।কবি ভবতোষ শতপথী।

কবি ভবতোষ শতপথী পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি। এখন আঞ্চলিক ভাষায় অনেকেই কবিতা লিখছেন। আঞ্চলিক ভাষার কবিতার পাঠক ও শ্রোতাও এখন দুর্লভ নয়। কিন্তু ভবতোষদা যখন আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন আঞ্চলিক ভাষার কবিতার লোকমান্যতা বলতে যা বোঝায় তা ছিল না। সেদিক থেকে ভবতোষদা পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলা কবিতার ভগীরথ।

অন্যদিকে, প্রমিত বাংলা ভাষার ওপর ভবতোষদার অসাধারণ দখল ছিল। বাংলা ছন্দকে অনায়াস দক্ষতায় কবিতায় ব্যবহার করতেন। প্রমিত বাংলায় তিনি অত্যন্ত উঁচু মানের অসংখ্য কবিতা লিখেছেন।

অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমার টুলিবড় গ্রামে 1935 সালে এই কবির জন্ম। বাংলা সন-তারিখ অনুযায়ী তাঁর জন্ম 1341 সালের 20 বৈশাখ। তিনি ছিলেন ওই গ্রামের অবস্থাপন্ন সচ্ছল বাসিন্দা পতিচরণ শতপথীর একমাত্র পুত্র। গ্রামের পাঠশালায় তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। পরে বিহারের বহড়াগোড়া স্কুল ও ঝাড়গ্রামের কুমুদকুমারী স্কুলে লেখাপড়া করেন। প্রথাগত শিক্ষার প্রতি তাঁর কোনও দুর্বলতা ছিল না। ফলে, তিনি আর কলেজমুখো হওয়ার আগ্রহ দেখাননি।

একদিকে জমিদারির উত্তরাধিকারে বঞ্চনার শিকার হয়ে, অন্যদিকে স্ত্রীর অকালপ্রয়াণে তিনি একেবারে অথৈ জলে পড়ে যান। তিন সন্তান নিয়ে অকূলপাথারে ভাসতে ভাসতে নিঃস্ব এই মানুষটি কবিতা ও দরিদ্র সাধারণ মানুষকে জীবনের  অবলম্বন করে নেন। 2017 সালে এই কবির প্রয়াণ ঘটে।

পশ্চিমবাংলার  মেদিনীপুর/ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পার্শ্ববর্তী বিহার/ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যার প্রান্তিক মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর নিয়ত আত্মিক যোগাযোগ তাঁকে ব্যস্ত রেখেছিল আঞ্চলিক বাংলা কুড়মালি ভাষায় অসংখ্য কবিতা ও গান রচনায়। তাঁর লেখা ঝুমুর গানগুলি  অসম্ভব জনপ্রিয়।

তাঁর 'অরণ্যের কাব্য' প্রকাশিত হওয়ার পরে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। কলকাতার 'বর্তমান' পত্রিকা লিখেছিল, "ভবতোষ শতপথীর প্রথম কাব্য সংকলন 'অরণ্যের কাব্য'। বাংলা কবিতার মর্মধারায় কবি এক মোচড় দিয়ে মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে গেছেন অরণ্য মনের গভীর  গোপনে।... অরণ্যের কাব্য আর্য ব্রাহ্মণ্যের আত্ম পিণ্ডদান-- "ব্রাহ্মণের পৈতা ছিঁড়ে হাহাকারে হয়েছি চণ্ডাল" "... দ্বিজ নই আমি ত্রিজ"....."নমস্কার করে আমি নমঃশূদ্র হয়ে গেছি।"-- এখানেই কবির পূর্বাশ্রমের বিলুপ্তির ইতিকথা এবং বন্যাশ্রমে বিলীনের ইতিহাস। ..... বাংলা সাহিত্যে 'অরণ্যের কাব্য' অপূর্ব অদ্ভুত স্বাদে গন্ধে চরিত্রে।'
সন্নিহিত তিন রাজ্যের প্রায় চার কোটি মানুষের ভাষায় ভবতোষবাবুর কাব্য এক আত্মিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োগের রূপ নিচ্ছে। 'অরণ্যের কাব্য'  এক মহান সৃষ্টি।"

