ঝর্না রানী দাস।
আজ বাইশে আষাঢ়।
আপনি খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন।
ঈদ আপনার না হলেও আপনি সেমাই রাধেন।
আপনার তনয় এসেছে দুর থেকে গত রাতে।
বনের দূর অন্ধকার কেটে হাসি নিয়ে এসেছে সে।
আটার রুটি, সেমাই ছেলেকে দেন খেতে।
আপনার স্বামী গতকালের ঘাম মাখা জামা পড়ে বাজারে যায়।
একথোকা মৃত্যু আর উৎসবীয় ঈদ এর ভীড়ে আপনার স্বামী আগায়।
আপনি স্বামী, ছেলে বা নিজের বা সকলের পোষাক ধুয়ে, জানলার পর্দা টানতে আসেন।
আপনি রাজনীতি চেনেন না।
গনতন্ত্রের সংজ্ঞা ভুলে গেছেন।
আপনি বিদেশী, দেশী, কোন জঙ্গী সংগঠন ই চেনেন না।
আপনি মা।
বুলেট মা চেনেনা।
বাইরে চলতে থাকা অকস্মাৎ যুদ্ধের ভূল বুলেট জানলা গলে আপনার সুখভরতি মগজে ঢুকে যায়।
যেমন করে নরম মাটিতে ঢুকে যায় মাছরাঙা সাপ।
আপনি তখন কি ভাবছিলেন?
দিশেহারা কোন এক পাখি ডানা ঝাপ্টাচ্ছিল মগজেত সকল গলিপথ জুড়ে।
ক্ষ্যাপামি নেশায় আপনার সকল স্বপ্ন মাটির গভীর হতে আরো গভীরে যায়।
সেই গভীর হতে আকাশে উড়ে যায়।
আপনি কি আপনার মায়ের শাড়ির আচলের জানলা ঘেষে আসা আলো দেখছিলেন?
কেপে কেপে ওঠা শরীরে ঘনীভুত আধার।
ঝর্না রানী দাস
আপনি বুঝলেন প্রথমবারের মত "মানুষ মরনশীল "এটা কতটা সত্যি।
আপনার সাথে যোগসুত্রহীন এক যুদ্ধের বিভীষিকায় আপনি মরে গেলেন।
বুলেট মা চেনেনা।
যেমন করে, আপনি রাজনৈতিক অপদেবতা চেনেন না।
শুয়োরের পাল চেনেন না।
আপনি মরে গেছেন।
চেনা অচেনা কাটিয়ে এটাই সত্যি।
হঠাৎ করে আপনার বাড়ির ভাঙা দেয়ালে ছত্রাক প্রসারন বেড়ে গেল।
আপনার স্বামী বাজার হতে আসে।
আপনার পতিদেবতা।
রুই মাছ লেজ বের করে থাকে।
আপনার স্বামী তাকিয়ে আছে মেঝেতে পড়ে থাকা তার স্ত্রীর নিথর দেহটির দিকে।
এই ঘরের দেয়ালেই টানানো আপনাদের যৌথ ছবি।
মিডিয়া এসে গেছে,
আপনার স্বামী আবেগ আনার সামান্য চেষ্টায়ই ডুকরে কেদে উঠে ব্যাক্ত করছে আপনাকে।
আপনি কি দেখতে পান এক পুরুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরনের শব্দ?
আপনি কি দেখতে পান এক পুরুষের জীবনে অন্ধকার নামার পূর্ব মুহুর্ত?
আপনার স্বামী মিডিয়া বিদায় দিল।।
আপনার লাশের পাশে ধুপকাঠী জ্বালা হয়েছে।
আপনার ছেলে তাকিয়ে আছে জানলার দিয়ে কালো পীচের রাস্তার দিকে।
ছেলের প্রেমিকা শান্তনার ঝুলি নিয়ে বসে আছে মুঠোফোনের ওপাশে।
আপনার ছেলের আজ প্রেমিকায় অভক্তি, এবং বমি।
প্রধানমন্ত্রী আপনার কথা শুনেছেন।
তীব্র শোক প্রকাশ ছাড়া আমাদের কারোই কিছু করার থাকেনা একবার মরে গেলে!
ঝর্না রানী দাস
এই মুহুর্তে দেশের সবগুলা চ্যানেলে আপনাকে দেখাচ্ছে।
আপনি তেজপাতা দিয়ে মাংস কষাবেন ভেবেছিলেন আজ।
আপনি এখন মরে গিয়ে আলোচিত,
আপনার আত্মীয়রা মিথ্যে কান্নায় ভিজে, মিডিয়ার নিজেদের দেখার আনন্দে আনন্দিত।
ঝর্না রানী দাস
আজ বাইষে আষাঢ়।
আপনার সিথির মেঠোপথ হতে,
আপনার সিথির দ্রাঘিমা হতে সিদুর মুছে ফেলা হয়।
আপনার স্বামী মেঝেতে বসা।
আয়নার সামনে রাখা সিদুরের কৌটায় তার অসহায় দৃষ্টি।
আপনার শাখা ভেঙে ফেলে কেউ কেউ দায়িত্ব নিয়ে।
আপনার আত্মীয়রা কানাঘুষা করে "আপনি ভাগ্যবতী, কারন আপনি স্বামীর আগে মরেছেন, আপনি শাখা সিদুর নিয়ে মরেছেন,আপনি নাকি স্বজ্ঞ পাবেন মা! "
মা এরা জানেনা, "মা এর অমরাবতী যেতে কপালে লেড অক্সাইড লাগেনা।"
ঝর্না রানী দাস
আপনাকে ঘন্টা তিনেক এর মাথায় চিতায় তোলা হয়।
চন্দন কাঠের দাম বড্ড।
আম কাঠে পুড়ুন মা।
গতরাতে সুখ বোঝাই থলে বয়ে আনা তনয় মুখাগ্নিতে ব্যাস্ত।
সুখের থলে দক্ষিনের বারান্দায় রাখা।
আপনি আমকাঠে অনল চাপা।
চিতায় আগুন জ্বলে।
একটু দুরেই সামরিক বাহিনীর আধুনিক গাড়ি।
ঝর্না রানী দাস
আপনি থাকবেন না এটাই যেন স্বাভাবিক।
আজ বাইশে আষাঢ়।
আজ ঈদ।
বোকাবাক্সে হাজারো অনুষ্ঠান।
আমরা মুখ হা করে নীলকমল নদীতে নৌকাবাইচ লাইভ দেখছি।
আপনি মরে গেছেন।
তাতে কিছু যায় আসেনা।
লেজ বেড় করা রুই মাছ ফেলে দেয়া হয়নি।
অপূর্ব হিংস্র সমাজ আপনার মৃত্যুতে দায়িত্বরক্ষার অনুতাপ উৎসব পালন করছে।
আদতে, কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা কুকুরের দল অনুতপ্ত নয়।
মা বুলেট আপনাকে চেনেনা!
আপনি কি রক্ত মাংসে পুনরায় মানুষ হতে চান?
উৎসর্গ - ২০১৬ ঈদে শোলাকিয়া জঙ্গি হামলায় নিহত এক নিরপরাধ মা " ঝর্না রানী দাস " কে।