কিছুদিন যাবত মন্তব্যের নামে বা আলোচনার নামে বিভিন্ন প্রকার কবিতা ও কবি নিয়ে যে কাদা ছুড়াছুড়ি চলছে সেই পরিবেশে শ্রদ্ধেয় কবির অত্যন্ত সুলিখিত এই প্রবন্ধটি পথ নির্দেশনামূলক। শ্রদ্ধেয় কবির সাথে সহমত হওয়ার পাশাপাশি নিজের মনের দুচার কথা লেখার লোভটা সামলাতে পারলাম না, সারাদিন শেষে ক্লান্ত দেহে হোটেলে বসে যখন মিনিট, ঘণ্টা গুনছি কাল ভোরে বাড়ীর উদ্দেশ্যে উড়ার অপেক্ষায়।
আমার ধারণা, প্রত্যেকটি মানুষের ব্রেনে একটা বিন্যাস প্রক্রিয়া (algorithm) থাকে যে অনুযায়ী মানুষ ভাবে এবং প্রকাশ করে। তাই একই বাবা মায়ের সন্তান হয়ে, একই সময়ের মানুষ হয়ে, একই পরিবেশে বসবাস করে, একই শিক্ষকের ছাত্র হয়েও, প্রত্যেকের ভাবনা আলাদা, প্রকাশভঙ্গি আলাদা। এমন ভাবা ঠিক নয় যে যারা পুরানো ছন্দ ধারায় কবিতা লেখে তারা তা নিতান্ত ইচ্ছা করেই করে। আসলে তাদের ভাবনাটা ও লেখাটা ওইভাবেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে গুছিয়ে আসে, তাই তারা ওরকম লেখে। খুব কসরত করে হয়তো দু একটা অন্য ধারায় লেখা যেতে পারে, তবে তাতে ফলবতী কোন কাব্য চর্চা হয় না। ঠিক তেমনি উল্টোটাও সত্যি।
কবিতা পড়ার ক্ষেত্রেও কিন্তু ব্যাপারটি ঠিক একই ভাবে সত্যি, অনেকেই সুক্ষ্ণ ছন্দ বজায় রেখে পড়তে পারে না, অথচ গদ্য কবিতা খুব সুন্দর পড়তে পারে। ঠিক তেমনি উল্টটিও সত্যি। সুতরাং অন্যকে আক্রমন না করে যার যেমন স্বাভাবিকভাবে ভালো হয় তার তেমন চর্চা করা উচিত, এবং অন্যকে অন্যের মত চর্চা করতে উত্সাহিত করা উচিত।
কবিতার প্রকাশ সহজ না কঠিন হবে তা নির্ভর করে কবিতাটি লেখার উদ্দেশ্য কি, এবং কোন ধরনের পাঠককে উদ্দেশ্য করে লেখা হচ্ছে। শিক্ষামূলক কবিতা সাধারণ মানুষ অথবা শিশুদের উদ্দেশ্যে লেখা হলে, তা যত সরাসরি ও সহজ প্রকাশ হবে ততই উদ্দেশ্য সফল হবে। তবে শব্দ সহজ হলেই যে প্রকাশ সহজ হবে, এমন ভাবা কিন্তু ঠিক নয়। সোনার তরী কবিতাটির প্রায় সব শব্দই অত্যন্ত পানির মত সহজ, অথচ তার বক্তব্য কিন্তু বর্ষা ও ধান ভর্তি নৌকার যে চিত্র আঁকা হয়েছে তাতেই শেষ নয় (অনেকের কাছে শুধু এটিই), বরং অত্যন্ত জটিল, গভীর ও কালজয়ী বক্তব্য আছে। গীতাঞ্জলীর বেশীর ভাগ গানও কিন্তু এ রকমই। আবার সব কবিরই কিছু কিছু কবিতায় ভাব, রূপক ও শব্দ এতই উচ্চাঙ্গের যা বুঝতে অত্যন্ত সুশিক্ষিত ও সুদক্ষ পাঠকের প্রয়োজন, এবং যার উপর বিভিন্ন রকম গবেষণা চলে - মানুষের চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিত করতে ও ভাষার ক্রমাগত উতকর্ষ সাধনের জন্যে যার প্রয়োজনীয়তাও অপরিহার্য। তবে আমার মত নিম্ন মানের যারা লিখি, যাদের উদ্দেশ্য নিজের মনের চিন্তাটা একটু সুন্দরভাবে বলে একটু আনন্দ পাওয়া, আর সেই বলাটা যদি কঠিণ শব্দ ও রূপকের মাঝে হারিয়ে যায়, তাহলে আর লিখে লাভ কি?
লক্ষ্য করছি যারা যে ধরনের কবিতা লিখছে তারাই সাধারণ পাঠককে ধরে রাখতে কবিতার ব্যর্থতাকে অন্য ধরনের কবিতা ও কবিদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টা অত সহজ বলে আমার কাছে মনে হয় না, এবং এ ব্যাপারে কোন নির্ভরযোগ্য সমীক্ষা হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। সুতরাং যারা ব্যবসা সফল কবি হতে চায় তারা এ রকম সমীক্ষার প্রয়াস নিয়ে দেখতে পারে সম্ভবতঃ বিভিন্ন বই মেলায় প্রশ্নমালা বিলিয়ে এবং উত্তর সংগ্রহ করে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সব ধরনের কবিতার পাঠক সব সময়েই কম ছিল, আর এখন আরও কম মনে হওয়ার, বা আসলেই কম হওয়ার কারণ অন্যকিছুঃ মানুষের চারিদিকে বিভিন্ন বিনোদনের ও জ্ঞান অর্জনের অসংখ্য উত্স যাতে মানুষ না চাইলেও প্রায় সারক্ষণই ব্যস্ত। আবার প্রযুক্তির আশির্বাদে এখন কবির সংখ্যাও অসংখ্য।
সার সংক্ষেপে, আমি বহুদল, বহুমত, বহুপথে সহনশীল। যে যা করুক এবং বলুক তার প্রতি সাধারণ সৌজন্য দেখিয়ে আমার মত আমার নিজের পথে চলে পথচলার আনন্দ উপভোগ করতে চাই। কারো প্রতি কাদা ছুড়লে সে ছুড়বে না এমন আশা করা সব যুগেই অবাস্তব, তবে এই ব্যক্তিস্বাধীনতার যুগে একেবারেই অবাস্তব। সময়ের ধারায় কে কতদিন, ঠিক কোন্ কারণে ঠিকে থাকবে বা থাকবে না তার বিচার এতো সহজ নয়। আর সে ভবিষ্যত বাণী করার দরকারই বা কি?
শ্রদ্ধেয় কবি অসুস্থ শরীরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে হয়তো বড় এক মনোবেদনা নিয়ে এই লেখাটি লিখেছেন। লেখাটির উদ্দেশ্য সফল হোক, সবার জন্যে নির্দেশনা হোক, আসরের পরিবেশ সবার জন্যে আনন্দদায়ক ও নিরবিচ্ছিন্ন কবিতা চর্চার জন্যে অনুকুল হোক সেই আশা রাখি। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং অনুরোধ জানাই এ সব ভাবনা এবং লেখা যেন কবির পরিপূর্ণ বিশ্রামে ব্যাঘাত না ঘটায়।
আসরের সবার প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা রইল।