একদল লোক আমার একা একা কথা বলা,
                          একা একা পথ চলা,
                          একা একা হেসে বেড়ানো দেখে হাসে।
হাস্যরস করে, উপহাস করে, তামাশা বানায়,
                          সুযোগ বুঝে তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞাও করে।
তারা আমায় বড়ই মাতাল বা উন্মাদ ভাবে,
ভাবে পাগলের তালগোল পাকানো আবোলতাবোল বাক্যালাপ।
অথচ আমি তো জানি কারো না কারো সাথেই আমি কথা বলি।

একা একা তো কথা বলা যায় না, আমি উন্মাদ বা পাগল নই।
আমি খুব ঠিক আছি, যথেষ্ট ভালো আছি, বরং আমি বুদ্ধিমান।
দুঃখদের সাথে কথা বলি, খুব যতনে, খুব আপনে, সংগোপনে।

এসব দুঃখরা আমার অতি আদরের, পরম পরাণের!!
তারা আমা' গালে কানে চোখে মুখে বুকে পেটে-পিটে চুমু খায়।
আমার হাত-পায় এবড়োখেবড়ো  জড়িয়ে পড়ে, সাপের মতন।
তারা খুব যতনে আমায় নির্জন নির্মম নির্ঘুম রাতে পাহারা দেয়।
মাঝে-মাঝে মাঝরাতে ঘুম থেকেও ডেকে তুলে, বসায়, ভাবায়,
জল খাওয়ায়, বারান্দায় হাটায়, গল্প শুনায় ও কবিতা লিখায়।

সারা দিবস রজনী স্রেফ তারাই আমাকে বিনিময়হীন সঙ্গ দেয়।
কখনো ছেড়ে যায় না ছুড়ে ফেলে না, নিঃস্ব বা নিঃসঙ্গ করে না।
আমি দুঃখের সাথে নিভৃতে কিছু কথা বলি, একান্তে কিছু লিখি।
অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের কতো শতো কথা, কতো সব কথা!
এসব দুঃখদের নিয়েই আমি মাঝেমধ্যে ছাদে চাঁদ দেখতে যাই।
বেড়াতে যাই- শিশুপার্ক যাদুঘর চিড়িয়াখানা, সাহিত্য আড্ডায়,
বন্ধু-বান্ধবদের খালার-ফুফুর-মামার বাসায়, মেলায়, রেস্তোরায়।
যাই- বালুর পাহাড়, সবুজারণ্য, সমুদ্রচর, হ্রদ-নদ, নদীর তটে।
বেড়াই- বইমেলা বাণিজ্যমেলা, ধর্মশালা কর্মশালা, স্টেডিয়ামে।
একাই দাঁড়িয়ে থাকি বাহিরের বারান্দায়, বাগানের বাম কোণে।
মাঝরাতে বাগানে ফুল ফুটতে দেখে দুঃখরা একে একে কী এক
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, ফের কান্নায় বুক ভাসায়, হাসে-কাঁদে।
সত্যিই হাস্যকর! হাস্যকর!! আমি তাবৎ তাকিয়ে তাকিয়ে রই।
কান্না হাসির পাঠ শেষ হলে ভেজা ভেজা চোখে দুঃখরা আমাকে
আলিঙ্গন করে ললাটে চুমু খায়, হাত স্পর্শ করে অবনত মস্তকে।
এমন হাসি কান্নার ব্যখ্যা চাইলে দুঃখরা হেসে হেসে উত্তর দেয়-
তাদেরও বেশ দুঃখ আছে, কষ্ট আছে, হরেক রকম দুঃখ তাদের,
আছে বলতে না-পারা অনেক কথা, অনেক ব্যথা, ব্যথার প্রলয়।
হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে করে-
এ-সমস্ত দুঃখদের বিশ-বাইশটা কাঁচের বয়ামে পুরে আদা রসুন
পেঁয়াজ মরিচ লবঙ্গ দারুচিনির মসলাসহ সরিষার তেলে চুবিয়ে-
আঁচারের মতোন রেখে দিই দু'চারশো বছর অথবা হাজার বছর।
কিবা সময়ে অসময়ে একেক করে কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমিয়ে রেখে
কাঠের সিন্ধুকসহই পুড়িয়ে গুঁড়িয়ে উড়িয়ে দিই আকাশের পানে।
অনন্ত হেসেখেলে ভেসে বেড়াক বাতাসে, মিশে যাক মেঘমালায়,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝরে পড়ুক শিশির হয়ে, নেমে আসুক শ্রাবণের বৃষ্টিতে।

আবার ভাবি-
আমিই নিঃস্ব নিঃসঙ্গ হয়ে যাবো, যদি এরা এভাবে হারিয়ে যায়।
কে আছে এমন দুঃখের মতোন আপন! যারা গোপনে রয় কাছে।
একচুল সরে না কখনো, কোনোদিন, কোনোভাবে ছাড়ে না হাত।
একসাথে ঘুরেফিরে, খায়-দায়, খেলা করে, গল্প করে আড্ডায়।
আমি ঘুমিয়ে পড়লে আমার গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তারা শুয়ে পড়ে,
                    অথবা জেগে জেগে পুরোটা রাত কাটিয়ে দেয়।
এসব দুঃখ আমার নিত্যসঙ্গী, মায়ার এপাশ-ওপাশ, কায়া-ছায়া,
                    ঘরময় সমস্ত সময়, অবাস্তবের ব্যস্ত জীবনময়।