কবির 'অরণ্যের কাব্য' থেকে কয়েকটি নির্বাচিত পঙ্‌ক্তি নীচে তুলে দেওয়া হল।

স্বাধীন ভারতবর্ষ পণ্ডিত-মূর্খের নিজদেশ
মানুষ-নিসর্গ-মাটি মনে আনে জন্মের আবেশ
মানব-জাতির প্রতি প্রেম-প্রীতি গভীর বিশ্বাস
মানুষ না হলে, লাভ নেই, হয়ে "জিনিয়াস"।
#
জীবিত কবরে বাস অগণিত বিবর-নিবাসী
সংকীর্ণ বস্তির বুকে অপুষ্টিজনিত অষ্টাদশী
অস্পষ্ট যৌবন-চিহ্ন ক্ষীণ দেহ অস্থিচর্ম সার
নাই পীন-পয়োধর মাতৃত্বের অমৃত পয়ার।
#
সেয়ানে সেয়ানে চলে কোলাকুলি, ভাব-বিনিময়
বাগে পেলে অনুরাগ, বীতরাগে পরিণত হয়
স্বার্থপর মেলামেশা এক বুক আত্মকেন্দ্রিকতা
আত্মসুখী অভাজন, মহামান্য নির্বাচিত নেতা।
#
মুখে মধু অন্তরে বিষ স্বার্থপরতার ভালোবাসা
দুর্দশা দর্শন হেতু ছদ্মবেশে করে যাওয়া-আসা।
মিল নেই মানুষের মুখের ও বুকের ভাষায়
আপাতত আপন যে, পরক্ষণে পর হয়ে যায়।
#
হায় রে দাম্ভিক কবি, কবিতা কৈবল্য অহংকার
তীক্ষ্ণ শ্লেষ ছিন্ন বেশ অভাবের অচল সংসার
মিথ্যা খ্যাতি নাম-যশ প্রায় দিন শূন্য পাকস্থলী
ইহকালে দাবদাহ, পরকালে পাবে করতালি।
#
গতকাল যে লোকটা ভাবে গদগদ কথা বলে
আজ কেন সে এমন আমাকে এড়িয়ে যায় চলে
পরনিন্দা পরচর্চা ইতর ভদ্রের ইশারায়
আপন ও প্রিয়জন হঠাৎ অপ্রিয় হয়ে যায়।
#
কলুষিত পরিবেশ দালাল-শোভিত সারাদেশ
মানুষের চেয়ে বেশি মূল্যবান ছাগ কিংবা মেষ
পশুকুলে বংশবৃদ্ধি বর্তমানে আশু প্রয়োজন
হায়রে মানবশিশু, তোর ভাগ্যে জন্ম-নিয়ন্ত্রণ।

'অরণ্যের কাব্য' প্রকাশের আগে তিনি তিরিশ বছর ধরে কবিতা লিখেছেন। ভাবলে অবাক হতে হয়, তিরিশ বছর কবিতা লেখার পরে তাঁর মতো শক্তিশালী কবির প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল।

আসলে ভবতোষদা ছিলেন, একেবারে প্রচারবিমুখ মানুষ। কোথাও কবিতা বেরোল কিনা, কে কী বললেন তাঁর কবিতার ব্যাপারে-- তা নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। তিনি লিখেই খালাস! প্রকাশিত কবিতার সংরক্ষণেও তাঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। ফলে বিস্তর ক্ষতি হয়েছে। তাঁর অনেক কবিতাই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে!

