আমার আগের আলোচনার (কবিতা ও মনস্তত্ত্বের মধ্যে সম্পর্ক) শেষে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম পরের লেখাতে কবিতা ও মানসিক স্বাস্থের মধ্যে সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করব। লেখার জন্যে সরঞ্জাম খুঁজতে গিয়ে দেখলাম ব্যাপারটা এতোই ব্যাপক যে ছোট একটা লেখায় সহজভাবে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তাই একাধিক লেখায় এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করার আশা রাখছি।
আমরা স্বাস্থ এবং রোগ বলতে সাধারণত শারীরিক স্বাস্থ বা রোগ বুঝে থাকি। যদিও মানসিক স্বাস্থ, মানসিক রোগ কথাগুলো আজকাল প্রচলিত হয়েছে তবুও সাধারণভাবে অধিকাংশ মানুষ মানসিক রোগ বলতে বুঝে থাকে পাগলামী, যার চিকিত্সা বলতে বুঝে থাকে আবদ্ধিকরণ ও নানা ধরনের নির্যাতনমূলক কাজ কাম। তাই আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে মানসিক রোগের উন্নত বিশ্বে বর্তমান ভাবনা সম্পর্কে কিছু জানা দরকার।
মানসিক হতাশা (mental depression) এবং উদ্বেগ ব্যাধি (anxiety disorder), এই দুটিকে বর্তমান বিশ্বে মানসিক রোগের মূল রূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ দুটি মানসিক অবস্থার মধ্যে সম্পর্ক এতই নিবিড় - আর একটি থেকে আর একটির উত্পত্তি - যে মানসিক স্বাস্থ বলতে সাধারণত এখন এ দুটিকেই একসাথে বুঝানো হয়। মানসিক হতাশার সহজ সংজ্ঞা হলো মেজাজ বিশৃংখলা যা কাউকে দীর্ঘদিন নিয়িমিতভাবে দুঃখ বোধ, উত্সাহহীনতা ও কর্মস্পৃহাহীনতায় ভোগায়। এ রোগ একজন মানুষের অনুভূতি, চিন্তা এবং আচরণের উপর সাংঘাতিক প্রভাব ফেলে, যা ব্যক্তির আবেগ ও কর্মস্পৃহাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যে তার দৈনন্দিন জীবন অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ রোগে যারা ভোগে তারা মাদকে আসক্ত হতে পারে, আত্ম হননের কথা ভাবতে পারে ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যকে আক্রমন ও খুনও করতে পারে। সুতরাং তার অস্বাভাবিক আচরণের ফল ভোগ করে তার কাছের অন্যান্য মানুষেরা। সুতরাং অনেক শারীরিক রোগের তুলনায় এ রোগ বেশী মারাত্মক এবং বেশী বিরূপ প্রভাব ফেলে একটা সমগ্র পরিবারের উপর।
২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার (WHO) সমীক্ষা অনুসারে পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ এ রোগে ভুগছিল যা বর্তমানে বহু সঙ্খ্যায় বেড়েছে এতে সন্দেহ নেই। প্রাপ্ত বয়স্ক জনসঙ্খ্যার শতকরা প্রায় ১৫ জন মানুষ জীবনের কোন এক সময় এ রোগে ভোগে বলে বলা হয়েছে। গবেষণায় পাওয়া যায় মস্তিস্ক রসায়ন, হরমোন, বংশগত ধারা, জীবনের অভিজ্ঞতা, শারীরিক স্বাস্থগত সমস্যা - এর যে কোন একটি বা একাধিক সংমিশ্রণ এ রোগের জন্ম দিতে পারে। শারীরিক যে কোন রোগের মতই মানসিক হতাশাকে এখন রোগ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং উন্নত দেশগুলোতে সরকারী চিকিত্সায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ রোগের কিছু চিকিত্সা পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে এবং নতুন নতুন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। স্বাভাবিকভাবেই কেবলমাত্র ওষধের চেয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম যা মানুষের মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে তার উপরে গুরুত্ব দেওয়া হয় এ রোগের চিকিত্সায়। কবিতা যেহেতু নিবিড় মানসিক প্রক্রিয়ার ফসল এবং এর পঠন এবং আবৃত্তি মানুষের মনকে বিশেষভাবে আন্দোলিত করে তাই এ রোগের জন্যে কবিতা চিকিত্সা (poetry therapy) স্বীকৃত একটি পদ্ধতি, এর উপর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে।
চিকিত্সা বিজ্ঞানে এর ব্যবহার এবং ফলাফল যাই হোক আমরা যারা কবিতা লিখি, পড়ি, আবৃত্তি করি তারা যদি বুঝতে পারি কবিতা চিকিত্সা কেন কাজ করে, তাহলে আমাদের কবিতাকে ওষধের মত মূল্যবান সামগ্রী হিসাবে বিবেচনা করে এর মান বজায় রাখার ব্যাপারে যত্নবান হতে পারি। আচ্ছা কবিতা লেখার পদ্ধতিতেই কবি কখনও এ মানসিক রোগের শিকার হতে পারে কি? কবিতা কারো কারো এই মানসিক রোগ বা বিশেষ মানসিক অবস্থার ফসল নাতো? এগুলোর উত্তর খোঁজার ইচ্ছা রইল ভবিষ্যতের কিছু লেখাতে। অনেকগুলো পরীক্ষার মধ্যে কবিতা চিকিত্সার একটি গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি।
পরীক্ষাটি করা হয় ইরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ২৯ জন ছাত্রীর ওপর যারা হতাশা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপে ভুগছিল। পরীক্ষাটির উদ্দেশ্য ছিল গ্রুপে কবিতা চর্চার ফল কী তা দেখা। ১৪ জন ও ১৫ জনের দুইটি গ্রুপ তৈরী করা হয়। ১৪ জনের গ্রুপটি ৭টি গ্রুপ পয়েট্রি থেরাপি সেসনে অংশ নেয়, প্রত্যেকটি সেসন ছিল ৯০ থেকে ১২০ মিনিটের। ১৫ জনের গ্রুপটি এর বাইরে থেকে সাধারণ জীবন যাপন করে। পয়েট্রি থেরাপি শুরু করার আগে, দুটো সেসনের পরে এবং সবগুলি সেসনের পরে এই ২৯ জনের প্রত্যেকের হতাশা (depression), উদ্বেগ (anxity) এবং চাপ (stress) এক ধরনের স্কেলে মাপা হয় যে স্কেলের নাম (DASS - Depression, Anxiety and Stress Scale)। ফলাফলে দেখা যায় যে গ্রুপটি পয়েট্রি থেরাপিতে অংশ নিয়েছিলে তাদের প্রত্যেকের মানসিক হতাশা, উদ্বেগ ও চাপ বহুলাংশে কমেছিল আর বাকি ১৫ জনের অবস্থা পাওয়া যায় ঠিক তার বিপরীত। বলা হয় এ পরীক্ষার ফলাফল পূর্বের এ রকম পরীক্ষার ফলাফলকেই আবার সত্য প্রমাণ করে এবং আরও বহুমুখী পদ্ধতিতে ভবিষ্যত পরীক্ষার জন্যে সুপারিশ করে।
কবিতা কেন আবং কিভাবে মানসিক রোগমুক্তির চিকিত্সা হিসাবে কাজ করে আগামী আলোচনায় তা বুঝার চেষ্টা করব।
সবার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা কামনা করছি।