[ নিষঙ্গ - কাব্যগ্রন্থটির সাথে কথা আর কথা ]
কবিতা, কবি, কাব্যগ্রন্থ সমালোচনায় এক ধরনের বিভ্রাট সৃষ্টি হয়। এই বিভ্রাটের ইতিহাস পুরাতন এবং একদমই মধুর নয়। তাই কবিতা বা কবিতার বই নিয়া কথা বলতে গেলেই আপনি দেখবেন সর্বসম্মত কোনো বর্ননা বা সংজ্ঞা ভুলেও পাওয়া যায়না, কবিতা বা কাব্যগ্রন্থের আলোচকরা এ ধরনের সমস্যার মধ্যেই বেচেঁ আছেন। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার কিনা তা নিয়া কেউ ভাবছে কিনা জানিনা, আমি কিছুই ভাবছিনা। কারন আমরা প্রতিদিনই গতকালের কাব্যভাবনা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি, এটাই সত্যি, কিন্তু কেউ স্বীকার করছেনা। কিন্তু স্থিরহয়ে অতীতের দিকে চিন্তার চোখ মেলে দিলেই দেখা যাবে অতীত ও বর্তমানের কাব্যভাবনার মিল ও অমিল। মিলটন রহমানের কবিতা আমি প্রথম পড়ি মঈন ফারুক সম্পাদিত " সহস্রধারা : সীতাকুন্ডের সমকালীন কবিদের কবিতা সংকলন " নামক গ্রন্থে। সেখানে মিলটন রহমানের ১০ টি কবিতা ছিলো। আর একজন কবিকে বুঝতে তার ১০ টি কবিতাই যথেষ্ট। ওনার কবিতায় ভাষা, ভাবনা ও বিষয়বস্তুর মধ্যে থাকা একটা নবীনতা আমাকে ওনার কবিতার প্রতি টেনেছিলো। এরপরে মঈন ফারুকের মাধ্যমেই আমি ওনার " নিষঙ্গ " কাব্যগ্রন্থটি হাতে পাই, এবং পড়তে শুরু করি এবং জানতে শুরু করি একজন মিলটন রহমান কে। মিলটন রহমান একজন কবি গল্পকার এবং সাংবাদিক। যদিও ওনার গল্প, গদ্য আমি এখনো পড়িনি তবে কথাসাহিত্যে ওনার লেখনীর জন্য যে শক্ত অবস্থান তা আমি পরিচিতদের কাছে প্রায়শই শুনি। যেকোনো কবির দরকার স্বতন্ত্র কাব্যভাষা, যে কাব্যভাষা সহজেই তাকে উন্মোচিত করে, যে কাব্যভাষা দিয়ে সহজেই তাকে চিনে নেওয়া যায়। মিলটন রহমানের কবিতায় সেই আলাদারকম কাব্যভাষা আবিস্কার করতে পারবেন পাঠক সহজেই। কিন্তু কবিতা নিয়া আলাপ চালাতে গেলে কেবল মাত্র ভাষা নিয়া বললেই হয়না বলেই আমার ধারনা, কারন অনেকেরই স্বকীয় ভাষা থাকা স্বত্তেও কালের স্রোতে খুব সামান্যকাল ও তাদের সৃষ্টি টিকে থাকেনি, এর কারন ভাবনা। কবিতায় স্বকীয় ভাষাটা যেমন জরুরী তেমনি ভাবনা টাও মজবুত হওয়া দরকার, হৃদয়ে আঘাত করবার মতন নতুন হওয়া দরকার। কবিতা শিল্পের উচ্চমার্গীয় মাধ্যম তবে যেকোনো ধরনের পাঠকের জন্য তা হতে পারে সহজ থেকে সহজতর তার স্পষ্ট ইঙ্গিত ওনার কবিতা থেকে পাওয়া যায়। বিষয়বস্তুতে জটিলতা না থাকায় বিষয়বস্তুর তাৎপর্য বুঝতে পাঠক'কে কোনো অস্বস্তিতেও পড়তে হবেনা। আর দুর্বোধ্যতা মুলত মেটাফিজিক্যাল চিন্তা থেকে ও আসে, মিল্টন রহমানের কবিতায় এ ধরনের কোনো জটিলতা। ওনার যে বইটা নিয়া কথা বলবো বলে লিখছি, বইটির নাম " নিষঙ্গ " । বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের বইমেলায়।
কাব্যগ্রন্থ নিয়া আলোচনা লিখতে শুরু করেই মনে পড়লো তন্ময় মৃধার কথা। উনি লিখেছিলেন :-
