।আমাদের রবীন্দ্রনাথ।

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়–

যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করেনি শতধা; নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্মচিন্তা আনন্দের নেতা–

নিজহস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।

       — নৈবেদ্য/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


রবীন্দ্রনাথ কোথায় থাকেন? কেউ বলেন বইয়ের আলমারির তাকে, কেউ বলেন বাঙালিদের মনের অলিন্দে, আবার কেউবা বলেন তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর জীবিতাবস্থায় এই প্রশ্নের উত্তর হতে পারত, তিনি থাকেন কলকাতার জোড়াসাঁকোয় কিংবা বীরভূমের শান্তিনিকেতনে। জমিদারি সামলাতে শিলাইদহ, শাজাদপুর ও পতিসরে থাকতেন যেমন; তেমনই তিনি তাঁর আশি বছরের জীবনে বহুবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গেছেন ও থেকেছেন। 'আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি/আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি'-- এই প্রত্যয় ব্যক্ত করার পাশাপাশিই আবার বলেছেন নিজের সীমাবদ্ধতার কথা– 'আমার কবিতা, জানি আমি,/ গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।'
           না পড়লেও রবীন্দ্রনাথের বই কিনি আমরা। তাঁর বই সযত্নে সাজানো থাকে আমাদের বইয়ের আলমারির তাকে। তবে তেমন করে তাঁর বই না পড়লেও নানা সূত্রে তাঁকে আমরা নিজেদের মতো করে 'জেনে যাই'– পঁচিশে বৈশাখের হাত ছুঁয়ে-থাকা কবিপক্ষ, বাইশে শ্রাবণ উপলক্ষে অনেকদিন ধরে চলতে থাকা রবীন্দ্রস্মরণ, প্রতিদিন সকালে বেতারবাহিত রবীন্দ্রগান ও সারাবছর নানা উপলক্ষে নানাবিধ রবীন্দ্রচর্চায়। অর্থাৎ, সারাবছরই আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মেতে থাকি।
         কোনও কিছুই যেহেতু সর্বত্রগামী হয় না, তাই সর্বত্রগামী না হতে পারার জন্য রবীন্দ্রনাথের খেদেরও কোনও কারণ নেই। তাই সর্বত্রগামিতার কথা পাশে সরিয়ে রেখে আমরা বরং তাঁর বিচিত্রগামিতার নিরিখে পৃথিবীর যুগন্ধর সাহিত্য-প্রতিভাদের পাশে তাঁর স্থান ঠিক কোথায় সেটুকু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।
         রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি, কবি হিসেবেই তাঁর জগৎজোড়া খ্যাতি। তিনি যদি কবিতা ছাড়া আর কিছুই না লিখতেন ও না করতেন, তাতে তাঁর খ্যাতি (এবং খাতির) কিছু কম হত না। কিন্তু কবিতা ছাড়াও তিনি আরও অনেক কিছু লিখেছেন ও করেছেন। তিনি অজস্র গান লিখেছেন, তাঁর কোনো কোনো গানে তিনি নিজেই সুর দিয়েছেন, তিনি প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্যনাটক, নৃত্যনাট্য, অগুনতি উচ্চমানের চিঠি লিখেছেন, দুটো দেশের জাতীয় সঙ্গীত লিখেছেন, নাটকে অভিনয় করেছেন ও নাট্য পরিচালনা করেছেন, পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, গান গেয়েছেন, কবিতা  আবৃত্তি করেছেন,  নৃত্যের স্বতন্ত্র ধারার উদ্ভাবন করেছেন, ছবি এঁকেছেন (শৈলীর দিক দিয়ে যা এমনই স্বাতন্ত্র্যচিহ্ণিত যে দেখলেই বোঝা যায় সেগুলি রবীন্দ্রনাথের আঁকা), বোলপুরে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় (বিশ্বভারতী– যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্) তৈরি ও পরিচালনা করেছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নিয়ে এসেছেন, শিক্ষকতা করেছেন, পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন, লোকসঙ্গীত, লোকছড়া ও লোকশিল্প সংগ্রহ করেছেন, কৃষি ব্যাঙ্ক ও সমবায় ব্যাঙ্ক তৈরি ও পরিচালনা করেছেন, পল্লী উন্নয়নের জন্য নানাবিধ কর্মোদ্যোগে নেতৃত্ব করেছেন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতনের বিপুল কর্মযজ্ঞে প্রধান কর্মীর ভূমিকা পালন করেছেন, বেশ কয়েকবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে জটিল সব বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সামিল হয়েছেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য প্রতিবাদসভা আহ্বানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন (এবং রাজনৈতিক নেতাদের এই ব্যাপারে গয়ংগচ্ছ ভাব দেখে হতাশ হয়েছেন)।
         একবার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে, মহাভারতের কবি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের পরে, ভারতের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য লেখক বলেছিলেন। এডওয়ার্ড টমসনের বিচারে রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের পরবর্তী দেড় হাজার বছর কালপর্বের সবচাইতে বড়ো ভারতীয় কবি। আমরা ভারতের সীমা ছাড়িয়ে  রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিশ্বপরিক্রমায় যেতে চাই।
         সমস্ত রকম লেখালেখির কথা ধরলে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন পৃথিবীর এমন কোনও কবির কথা আমাদের জানা নেই। নাটকে, চিত্রকলায় বা সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথের চাইতে বড়ো প্রতিভার কথা আমরা জানি। কাব্যকৃতির বিচারে তাঁর সমকালে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ কবি (ইংল্যান্ডের স্ট্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভনে  শেক্সপিয়ারের জন্মভিটেতে শেক্সপিয়ার ছাড়া আর শুধু রবীন্দ্রনাথের মূর্তির অবস্থিতি যেন একথাই জ্ঞাপন করছে)। আর সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের বিচারে পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে তাঁর সমতুল কোনও সাহিত্য-প্রতিভার কথা আমরা জানি না, যিনি রবীন্দ্রনাথের মতো এত বিচিত্র বিষয়ে এমন বিপুল অবদান রেখে গেছেন। তাই, কবি দিনেশ দাসের কথায় কোনও অত্যুক্তি নেই – 'তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা/কোনখানে রাখব প্রণাম?'
          বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর যাবতীয় লেখা লিখেছেন, এই কথা ভেবে আমাদের কিঞ্চিৎ শ্লাঘার কারণ আছে বই কি! তবে ওই পর্যন্তই। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমরা বাঁশি বাজাতেই ব্যস্ত। তাঁর মতো 'শতকর্মে রত' হতে আমাদের বড়োই অনীহা। যখন 'নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস'-- তখন কি আমাদের কিছুই করার নেই? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আড়ম্বর করতে করতে, তাঁর পূজার ছলে সারাবছর তাঁকে ভুলেই থাকি আমরা। পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণের রবীন্দ্রসংকীর্তনের খোলকরতালের কোলাহল ছাড়িয়ে তাঁর আদর্শকে চলতি সময়ের বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে সমাজের জন্যে, মানুষের কল্যাণে আমাদের চিন্তা ও কর্মোদ্যোগ নিয়োজিত না হলে, রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার আমাদের অধরাই থেকে যাবে।


।অরি মিত্র।