শেষ দেখা হয়েছিল ঘাম ঝরা দুপুরে,
সেও বছর ছয়েক আগে।
মাথার উপর সূর্য রেখে, গায়ের মেঠো পথ ঠেলে
প্যাডেলে পা লাগিয়ে
আমার দিকে এগিয়ে আসছে এক জোয়ান।
আমি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে,
আমার ঠিক একটু দূরে প্যাডেল ঘোরা থেমে গেল।
ধূসর এক অবয়ব!
পরিচিত কণ্ঠস্বর জড়তা নিয়ে বলল-
“বন্ধু, কেমন আছ?”
তাগরা জোয়ানের ঘাম বুকে জড়িয়ে বললাম-
“আমি ভাল আছি, তোর এ অবস্থা কেন?”
আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে বলল-
“এমনই তো হবার কথা ছিল।
তুমি ভাল আছ নিশ্চয়ই?”
কেমন আছি? গিলে ফেললাম উত্তরটা!
ও আমাকে তুই করেই বলতো।
সময়ের ব্যবধানে আজ তুই পৌঁছেছে তুমিতে।
‘তুমি’ এর মাঝে খুঁজে পেলাম অপ্রকাশিত এক দীর্ঘশ্বাস।
সাজু, আমার বন্ধু।
ঠিক বন্ধু না, হারিয়ে যাওয়া বন্ধু।
আমি ওকে স্বেচ্ছায় হারিয়ে ফেলেছি।
আমার কি সময় আছে পেছনে ফিরে তাকাবার!
আজ আমি শহর চোষে বেড়াই,
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাচ ঘেরা রুমে
গদি চেয়ারে পায়ের পর পা রেখে স্বপ্ন আঁকি।
আমাকে টপকিয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ায়,
বড় হয়ে প্রতিশোধ নেব বলে ঠিক করেছিলাম।
ক্লাসে আমাকে হারিয়ে দেওয়া বন্ধুটিই কিনা
রোদে পুরে মেঠোপথে প্যাডেল ঠেলে
জীবনের চাকা ঘোরাচ্ছে।
ওর জীবনেও রাত আসে,
তবে সেটা লাল, নীল রঙে
রাঙানো কোন রাত নয় নিশ্চয়ই!!
বিদঘুটে কালো অন্ধকার থাকে পুরো রাত জুড়ে।
ভাল ছবি আঁকিয়ে ছিল;
একবার আমাকে এঁকে দিয়েছিল,
ভাবী এক সংসারের জীবন্ত গল্প।
ছবিটা দেখে কিশোর মন ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।
পরে জানলাম এটা ওর সংসারের গল্প।
খুঁড়িয়ে চলা বাবার
খুঁড়িয়ে চলা সংসারের গল্প।
তার পরের অধ্যায়টা ধোয়াশে।
সমাজ ওকে ঠেলে দিয়েছে অন্ধ কুঠরে,
জীবন খেলেছে পাশা আপন মনে।
আর আমিও স্বার্থপরের মতো ভুলে গেছি ওকে,
আমার কি দোষ?
ভুলে যেতে হয় বলেই ভুলে যাওয়া!!
হঠাৎ টুংটাং বেলের শব্দ,
প্যাডেলে পা লাগিয়ে এগিয়ে চলল।
যেতে যেতে আমাকে বলল-
“বন্ধু, আসি। ভালো থেকো”।
আমাকে পেরিয়ে সা সা করে চলল,
টুংটাং শব্দ ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল,
চোখের সামনে আবার হারালো
হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটি।
আমি তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে।
কানে তখনো বাজছিল-
“বন্ধু, আসি। ভালো থেকো”।
কোন কিছুই বলতে পারিনি প্রতিউত্তরে,
শুধু নিজের অজান্তেই বলে গেলাম-
আমিতো ভালোই আছি।
ভালোই আছি!!