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ভবতোষদার সংগ্রহে তাঁর কোনও কবিতার বই ছিল না। কলকাতার 'শব্দহরিণ' পত্রিকা এক সময় ওই পত্রিকার এক একটা সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার এক একজন কবিকে নিয়ে 'কবিতার পথে পথে' এই শিরোনামে লেখা প্রকাশ করছিল। স্কিমটা ছিল এই রকম। কেউ একজন কবির সঙ্গে কথা বলে তাঁর জীবন ও কাব্যকৃতি নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখবেন। প্রবন্ধের  পরে কবির নিজের বেছে দেওয়া তাঁর প্রতিনিধিস্থানীয় দশটা কবিতা ছাপা হবে। 2012 সালে ভবতোষদার ওপর লেখার দায়িত্বটা আমাকে দেওয়া হয়েছিল। ভবতোষদার বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে ঘণ্টা চারেক কথা বলে দু-তিন দিনের মধ্যে লেখাটা লিখে ফেললাম। কিন্তু মুশকিল হল, তাঁর কবিতা নিয়ে। ভবতোষদার কাছে তাঁর কোনও কবিতার বই নেই। তাই, হাতের কাছে যা পেলেন তাই জেরক্স করে দশটা কবিতা দিলেন। তা দেখে পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর মাথায় হাত। প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা তো দূরের কথা, তাঁদের জানা ভবতোষদার কোনও কবিতাই তাতে নেই! অগত্যা, 'অরণ্যের কাব্য ও সংকলিত ভবতোষ' থেকে কবিতা বাছাই করে কাজ সারতে হয়েছিল।

এবার ভবতোষদার দু-একটা কবিতার উল্লেখ করব। প্রথমে প্রমিত বাংলায় লেখা কবিতা, যা একবার পড়েই পাঠক টের পাবেন তাঁর কলমের জোর।

বেশ করেছি

বেশ করেছি, সব বেচেছি
বাঁচার তাগিদে।
শেষ সম্বল ভালোবাসা,
বেচবো নগদে।

টিপ দিয়েছি, সই করেছি
দু'পিঠ দলিলে
জানিয়ে সেলাম, সামিল হলাম
মস্ত মিছিলে।

সুখের মুখে ছাই দিয়েছি
দুঃখের দায় ভাগ;
এই জীবনের প্রতি আমার
অন্য অনুরাগ;

চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে,
আমার তাতে কি?
শূন্য ঘরে অন্ধকারে--
একলা বসেছি।

একইভাবে, নীচের কবিতাটিতে কবির কলমের সামর্থ্য যেন উপচে পড়েছে।

বাক্-প্রতিমা

শব্দ শৃঙ্গার
ভাবের ভৃঙ্গার
বীণার ঝংকার
              ঝংকৃত।

শুভ্র সুষমায়
শিল্প চেতনায়
বিশ্ব চরাচর
             চিত্রিত।

কাকলি কলতান
ভাসানে ভাসমান
বেদনা বেদগান
               মূর্ছনা।

আহত দুই তীর
সতত অস্থির
মৌন মুখরিত
             ব্যঞ্জনা।

দীর্ঘ কেশপাশ
কবরী বিন্যাস
কবি কি ক্রীতদাস
              বঞ্চিত।

লুপ্ত তপোবন
সুপ্ত ত্রিভুবন
কামিনী কাঞ্চন
              সঞ্চিত।

স্তনিত দেহভার
সুরেলা শীৎকার
অশুভ অভিসার
              স্তম্ভিত।

অসুখী শয্যায়
প্রহর কেটে যায়
মানুষ অসহায়
                  বিব্রত।

এবার তাঁর একটা আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় লেখা কবিতার উল্লেখ করব।

নামঅ পাড়ার ছঢ়া

হাড়াম বুঢ়ি গবর কুঢ়ায়
লদী পারের টাঁইড়ে
থুথমা ডাঁগায় কপতি গগায়
কাঁটা বাঁশের ঝাঢ়ে।

ইড়ক্যেঁ বুলে আড়্যাঁ বাছ্যুর
ভেভায় ছাগ্যল ছানা
ভুগহা-পিঁধা মকরা লধা
টাইনছে ছিঁড়া টেনা।

কুঁড়চি বুদায় ফুল ফুট্যেঁছে
আচকা মহ্যক আসে
ছটকি বহু ছইটক্যেঁ উঠে
বড়কি যেখ্যন হাসে।

ছাথি ফুলায়ঁ কুলহি বুলে
বোড়োলোকের বিটি
ঢইনক্যেঁ মইরছে খালে বিলে
নামঅ পাড়ার পুঁটি।।