" কে চায় বলুন তো একটা কবিতা লিখতে? আমিতো চাইনা। আমিতো চাইনা কোনো কবিতা লেখা হোক। তবুও তো লেখা হয়, তবুতো কবিতা লেখে লোক, লোক মানে জনসাধারন, যাদের বিষাদসিন্ধু, যাদের হৃদয় ভরা শোক অহরহ লিপিবদ্ধ হয়ে চলে বাংলা কবিতায়। একা ফুটে একা ঝরে যায় ফুল। "
নিষঙ্গ কাব্যগ্রন্থের কবিতা থেকে কবি হিসেবে মিলটন রহমান কে নির্দিষ্ট কোনো ঘরানায় ফেলা যাচ্ছেনা। কেননা কিছু কবিতা নাগরিক জীবনের যন্ত্রনা, গতানুগতিকতা, একঘেয়েমী, স্বার্থপরতা, স্বার্থহীনতা, অর্থহীন প্রতিযোগিতাকে তুলে ধরেছে যেমন, তেমনি কিছু কবিতা গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে সম্পুর্ন অন্য এক জগত। " অন্ত " " অগ্নিলা " " আয়ু " " নিষঙ্গ " " রেখা " " স্থির " " ক্ষোভ " ইত্যাদি শব্দবন্ধ উদাসী একজন মানুষকেই প্রকাশ করেছে, যে মানুষ ভীষন বিষণ্ণ, ভীষন প্রেমিক। এই বইয়ের কবিতায় অহেতুক শব্দের জটিলতা কম, সহজ সরল ভাষায় কবি তার দেখাকে প্রকাশ করেছেন। এই সরল প্রকাশই হয়তো কবির সম্পদ। অযথা সাংকেতিক ভাবে এমন কিছু বর্ননা করেননি যা সাধারন পাঠক কে স্পর্শ করতে পারে না। তাই সহজ বোধ্য হয়ে ওঠে " অবাধ্য " " নিথর " " বিভ্রম " " দাবি " " বীজ " " সত্যি " কবিতাগুলি। জীবনের কথা বলতে বলতে অন্তের কথাও বলে গেছেন কবি। অন্তের ভাবনায় ভাবিত হয় না এমন কোনো মানুষ নেই। হবে না ই বা কেন? জন্ম মাত্রেই একা মানুষ পেয়ে যায় অন্তের সংকেত। জীবন কি তবে বোকার গল্প'ই থেকে যায় ? অন্তের গ্রাস থেকে জীবনকে রক্ষা করে সাধ্যি কার? আর এই ভাবনা আছে বলেই হয়তো জীবন যেমন বেদনার তেমনি সমান আনন্দের। আর এই বেদনা ও আনন্দ, জন্ম ও মৃত্যুর মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে কবিতাগাছ। কত হাজার কোটি কবিতা এক অখণ্ড চেতনার মতো মৃত্যুচিন্তা চেতনে অবচেতনে এমনই প্রভাববিস্তার করে যে কবিতার আর শব্দের মায়াজাল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া অনেকক্ষেত্রেই ব্যার্থ হয়। মিলটন রহমানের কবিতাগুলো এমনই ভাবনার। কবিতাগুলোর সকল খণ্ড ভাবনাকে যদি একক ধরি তবে সামগ্রিকতার বিচারে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে, যদিও ব্যাক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়েছে কিছু কবিতা এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত না হলেই যেন আরো দুর্দান্ত আরো স্বয়ংসম্পূর্ণতা পেত কাব্যগ্রন্থটি। কিন্তু সেটা একান্তই আমার নিজস্ব ভাবনা। মিলটন রহমানের কবিতা ভাবনার জগত এবং এই কাব্যগ্রন্থতে কবিতা নির্বাচনের ভাবনা সম্পুর্ন আলাদা। তবে মিল একটাই আমাদের, আমরা যারা লেখালেখি করি সবাই শুন্যই একেঁ চলেছি। মিলটন রহমান ও তাই। শুন্যই একেছে। শুন্যই আঁকছি। কেননা, প্রতিমূহুর্তে ভেঙেচুরে যাচ্ছে সব, সব, সবকিছু, কেননা শুন্য এমন একটি সংখ্যা যা পূর্নতার প্রতীক, যা সবচেয়ে রহস্যময়..ঠিক অন্তের মত। ঠিক মিলটন রহমানের নিম্নোক্ত লাইনগুলির মতো
" পাথরের কলিলিজাফাটা তামাদি প্রান্তর
এসবের লগে থাকি নিদ্রা -বিভোর...."
