন অলস
নিরন্তর মৃত্যুর মিছিলে।
তোমার পৃথিবীর সব প্রাণ চঞ্চলতা বন্ধ
প্লেন, ট্রেন, গাড়ি, লরি
কল, মল, সব।
মসজিদ, মন্দির,
গির্জা, প্যাগোডা, সিনাগগ বন্ধ।
পৃথিবীর সকল উপসনালয়ে
লটকে আছে তালা, তুমি জানো না?
তোমার সভ্যতার চাবিকাঠি
সকল কল কারখানা বন্ধ
উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে লাগাতার
মাঠ ঘাট সমুদ্র সমতট
কৃষি ব্যবসা বানিজ্য সব স্থবির হয়ে পড়ে আছে।
প্রতিদিন অগনিত মানুষ প্রহর গুণছে মৃত্যুর
এক অনুজীব অদৃশ্য শক্তির ছোবলে।
তোমার বুক চিড়ে রোপিত হচ্ছে
অগুণন মৃতদেহ।
প্রত্যহ তোমার সন্তানদের
শব অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে
তোমারি বুকে,
তোমার ঘুর্ণায়মাণ ডিম্বাকৃতির
নিষ্কন্টক শরীর জুড়ে এখন একটাই শব্দ
"লক ডাউন"।
এশিয়া থেকে ইউরোপ,
আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া
বিস্তৃত কারাবাসে মানুষ
ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
নিষ্পলক ক্ষণ গণনা করেছে মৃত্যুর,
টের পাচ্ছো না?
তোমার যে বীর সন্তানরা
সহস্রাব্দ ধরে
পরম ভালোবাসায় সাজিয়েছে বিশ্বমাতাকে
তোমাকে যন্ত্রে শকটে অভাবনীয় সভ্যতায়
গড়ে তুলেছে বিশ্ব মানবতা,
তোমার সেই সন্তান
বিশ্ব মানবকুলের এই নিধনযজ্ঞে
সামান্য উদ্বিগ্ন নও তুমি?
স্বার্থপর, রাক্ষুসে, কপট
ধরিত্রী মাতা!
পৃথিবী আবারো হাসলেন
ক্রুড় হাসি,
আমাকে সভ্য করেছো?
না দগ্ধ করছো প্রতিদিন,
আমার সবুজ বননীর পত্রপুষ্পময় বৃক্ষরাজির
মেঘরঙ শাড়ি খুলে
কতো কতোবার বিবস্ত্র করেছো মনে আছে?
কতোবার লুট করেছো ধনরত্ন, আমার সম্ভার;
ধর্ষণ করেছো গর্ভধারিনী, মাতৃময়ী
ধরিত্রী মাতাকে?
পৃষ্ঠ থেকে আকাশ অবধি।
আমার হৃদপিণ্ড সবুজ আচ্ছাদন
অ্যামাজনকেও তোমরা বিবস্ত্র করেছো
পুড়েছো চরম নিষ্ঠুরতায়।
তোমাদের যান্ত্রিক সভ্যতা
প্রতিনিয়তই ঊর্ণনাভের মতো
কুড়েকুড়ে খেয়েছে আমার ফুসফুস।
তোমরা আমার পরিবেশ বিঘ্নিত করে
জলবায়ু উৎসব করো।
অথচ কারখানার বর্জ নিষ্কাশন ও
অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের নামে
আমার মৎসকুল এবং
জলরাশিকে করে তুলেছো বিপন্ন।
এখনো যুদ্ধ করো দেশে দেশে,
জাতিতে জাতিতে
ধর্মের নামে বিভেদ আর
আর্থিক করাল থাবার গ্রাসে।
তোমরা সভ্য হলে
ঘরে ঘরে দেশে দেশে আজো
যুদ্ধ আর ক্ষুধায় কেনো
মানুষ মরে বলো?
আজও কেনো মানুষ হয়ে
মানুষকে হত্যার জন্যে অস্ত্র বানাও?
পরপর দু'টি বিশ্বযুদ্ধ গেলো;
হিরোসিমা নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞের পরও
পরমানু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব হয়নি তোমাদের।
বরং আমার প্রকৃতিকে ধংস করে
করে তুলেছো নগরের পর নগরায়ণ
আমার বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়েছো বিষ।
স্তরে স্তরে ফাটল
আমার রূপ মাধুর্যকে করে দিয়েছো
ধ্বংসস্তুপের ভাগাড়।
আজ তোমরা গৃহবন্দি
তোমাদের নিষ্ঠুর অভিশাপ থেকে মুক্ত প্রকৃতি
এখন তার আঁচল মেলেছে
বসন্ত হাওয়ায়
সমুদ্রের জলরাশি
বিস্তৃত হচ্ছে,
মাছগুলো খেলা করছে যে যার ঢংয়ে।
নিস্তব্ধ নগর জুড়ে এখন চলছে
পরিযায়ী পাখিদের উৎসব।
হঠাৎ রাত হলো-
সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে
খেলা করতে থাকলো একখানা টগবগে চাঁদ
পর্যটকহীন চৈত্রের মৃদুল হাওয়ায়
যেনো আনমনে খেলছে আর কথা বলছে
ঢেউয়ের মাদলে।
শ্যামল আলোর বসন্ত বিজন রাতে
উড্ডয়মান ঊর্মির সাথে
রাত্রিকালীন উৎসবে আছে
কয়েকটি হাঙর।
ঘুমঘুম নিস্তরঙ্গে
বাতাসের মিহিমিহি শব্দের মতো
কে যেনো কানে কানে বলে গেলো
বিশ্বময় মানবিক বিপর্যয়ের কথা
আর বলে গেলো,
দেখো! দেখো! পৃথিবীতো এখন এক যৌবনবতী নারী,
তার সর্বাঙ্গে ঐ কুন্তলিত প্রকৃতির নব নব সাজ
দেহ সৌষ্ঠবে অমরাবতী চির হরিৎ কুঞ্জ বনের খেলা।
সবুজ আবরণ জুড়ে রংবেরং পুষ্পময় আভরন
সজ্জিত পৃথিবী এখন
কোনো এক সুবৃহৎ নক্ষত্রের প্রেমাবসে
ভুলে গেছে পাপক্লিষ্ট মানবের কথা।
অতএব, লক্ষকোটি বছর পরে
কোনো এক প্রত্নতাত্ত্বিক কপালের ঘাম মুছে
এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে
হ্যাঁ, তাদেরই সমগোত্রীয় কোনো এক প্রজাতি
একদিন এই পৃথিবীতে ছিলো।
হয়তোবা, তেমনি হবে!
তেমনি হবে একদিন!!
-মাসুদ আলম বাবুল
১৭.৪.২০ পটুয়াখালী।