।পার্থদার স্মৃতি।

করোনার করাল থাবা থেকে প্রাণ বাঁচাতে আমরা সবাই যখন যে যার গৃহকোণে বন্দী, সেই সময় কবি পার্থসারথি চৌধুরি আমাদের ছেড়ে চলে যান। নিরুপায় আমরা পার্থদাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য কলকাতা ছেড়ে যেতে পারিনি তাঁর বৈদ্যবাটির বাড়িতে। এ দুঃখ আমাদের যাওয়ার নয়।
       কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই অসুস্থতা যে এত তাড়াতাড়ি আমাদের কাছ থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নেবে তা ভাবিনি কখনো।
       পার্থদার দুটো স্মৃতি আমার কাছে চিরদিন অমলিন থেকে যাবে। লেখক শিল্পীদের সভার জন্য দফতরে গেছি। দেখি শুধু পার্থদা আর প্রণবদা বসে আছেন। সভার দেরি আছে। একথা সেকথার পর পার্থদা গান ধরলেন। রবীন্দ্রনাথের গান। কিংবা কোনো পুরাতনী বাংলা গান বা কোনো গণসংগীত। গান গাইতে গাইতে কবিতায় চলে গেলেন। রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে জীবনানন্দের কবিতায়। একের পর এক কবিতায় আমাদের মাতিয়ে দিলেন। প্রণবদা ও আমার  মাঝেমাঝে এটা ওটা মন্তব্য। এভাবেই চলল অনেকক্ষণ-- বাকিরা এসে পড়া পর্যন্ত।
         আর একটা স্মৃতি আরো আগের। পার্থদা তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের দাপুটে নেতা। ময়দানের সভা। এসপ্ল্যানেডের লেনিন মূর্তির কাছ থেকে বিবাদী বাগের ব্যাঙ্ক, বীমা ও সওদাগরি অফিসের কর্মচারীদের মিছিলে হাঁটছি। কিছুটা এগিয়ে দেখি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলটা নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে পার্থদা এগিয়ে চলেছেন। এক সময় রাস্তায় সব মিছিল মিলেমিশে একাকার! বাকি সব স্লোগান ছাপিয়ে তখন শোনা যেত শুধু পার্থদার উদাত্ত স্লোগান। আমরা সবাই গলা মেলাতাম পার্থদার স্লোগানে।
       পার্থদার কবিতার ভাষা বড়ো মোলায়েম। লড়াই-সংগ্রামের অনুষঙ্গ ছুঁয়ে, পার্থদার কবিতার মধ্যে ছড়ানো থাকত মানুষের জন্য অন্তর্লীন অন্তহীন ভালোবাসা। তাঁর কবিতার বই 'স্বপ্নের শিকড় খুঁজি'-র কবিতাগুলো জীবনভর আমাদের সেই ভালোবাসা দিয়ে যাবে। পাঠকদের জন্য তাঁর একটি কবিতা নীচে তুলে দিলাম।

শিরদাঁড়াটার যত্ন নাও

শিরদাঁড়াটা নুইছে রোজ, মিছেই তুমি পাচ্ছো ভয়
ফোঁস কি শুধু কেউটে করে? মানুষকেও তো করতে হয়!
দেখছ সবই, সইছ সবই, বইছ বুকে পাষাণভার
দিনের শেষে আয়না দেখে নিজের কাছেই মানছ হার!
হারছ তুমি রাস্তাঘাটে, বাসে ট্রামে মেট্রোতে
নিজের মতো আপোষ করে নিচ্ছ কর্মক্ষেত্রতে।
ভাল্লাগে না রোজ পরাজয়, ধুঁকতে ধুঁকতে এই বাঁচা
রাজনীতিটাও পারো না ঠিক, তাতেও তুমি খুব কাঁচা!
মনের মধ্যে জমছে কথা, মুখেই শুধু ফুটছে না
বুকের ভিতর দমকা বাতাস ঝড় হয়ে তাও উঠছে না?
গর্জনে হোক, বর্জনে হোক তুমিও আছো জানান দাও
গ্রহণে হোক, সহনে হোক শিরদাঁড়াটার যত্ন নাও!
ভাঙছে হৃদয় জুড়ছে না তো, ভাবছে সবাই তোমার মতো
ওই যে বুকের গভীর ক্ষত, জ্বালায় তোমায় অবিরত,
ভাঙছে তোমার কাঁচের স্বর্গ সকাল বিকেল রাত্রিদিন
নিজের কারায় বন্দী তুমি, নিজের কাছেই অন্তরীণ!
বাষ্প জমে চোখের কোণে, উপচে পড়ে কান্নাটা
চিনছো না তো নিজেকে তাও, তুমিই তো সেই পান্নাটা।
নিজের চোখে অনেক দামি, নাই বা বুঝুক মূল্য কেউ
তুমিই তো সেই মহাসাগর, তুলতে পারো একাই ঢেউ!
তুমিই তো সেই সব্যসাচী, তোমায় হারায় সাধ্য কার?
ধনুক হাতে রুখে দাঁড়াও, শেষ দেখে নাও যুদ্ধটার।
তুমিই তো সেই ফিনিক্স পাখি, বেঁচে ওঠো বারংবার
যতবারই আগুন জ্বলুক, মারুক তোমায় এ সংসার।
তারার ধুলোয় সৃষ্টি তোমার, তারার আগুন বুকজুড়ে
তুমিই তো সেই মহাজগৎ, বেজে ওঠো সাত সুরে।
ঝলমলিয়ে ওঠো বরং, অংশ যখন সেই তারার
নিজেই নিজের গল্প বলো, হারতে গিয়েও না হারার!
শিরদাঁড়াটা সোজা রেখো করবে যখন প্রত্যাঘাত
দেখবে তুমি অবাক চোখে, হচ্ছে তাতেই কিস্তিমাৎ!
        
      মাঝে মাঝে পার্থদার কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়। তখন আলমারি থেকে বই বার করে তাঁর কবিতা পড়ে মন ভালো করার চেষ্টা করতে থাকি।

।অরি মিত্র।

ছবি: সৃজিতা ভট্টাচার্যের সৌজন্যে