বাংলা ভাষা-ভাষী গানের সাধারণ শ্রুতা বা কবিতার কম-সচেতন পাঠকদের মাঝে গযল নিয়ে এক ধরনের মিশ্র ধারণা প্রচলিত। সাধারণত উর্দু ভাষায় প্রেম-বিরহকে উপজীব্য করে রচিত বেদনা-বিধুর যে কোন কবিতা বা গানকে আমাদের এখানে গযল হিসেবে ধরে নেয়া হয়। আর ইসলামী ভাবধারার যে কোন গানকেই মনে করা হয় গযল। সে হিসেবে 'ইসলামী গান' আর 'গযল' যেন সমার্থক, আর তাই মনে করা হয়েছে কবি নজরুল বাংলা সাহিত্যে ‘গযল’ বা ‘ইসলামী গযল’ এর জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত বিষয় তা নয়।
গযল সনেট আঙ্গিকের প্রেম-উপজীব্য দার্শনিক কবিতা, যার পংক্তিগুলোতে বিরহ-বেদনার আমেজ প্রকট। তাই বলে সব প্রেম-বিরহ উপজীব্য ধীর লয়ের কবিতা বা গান মাত্রই গযল নয়। গযল রচনায় আঙ্গিক হিসেবে পাঁচটি বিষয় নিশ্চিত হতে হবে, আর তা হলো- মাৎলা, রাদিফ, কাফিয়া, বেড়, মাকতা। আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গযল হিসেবে আখ্যায়িত কবিতাগুলোও প্রকৃত অর্থে গযল-কবিতা বা গযল-গান নয়। নজরুল আঙ্গিক মেনে লিখেন নি, আর তিনি এমন দাবিও করেন নি। বরং উর্দু-ফার্সী গযলে ব্যবহৃত শব্দ, বিষয়, ভাব ও উপস্থাপনার অনুসরণে নির্মিত তাঁর কবিতাগুলোকে গযলের আবহে ভিন্ন সাধের 'নজরুলের কবিতা' বা ‘নজরুল সঙ্গীত’ বলাই যথার্থ হবে। একথা অনস্বীকার্য যে, ঐ কবিতাগুলো সৃষ্টি নৈপুন্যে বাংলা-সাহিত্যে যেমন অভিনব, অশ্রুতপূর্ব, তেমনি শিল্প মানেও অসামান্যতার দাবিদার। নজরুল কেন বিশুদ্ধ গযল লিখতে যাননি, সে এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন বটে। উর্দু-ফার্সীর ওস্তাদ শায়েরদের সমপর্যায়ের সার্থক-গযল রচনা করা তাঁর মতো প্রতিভার পক্ষেই সম্ভব ছিলো। এ-কথা প্রমাণিত তিনি উর্দু-ফার্সী গযলের নিটোল রস-সরোবরে সম্যক অবগাহন করেছিলেন। ‘রুবাইয়াৎ-ই-উমর খৈয়াম’-এর নজরুল কৃত বাংলা কাব্যানুবাদ এক্ষেত্রে বিরল দৃষ্টান্ত।
নজরুলেরও আগে গযল রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ অতুল প্রসাদ সেন, যিনি পেশায় ছিলেন বিলেত ফেরত ব্যারিষ্টার। লখনৌ ছিল কর্মস্থল। লখনৌতে বহুল চর্চিত উর্দু গযল ও ঠুমরি তাকে আকৃষ্ট করেছিল। অতুল গযল লিখেছেন, তবে তা সংখ্যায় ৫ থেকে ৮ টির বেশি নয়। সংখ্যায় কম হলেও, এবং আঙ্গিকে বিশুদ্ধ না হলেও, তার লেখা গযল বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
আবার নজরুল পরবর্তী কালে ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ ও মির্যা গালিবের ‘দীওয়ান-ই-গালিব’ এর সার্থক অনুবাদক কবি মনির উদ্দীন ইউসুফ গযলের আঙ্গিক মেনে বাংলা ভাষায় গযল রচনার প্রয়োজনীয়তা বিশেষ অনুভব করেছেন। প্রায় ৫২টির মতো গযল নিয়ে তার ‘বেতস পাতা জলের ধারা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় নভেম্বর, ১৯৮৪ সালে। প্রকাশক: কালান্তর প্রকাশনী, ঢাকা। কিন্তু উর্দু সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন কবি মনির উদ্দীন ইউসুফ, যিনি ‘উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থটি লিখেছেন, যিনি গযলের আঙ্গিক সম্পর্কে ছিলেন সম্যক অবগত, তিনিও তার রচনায় আঙ্গিকের যথার্থ প্রয়োগের ক্ষেত্রে, গযলের বাণীঢঙে বাকচাতুর্য ও ভাবগাম্ভীর্যতার প্রতি পূর্ণ সুবিচার করতে পারেন নি বলেই প্রতীয়মান হয়। নি:সন্দেহে ঢাকায় বাংলা গযল