‘রেবতি, আজ আমায় ইলিশ-পোলাও রেঁধে দিবে?
কবে যে খেয়েছি? জিব ভিজে যায় মায়ের হাতের সোয়াদে।’
‘রেসাদ, তুমি বড্ড ভুলোমন হয়ে গেছো ইদানিং
মনে পড়ে? ক’দিন আগেই না ঘটা করে খেলে!’
‘কী জানি! তোমার কথাই বোধ করি সঠিক,
আজকাল আর মনে রাখতে পারি না। সবই যেন বেঠিক।’
‘এমন করে কেন বলছ রেসাদ? সবতো ঠিকই আছে।
আমরা সুখে-দুঃখে আছি, ছন্দময় জীবনের ভাঁজে ভাঁজে।’
‘তাই কি? ওহে কুঞ্জবিহারিণী-
তুমি কি দেখছো না! কত কিছু ভুলে গেছি দিবা-যামিনী।’
‘আচ্ছা তবে, আমায় বলো প্রিয়তম
কী কী ভুলেছো তুহু মম।’
‘কেন! দেখনি আজ প্রভাতে
ধবল তুষারে গিয়েছে ভরি, সূর্য ঐ তফাতে।’
‘তুষার! বলি, শীতের সকালে এতো রোজই হয়
খুব বেশী অবাক হবার নয়!’
‘সে জন্যই তো বলছি,
হেথা নেই লাল, সবুজের বিষম আকাল
দুধের চাদরে শায়িত প্রকৃতি সফেদে নাকাল।’
‘আচ্ছা, বরফের পাঁজাধরা আছে মানলাম,
তো ভুলভালের ব্যপারটা যে না-বুঝলাম।’
‘আহা, বোঝনি! ভুলে গেছি সবুজ রঙ, গাঢ়
রক্তিম লালের মিশ্রণে জেগে উঠা
দিগন্ত ফোঁড়া উদ্ধত নিশানের গর্জে উঠা,
রেবতি, কতদিন সবুজ দেখি না, লালও না, আমি
আমি ভুলে গেছি প্রিয়।’
‘আহারে! এই যে দেখ, লাল-সবুজের রঙে ভরে
বিছানো আঁচল আমার পুরো দেহজুড়ে।
আমিই লাল, আমিই সবুজ
তোমাকে কে ভুলতে দেয় রঙের অবুঝ?’
‘সে তুমি পার রেবতি,
মায়ের হাতের গুড়ের পায়েশ
তুমিই ভুলতে দেও না আয়েশ।’
‘রেসাদ, ও আমার প্রিয় মাঝি
তবু তুমি কেন আনমনা, বিহ্বল আজি?’
‘দেখ না, সেই তুষারে
ছেয়ে গেছে দু’কূল, রয়েছি পাথারে।’
‘ওহ, আবার তুষার!
বলেছি তখন, এতো শীতের কমনীয় উপহার।’
‘ইশ! কতদিন নদী দেখি না
বহমান তটিনীর কুলকুল ছন্দ গায়ে মাখি না।
দেখিনা কলসি কাখে যুবতীর ভেজা শাড়ির ভাঁজ
দূরে টিমটিম পিদিম-জ্বলা নাওয়ে জেলেদের আদিম সাজ।’
‘আহা! শীতের ক’দিনইতো
দেখবে আবার জলের প্রবাহ নিত্যদিন
ছন্দে ছন্দে আকূল করবে তোমায় নিশিদিন।’
‘তাই কি হয়?
কলাগাছের ভেলা বানিয়ে ভেসে রয়।
শতছিন্ন পাল তোলা নৌকায়
লাল বেনারসী গায়ে অচেনা গাঁয়ের বধু যায়।
রেবতি, আমি আর নদী চিনি না, আমি
আমি ভুলে গেছি প্রিয়।’
‘আহারে! পড়নি কবিতায়
প্রকৃতির ছায়ায় নদী ও নারী এক হয়ে যায়।
এই বুকে রাখ মাথা, শুনতে পাবে নদীর ছন্দ-কথা।
ওপারের কাশবনও যদি দেখতে চাও
আমার চোখে ভাল করে তাকাও।
আমিই নদী, আমিই ছন্দ
আমিই দূর করে দিব সে দ্বন্দ্ব?’
