আমি কেমন কবিতা লিখতে চেষ্টা করি
৩ মার্চ, ২০১৬
কেমন কবিতা লেখা উচিত এ বিতর্কের কোনো শেষ নেয় এবং আমি মনে করি এ বিতর্কে যাওয়া উচিত নয়| আসলে যে কবি যে ধরনের কবিতা লিখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন তার সে ধরনের কবিতায়ই লেখা উচিত: অর্থাত গদ্য কবিতা না পদ্য কবিতা, শব্দ চয়নের চাতুর্য্যে শাব্দিক ছন্দ, না মাত্রার সমতায় অন্তমিলে ছন্দ, অথবা মাত্রার অসমতায় অন্তমিলে ছন্দ, অথবা এ সব কিছুর সমন্বয়|
আমি ব্যক্তিগতভাবে মাত্রার সমতায় অন্তমিলে লেখা কবিতা পড়তে স্বচ্ছন্দ বোধ করি, কারণ এতে কবিতার আবৃত্তি সহজ এবং শ্রুতি মধুর হয়| তবে মাত্রার সমতা এবং অন্তমিলের ছন্দ রক্ষা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে দাড়ায় অথবা যা সহজভাবে সরাসরি বলতে চাই তা সীমিত সারির ভিতরে বলা সম্ভব হয় না| মাত্রার অসমতা একটা সীমার মধ্যে রেখে অথবা শাব্দিক ছন্দে পূরণ করে অসমতা মাত্রার অন্তমিলে লেখা কবিতাও শ্রুতি মধুর হয়ে থাকে, তবে আবৃত্তিকার কবিতাটা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ এবং গতির সমন্বয় না করে নিলে আবৃত্তির সময় ছন্দপতন ধরা পড়ে এবং শ্রুতিকটু মনে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে|
আমি মনে করি কবিতার ভাষা শব্দ সহজবোধ্য হবে না উচ্চ পর্যায়ের জটিল হবে তা নির্ভর করে কবিতার বিষয় কি এবং কাদের জন্যে লেখা হচ্ছে তার উপর| যদি কবিতার বিষয় বস্তু হয় সাধারণ মানুষের জীবন, সুখ, দুঃখ আর কবিতাটা লেখা হয় অতি উচ্চ জটিল ভাষায় তাহলে তেমন কবিতা সাধারণের কাছে সমাদৃত হওয়ার নজির খুব কম| আর এই ধরনের কবিতার ভিতর উপমা, উতপ্রেক্ষা গুলোও খুব পরিচিত আর সাধারণ হওয়া উচিত| "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি" এটা বাংলার সবার কাছে জনপ্রিয় কারণ এটার উপকরণগুলো আমাদের খুব পরিচিত আর ভাষা খুব সহজবোধ্য| আমি সাধারনত খুব সহজ শব্দে কবিতা লিখতে পছন্দ করি - অর্থাত যে শব্দগুলো আমরা সচারচর ব্যবহার করি এবং সাধারণ মানুষে সহজে বুঝে| আমি অস্বীকার করিনা যে আমার বাংলা সাহিত্যের উচ্চমানের শব্দ ও প্রতিশব্দের উপর জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এটার একটা কারণ, কিন্তু কবিগুরু বা নজরুল ইসলামের এ ধরনের সীমাবদ্ধতা যে ছিলনা তা যেমন একদিকে শত শত কবিতায় প্রমান পাওয়া যায়, অন্যদিকে শত শত কবিতা প্রমান করে উনারা কত সহজ ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছেন| সহজ কথা সহজে বলা যে কত কঠিন কাজ তা নিয়ে কবিগুরুর পুরো একটা কবিতাও আছে|
আমি সাধারনত চেষ্টা করি কবিতার বক্তব্য খুব স্পষ্ট এবং সহজে বোধগম্য করার| শুরুতেই পরিস্কার করতে চাই কি কারণে কবিতাটা লিখছি, মাঝখানে কিছু নাটকীয়তা আসতেই পারে তবে উপসংহারে মূল বক্তব্যটার পুনরাবৃত্ত হলেও পাঠকের মনে কিছুক্ষনের রেশ রাখা অথবা সুখ, বেদনার বা প্রশ্নের অনুভুতি রাখার চেষ্টা করি| নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতার শুরু এবং শেষে খুবই স্পষ্ট কেন এই কবিতা লেখা হয়েছে, তাই হয়ত এটা এত জনপ্রিয়|
কবি এবং কবিতার উপর যারা গবেষণা করেন তারা ছাড়া, অন্য পাঠকদের কবিতায় আকৃষ্ট করা সম্ভব নয় যদি কবিতার বক্তব্য স্পষ্ট না হয়, ভাষা সহজবোধ্য না হয়, উপমাগুলো পরিচিত না হয়, পড়তে স্বাচ্ছন্দবোধ না হয়, শুনতে শ্রুতি মধুর না হয়| আর আজকের যুগের ব্যস্ত জীবনে এগুলো বারবার না পড়ে একবার পড়ে হলেই সবচেয়ে ভালো হয়, কারণ এখনকার কবিরা যেমন রাজার দরবারে কবিতা পাঠ করে তার অর্থ, নিগুড় রহস্য, বা আধ্যাতিকতা বর্ণনা করার জন্যে বেতনভোগী সার্বক্ষণিক চাকুরীজীবি নন, তেমনি পাঠকগণ ও অফুরন্ত সময় হাতে রাজা, জমিদার বা গভেষক নন|
পুনশ্চ: এই আসরের কোনো কবিতা বা কবির কোনো সমালোচনার জন্যে এই লেখা নয়| এটা শুধু কবিতার ব্যাপারে আমার নিজস্ব অনুভুতি| কবি হিসাবে আমার নিজের দক্ষতা একেবারেই শুন্য বললেও আমার কোনো আপত্তি নেই, তবে একজন পাঠক হিসাবে কোন ধরনের কবিতা আমার ব্যাক্তিভাবে পছন্দ তা বলার স্বাধীনতার সুযোগ নিলাম| অন্যের পছন্দ অন্য রকম হতেই পারে|