♦[১]♦
আজীবনভর আমার চোখের ভিতর চাষ করি মায়ের হাহাকার। যে হাহাকার শাদা জবা রুপধরে ফোটে, গাঢ় হাওয়ার গান হয়ে ওড়ে, জলের স্পর্ধাজুড়ে জল হয়ে নাচে তবু তার চৌদিকে ছড়িয়ে রয় যবনিকার লক্ষন আর অসুখের মায়া মায়া রাত, তাই বুঝি -দৃশ্যমানতা পায়না এমন একটা দুরন্ত ছোবলভয় আমাকে ক্লান্ত করে রাখে সবসময়। মা বোঝেনা। জানেনা এসব। পৃথিবীর দিকে তাকাতে আমার ভালোলাগেনা। কিন্তু তাকাই। বনের কুয়াশা ঘেরা কিনারা হতে চোখের সামনে এগিয়ে আসে বিনাশমন্ত্রের মতন মৃদু ছলছল উল্লাস, যে উল্লাসে আরো আরো হাহাকারের বীজ জমা হয় চোখের গহীন আবাহনে!
.
আমার ভালোলাগেনা এমন দ্বিধায় দ্বীর্ণ বেচেঁ থাকা, অনুতাপে পুড়ে যাওয়া শত সহস্র বছর ধরে বুনে চলা নকশা। এমন কত ভালো না লাগা, মা জানেনা, বোঝেনা। গ্রামীন পরিবেশে সকাল সন্ধ্যা অনাহত বীন বেজে যায়, সবুজ পাখির দল বীনের সে সুর বয়ে আনে, আমি শুনি। অনুবাদ করি । নাভির দেবতার কাছে জমা রাখি বেদনা সংহিতা । সুর হতে শান্তির বদলে শাস্তি ঝরে পড়ে। শাস্তির অনুকনা ছিটিয়ে দেই চোখের মধ্যে, শাস্তির অনুকনায় উর্বর হয় চোখের ভুমি, ফলন বাড়ে হাহাকারের,আজীবনভর তাই আমি আমার চোখের ভিতর চাষ করি মায়ের হাহাকার আর কখনো কখনো হাহাকার ফসল তোলার আনন্দে আমি আর মা দুজনেই কাঁদতে থাকি খুব এলোমেলো , সে কান্না কি বিপুল, কি সবুজ, কি পরম, কি কোমল, ও ঈশ্বর !
♦ [২] ♦
ভেলভেটের জামা গায়ে যুবতী দুই ফসল কুড়ানী আমার ভিতর পাখা খুলে শুয়ে থাকে, আবার উড়ে যায়। নির্বোধ আঙুলে বুনে চলে অজস্র খেয়ালী সমীরন - হেটে চলে সাদাসিধে বেদনার পদাবলী জুড়ে, কখনো বা বেড়ায় ভেসে আমার সকল কথোপকথনে নিযুত গন্ধরেনু হয়ে। অথচ, আফিমের ঘ্রানে কভু হয়না চরম উত্তাল - বনের ভিতর চিৎকার করে বুঝি প্রকৃতির কোনো উপাসক! শরীরের গহন নিবিড়তায় এই দুই যুবতী তাদের রেশমের মতন চুলে চুলে বয়ে আনে দৃপ্ত সরল অনেক উজাগর রাত আর অশান্ত জলের কীর্তন - আহা অপরুপ। আফিমফুলের ভাষায় তাদের আমি শিখিয়ে দেই প্রার্থনার বুলি। খুশির লহরে চোখের শাসন ভুলে সারাদিন সারারাত ভেলভেট জামা গায়ে শুয়ে থাকে নিশ্চুপ সুন্দর এই দুই তরুনী আমার গভীরে, আর আফিমফুলের ভাষায় করে প্রার্থনা - সুরে সুরে তুলে আনে নতুন শস্যের গান, বরফ মাখানো নিদারুন সব বিষাদ!
আমি এখন আফিমফুলের ভাষায় কথা বলি। আমার করতলে এক সুন্দর শীতের বন ভেসে থাকে। মরন বাশিঁর সুর বুঝি মিশে থাকে প্রতি গাছে গাছে, উষ্ণ আর ঠান্ডা বেবাক সমতলে। বিষম আধারে সে শীতের বনেও বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ঘটে যায়। নিশ্চল পড়ে থাকা কাঠের গায়ে ঝরে পড়ে ব্যাথার আভাস ছেয়ে রাখা কুয়াশা ও ধোয়া যত। ভেলভেট জামা গায়ে সে সুন্দর তরুনীদ্বয় এই শীতের বনে দাঁড়িয়ে থাকে নির্বিকার, তীব্র চোখে দেখে ওরা সুন্দর সেই জলজ ঘাসের দল আর আমার জন্য সযত্নে পাঠায় অজস্র করুনা, গভীর - গভীর রাত।
আমি এখন আফিমফুলের ভাষায় কথা বলি। নবীন দৃষ্টি মেলে বহমান জলে সরল ঢেউ এর মতন গান গাই অচেনা ক্ষয়ের গন্ধ জুড়ে। লেগে থাকে আমার জিভে ভয়ানক সন্ত্রাস। জলের সহজ হাসির মতন করে যেন কার শাদা হাত জেগে ওঠে পাতার ফাঁকেফাঁকে, ভালবেসে বেসে হয়রান আমি তাই নতমুখী সন্ধ্যায় আফিমফুলের ভাষায় সুখী বৃক্ষরে বলি - লতার নম্রতা ও বলে নাকি কোনো অবসানের কথা, আমার নির্বাসনের পাশে খুলে রাখে কি কেউ জনম জনমের বেদনা?