"শিরি চুনারাম মাঁহত" কাব্যগ্রন্থের 'শিরি চুনারাম মাঁহত' তাঁর লেখা আঞ্চলিক কুড়মালি  ভাষায় লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা। দীর্ঘ এই কবিতায় তিনি দরিদ্র চুনারামের দারিদ্র, দুঃখ, যন্ত্রণা ও হতাশাকে তাঁর অনুপম ও অননুকরণীয় কাব্যশৈলীতে প্রকাশ করেছেন। কালজয়ী এই কবিতার দুটো অবিস্মরণীয় লাইন-- 'ভালবাসা ভেস্তায়ঁ গেলে--/ যার বাপ হবার কথা-- সে মামা হয়্যেঁ যায়!'

'অরণ্যের কাব্য', 'জল পড়ছে', 'ঢেমনা মঙ্গল', 'শিরি চুনারাম মাঁহত', 'জুমঢ়া' প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের জন্য এই কবি অমর হয়ে থাকবেন।

বোবার শত্রু না থাকলেও, কবির শত্রুর অভাব হয় না। ভবতোষদার মতো ভোলেভালা মানুষেরও শত্রু ছিল। আর থাকবে নাই বা কেন! এ প্রসঙ্গে আজিজুল হকের লেখা থেকে একটু তুলে দেওয়া যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ....' এক জায়গায় এসে চোখটা আটকে গেল --"তীক্ষ্ণ পাটন, করে টনটন, নগ্ন টাঙ্গির ধার, প্রতিশোধ নিতে, পশুবলি দিতে, উদ্যত হাতিয়ার।"
আরে! এটা যেন কোথায় পড়েছি! বেশি কষ্ট করতে হল না-- মনে পড়ে গেল।
"অস্ত্র ধরেছি, এবার সম্মুখে শত্রু চাই।"
সুকান্ত-কবি শত্রুর খোঁজে অস্ত্র ধরেছিলেন, আর ইনি তো শত্রু পেয়েই গেছেন। পাবেনই তো। বাপের বাউণ্ডুলে ছেলে। জমিদার-নন্দন। ফেরেপবাজিতে পড়ে, সব বেচে বুচে এখন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রেখেছেন। সুতরাং ইনি হাড়ে হাড়ে জানেন শত্রু কারা।'

ভবতোষদা ছিলেন, 'জাতে মাতাল তালে ঠিক।' যতই ভোলেভালা হন, যতই সর্বক্ষণ আবেগে টইটম্বুর থাকুন, কলম হাতে নিয়ে তিনি কখনোই তাল হারাননি। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের পক্ষে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে অগ্নি উদগিরণ করতে তাঁর কলম কখনোই থেমে থাকেনি। আজিজুল হক যথার্থই লিখেছেন, ....  'ভবতোষ-কবি তাই 'অরণ্যের কবি' নন, অরণ্যবাসীদের সংগ্রামের কবি।'

কবির জীবদ্দশাতেই তাঁর কবিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণির সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁকে নিয়ে মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক গবেষণা করছেন।

একটা সময় পর্যন্ত কবির কবিতার বই খুব সহজে পাওয়া যেত না। এখন ঝাড়গ্রাম থেকে প্রকাশিত 'অরণ্যের কাব্য ও সংকলিত ভবতোষ' পাওয়া যায়। এতে কবির ছ-টা কাব্যগ্রন্থের কবিতা সংকলিত হয়েছে। কিছুদিন হল ঝাড়গ্রামে 'কবি ভবতোষ স্মৃতিরক্ষা কমিটি' গঠিত হয়েছে। এই কমিটির সদস্যরা কবির লেখা সমস্ত কবিতা ও গান 'ভবতোষ রচনাসমগ্র' নামে প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেছেন। ইতিমধ্যে প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ চলছে। কবির অনেক রচনা ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। এখনও যতটা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তার সবটাকে রক্ষা করা গেলে একটা ভালো কাজ হবে।






অরি মিত্র