‘সে তুমি পার রেবতি,
যমুনার সবটুকু কুলকুল বক্ষে ধরে
আবেশিত করে ফেল ছন্দের মায়াজালে।’
‘রেসাদ, ও আমার প্রিয় রাখাল
আনমনে থেক না গো, ছড়িয়ে আথাল।’
‘কী করব বলো?
এই তুষারেই যে সর্বনাশ হলো।’
‘উফ! তুষারে আবার কী হলো?
শুভ্র বসনের কমনীয়তা তোমায় কী করলো?’
‘দেখ না, চারিদিকে পত্রহীন বৃক্ষরাজি
বরফের ভারে যেন নুয়ে নুয়ে পড়ি।’
‘এতো শীতের এই সময়টুকুই
আবার সবুজে সবুজে উঠবে ভরি, কাননে কুসম-কলি।’
‘ইশ! কতদিন পাখি দেখি না
দেখি না দোয়েলের সাদা-কালো শরীরে চঞ্চলা স্বভাব
শালিকের ঝাঁক দেখে ভাগ্য গণনার অভাব।
মাছরাঙার সরু ঠোঁটে মাছ দেখি না কতদিন
দেখি না টিয়েদের সবুজ, সাদা বকের শান্ত-সৌম্য ভাব।’
‘একটু অপেক্ষা কর প্রিয়। শীত চলে যাবে
পাখিরা ফিরে আসবে
ফোটাবে ইন্দ্রধনু রঙের বাসরে।’
‘তা কি আর হবে?
পাইন বৃক্ষে কি ফজলি আম ফলবে?
ফারের সারিতে কোথায় আছে আমার চালতার টক?
কোথায় মিলবে কাঠালের রসালো মিষ্টি
আমলকি-লটকনের ঔষধীয় সৃষ্টি।
রেবতি, আমি পাখি চিনি না আর, চিনি না ফলের বাহার, আমি
আমি ভুলে গেছি প্রিয়।’
‘আহারে! তুমি না বলো, আমিই তোমার পাখি
দুনিয়ার সবচেয়ে মধুর আমার আঁখি।’
‘সেতো সব সময় সত্যি রেবতি
তুমিই আমার তাজমহল মরণ-অবধি।’
‘পাখি দেখবে? তাকাও আমার হৃদয়-আকাশে
দেখ না, কত পাখি উড়ে, ডানা ঝাপটায় ভর-আবেশে
দোয়েল-কোয়েল-শ্যামা, হাত বাড়ালেই পাবে হেমা।’
‘সে আমি জানি,
পাখির কলকাকলী-ভরা, তোমার অন্তর-ছড়া।’
‘বড়ইয়ের টক চাও, পেয়ারার মিষ্ট-স্বাদ?
এসো রেসাদ, এই আমার নিমীলিত আঁখি,
ছোঁয়াও তোমার অধর-ওষ্ঠ রাখি
কম্পমান অধর-যুগলে রাজ্যের মাখামাখি।’
‘আহ! একটি স্বপ্ন, একটি দেশ, একটি কবিতা
সবই তোমাতে বিলীন, তোমাতেই বহতা।
তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ আমায়
স্মৃতির হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়
দেখো, ভুলিনি আর। চির অম্লান ধারায়।’
“আজি এই প্রভাতের ধবল সভায়
আমরা স্বপ্নাহত হতে আসিনি,
ভুলে যেতে আসিনি রক্তে নাচন দেয়া সুখ-স্মৃতি।
দীর্ঘশ্বাস ঝেড়ে, হাত-ধরাধরি করে দাপিয়ে সুখের কোণে
হৃদয় উজাড় করে মুগ্ধ হয়ে গাঁথিব
উদিত লাল-সবুজ, বহমান নদী, পাখির রঙ, ফলের স্বাদের গল্প
ভুলি নাই প্রিয়। কিছুই ভুলব না।”