আবার,
" অন্ত " অগ্নিলা " "পথ" " দাগ " "নাগ " ইত্যাদি কবিতায় সম্পুর্ন অন্য একজন মানুষকে আবিস্কার করা যায়। বাকি কবিতাগুলোর সময় যে একজন চুপচাপ লুকিয়ে থাকে বোধের ভিতরের বোধে। " অন্ত " কবিতায় কবি লেখেন :-
" ওখানে হরিতকি গান উড়ছে বিলেতি আকাশে
ছিঁড়ে যাচ্ছে জলজ মেঘের শরীর আর
জানালার কাঁচ ভেঙে কেটে যাচ্ছে রোদের শরীর
আমার পরানের যে অংশ তড়পায়
সেখানে কেনো বসে আছো কাটা ধনুক হাতে
বুঝোনা সব ভেঙে যাচ্ছে
আমার মত
তোমার মত! "
"করাত " কবিতাটি আপাতধাবে ধারালো লাগলেও এই কবিতাটিতে নিঃসঙ্গতার এমন একটি দিককে তুলে ধরা হয়েছে যা করাতের চেয়েও ধারালো...
" দুই বিগত আকাশের আয়ু পেরিয়ে গেলে
বলতে পারবো
এর সবই দেখেছি তোমার চোখের ভেতর "।
একই শব্দ বারবার ঘুরে ফিরে নানা কবিতায় আসা একধরনের সীমাবদ্ধতা মনে হয় আমার কাছে। মিলটন রহমানের কবিতায় এমন সীমাবদ্ধতা নেই। তবে জড়িমা দূর করবার অভিপ্রায়ে আপন স্থুলতার পরিচয় পাওয়া যায় কবিতাগুলিতে, কিন্তু ধ্বনির ব্যাঞ্জনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেখানে অনেকেই দুর্বোধ্য হয়ে পরেন সেখানে কবি মিলটন রহমান দুর্বোধ্য নন এবং দ্বৈতার্থ বহন করবার ক্ষমতা তার শব্দের বিন্যাসের মাঝে আছে এবং উনি পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন নিঃসঙ্গতার এক ভয়াল দিক আর পাশেই বয়ে চলা জীবন থেকে উৎসারিত হয় ওনার কবিতা। বাস্তব ও কল্পনার এমন মিশেল পাওয়া যায় কবিতাগুলিতে যেন তা নিজস্ব যাপনচিত্র। আমি যখন প্রথম ওনার কবিতা পড়ি সংকলনটিতে কয়েকটা দীর্ঘ কবিতা পড়েছিলাম, যা ওনার প্রতি আমার আকর্ষন আরো বাড়িয়ে দেয়, কেননা আজকাল দীর্ঘ কবিতা খুব কমই লেখা হচ্ছে। কিন্তু ওনার "নিষঙ্গ " কাব্যগ্রন্থটিতে তেমন দীর্ঘ কোনো কবিতা নেই। সবই ছোটো এবং মাঝারি ধরনের কবিতা যার অধিকাংশই পাঠকের হৃদয়স্পর্শ করতে সক্ষম হবে বলেই আমার ধারনা। মিলটন রহমানের কবিতাভাবনা আসলে জীবনকে দেখা অন্য আঙ্গিক থেকে। যে ভাবনা ও নিজস্ব ভাষার সন্ধানে কবি সন্ধানী হয়েছেন তা একজন কবির নিজস্ব বীক্ষা। এখানেই সার্থক মিলটন রহমানের " নিষঙ্গ" কাব্যগ্রন্থটি। কবিতার যে অল্পসংখ্যক পাঠক আছে তারা অনুধাবন করতে পারবে কবির এই বেদনা...
" মিশে যাও বাতাসের লোমে
বাতাসের কাফন হও
মৃত্তিকা আকাশ হও
হও অসীমান্ত ময়ূরীর পালক
পাহাড়ের দরজা খুলে
রক্তের স্রোত হও
কেটে ফেলো সাপ ও গুহার আকার "
-মলয় দত্ত
( প্রকাশিত, চন্দ্রবিন্দু লিটলম্যাগাজিন, ২০১৯)