রচনায় একক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি কৃতিত্বের দাবিদার। প্রশংসিত হয়েছেনও। এ-কথা অনস্বীকার্য যে, যারাই বাংলায় গযল লিখেছেন, তারা ছিলেন নি:সঙ্গ পথিকের মতো। তাদের সামনে বাংলায় গযল রচনার না ভুরি ভুরি উদাহরণ ছিল, আর না ছিল গযল রচনার অনুকুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশ। এমন কি সে কালে গযল ধারার কাব্য-সমালোচনা করার মতো বাংলাভাষী সমালোচক কেউ ছিলেন কি-না এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। মনে হয়েছে, যারা প্রশংসা করেছেন, তারা কিছু না বুঝেই প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছেন।
গযল হলো কম পক্ষে ৬ বা ততোধিক শের সম্বলিত গীত-বান্ধব কবিতা। প্রতিটি দুই লাইন একটি শের হিসেবে গণ্য। প্রতিটি শের নিজস্ব ভাব ও বাকচাতুর্যে দেদীপ্য, কিন্তু কেন্দ্রীয় ভাব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। মাকতা বা সর্বশেষ শেরে চূড়ান্ত ভাবের পরিণতি।
মাৎলা- প্রথম দু'টি লাইন, যেখানে একই কাফিয়া ও রাদিফ ব্যবহৃত হয়।
রাদিফ– অন্তমিল। মাৎলায় উভয় লাইনে অন্তমিল ও বাকী শেরগুলোর প্রতিটি দ্বিতীয় লাইনে কাফিয়া ও রাদিফের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
কাফিয়া– রাদিফ এর পূর্বে ব্যবহৃত শব্দ। শব্দ গুলো পরিবর্তিত হতে থাকবে, কিন্তু শেষ সিলেবল গুলোর ধ্বনি সাযুজ্য একই থাকবে।
বেড়– লাইনের দৈর্ঘ। প্রতিটি লাইন একই মাত্রায় লেখা হয়।
মাকতা– সর্ব শেষ শের । কেন্দ্রীয় ভাবের নাটকীয় পরিণতি স্থল (পাঞ্চিং লাইন্স)।
নিচে গালিবের একটি গযলের আঙ্গিক পর্যালোচনা করা হলো-
মূল গযল-
আহা কো চাহিয়ে ইক উমর আসর হো'নে তক্
কউন জিতা হে তেরে যুলফ কে সর্ হো'নে তক্
দামে হর মউজ মে হে হালকা-এ-সদ-কাম-এ-নিহাঙ
দেখিয়ে কিয়া গুযরে হে কাতরে পে গহর হো'নে তক্
আশিক্বি সবর তলব, আওর তামান্না বেতাব
দিল কা কিয়া রঙ করু খুন-এ-জিগর হো'নে তক্
হামনে মানা কে তাগাফিল না করোগে লিকিন
খাক্ হো জায়েঙ্গে হাম তুমকো খবর হো'নে তক্
পারতাব-এ-খুর সে হে শবনম কো ফানা কি তা’লিম
মেয় ভি হু এক ইনায়াত কি নাযার হো'নে তক্
ইয়াক নযর বেশ নেহি ফুরসাত-এ-হাস্তি গাফিল
গারমি-এ-বযম হে এক রক্স-এ-শারার হো'নে তক্
গাম-এ-হাস্তি কা ‘আসাদ’! কিস্ সে হো জুয্ মর্গ ইলাজ
শম্মা হর্ রঙ মে জ্বলতি হে সেহের হো'নে তক্
মাৎলাঃ
"আহা কো চাহিয়ে ইক উমর আসর হো'নে তক্
কউন জিতা হে তেরে যুলফ কে সর্ হো'নে তক্"
উভয় লাইনে রাদিফ - হো'নে তক্। প্রথম লাইনে কাফিয়া- আসর। দ্বিতীয় লাইনে কাফিয়া- সর্।
রাদিফঃ
প্রতিটি শের-এর দ্বিতীয় লাইনে "হো'নে তক্" রাদিফ ব্যবহৃত হয়েছে।
কাফিয়াঃ
প্রথম দু'টি লাইন সহ বাকী শেরগুলোর দ্বিতীয় লাইনে ব্যবহৃত কাফিয়াগুলো যথাক্রমে- আসর, সর,গহর,জিগর, খবর, নাযার, শারার, সেহের।
বেড়ঃ
প্রতিটি লাইনের দৈর্ঘ সমান।
মাকতাঃ
"গাম-এ-হাস্তি কা ‘আসাদ’! কিস্ সে হো জুয্ মর্গ ইলাজ
শম্মা হর্ রঙ মে জ্বলতি হে সেহের হো'নে তক্"
মাকতার প্রথম লাইনে কবি তার 'তাখাল্লুছ’ (কবিনাম) “আসাদ" ব্যবহার করেছেন।
গযলের আঙ্গিক হিসেবে উপরোল্লেখিত পাঁচটি বিষয় - মাৎলা, রাদিফ, কাফিয়া, বেড়, মাকতা- এর অবর্তমানে রচিত যেকোন কবিতাকে 'গযল' হিসেবে চিহ্নিত করা যথার্থ হবেনা, তার পাশাপাশি এও সত্য সুমধুর বাংলা ভাষায় সার্থক গযল রচনার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।